ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাফুফের গাফিলতিতে অর্থ পুরস্কার থেকে বঞ্চিত গত ডিসেম্বরে চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলের চার কোচ

সাফ জয়ী নারী ফুটবল দলকে জনতা ব্যাংকের সংবর্ধনা

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সাফ জয়ী নারী ফুটবল দলকে জনতা ব্যাংকের সংবর্ধনা

রুমেল খান ॥ খেলাধুলায় দেশের হয়ে সাফল্য পেলে সবাই সেটা মনে রাখে। তবে যে বা যারা দেশের জন্য এই সাফল্য বয়ে আনেন তাদের যদি যথাযথ সংবর্ধনার মাধ্যমে আর্থিকভাবে পুরস্কৃত ও সম্মানিত করা যায় তাহলে খেলোয়াড়রা নিঃসন্দেহে ভাল খেলতে আরও বেশি অনুপ্রাণিত হন। তাছাড়া আগের চেয়েও আরও বেশি দায়িত্বশীল হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রেক্ষাপটে এই সংবর্ধনার বিষয়টি একটু ভিন্ন। এখানে ক্রিকেট খেলায় যৎকিঞ্চিৎ সাফল্য পেলেই ক্রিকেটারদের পুরস্কার (গাড়ি-বাড়ি-জমিসহ আরও কত কি!) আর অর্থের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে পাগল হয়ে যান সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে অবহেলিত হন ফুটবল-হকি-দাবা-সাঁতার-শূটিংসহ অন্য খেলায় সফল ক্রীড়াবিদরা। তবে অবহেলিত খেলাগুলোর খেলোয়াড়রা (বিশেষ করে মহিলা ফুটবলাররা) যে সংবর্ধনার মাধ্যমে আর্থিক প্রণোদনা একেবারেই পান না এমনটা নয়। তারা সেটা পান। সেটা তিনভাবে। একটা হচ্ছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় তাদের আর্থিক পুরস্কার দেয়ার ‘লোক দেখানো’ ঘোষণা বারবার দিয়েও সেই প্রতিশ্রুতি পালন করে না। আরেকটি হচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান তাদের সংবর্ধনার মাধ্যমে কোন আর্থিক প্রণোদনা না দিয়ে সস্তা মূল্যের কিছু ইলেকট্রনিক্স পণ্য উপহার দেয়। আরেকটি হচ্ছে কিছু প্রতিষ্ঠান সংবর্ধনায় টাকাও দেয় না, আবার ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যও দেয় না। শুধু শুকনো ফুল এবং নি¤œমানের-কম দামী ক্রেস্ট দিয়েই দায়িত্ব সারে দায়সারাভাবে। তবে বৃহস্পতিবার চতুর্থ আরেকটি উদাহরণ সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। যেটিকে ব্যতিক্রমও বলা যেতে পারে। ক’দিন আগেই সাফ অনুর্ধ-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে বাংলাদেশের মেয়েদের। তবে ২০১৭ আসরের চ্যাম্পিয়ন তারা। গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকার কমলাপুর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সাফ অনুর্ধ-১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল স্বাগতিক বাংলাদেশ দল। এদিন সেই দলটিকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ভবনের কনফারেন্স রুমে এক সংবর্ধনা দেয়া হয়। বাংলার বাঘিনীদের সেই সাফল্যের স্বীকৃতি দেয় জনতা ব্যাংক। তবে বিস্ময়কর হলেও সত্যÑ মেয়েদের সাফল্যের প্রকৃত-নেপথ্য রূপকার, সফল কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনকে করা হয়নি এ সাফল্যের অংশীদার। শিষ্যারা অর্থ পুরস্কার পেলেও গুরু হয়েছেন বঞ্চিত। শুধু হেড কোচ হিসেবে ছোটনই নন, তার মতো বঞ্চিত হয়েছেন ওই দলের তিন সহকারী কোচ মাহবুবুর রহমান লিটু, মাহমুদা আক্তার অনন্যা এবং সাবিনা খাতুনও। দলের ২২ ফুটবলারকে দেয়া হয় জনপ্রতি ২৫ হাজার টাকার চেক। তবে সাফের ওই আসরের সেরা খেলোয়াড় ডিফেন্ডার এবং সহ-অধিনায়িকা আঁখি খাতুনকে দেয়া হয় একলাখ টাকার চেক। সবমিলিয়ে ২৩ ফুটবলারকে দেয়া হয় মোট সাড়ে ৬ লাখ টাকা। যেহেতু অনুষ্ঠানটি কোন সংবাদ সম্মেলন ছিল না, তাই ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করারও সুযোগ ছিল না। এ বিষয়ে বাফুফে জানিয়েছেÑ এটা জনতা ব্যাংকের ব্যাপার। তারাই ভাল বলতে পারবে। এখানে তো বাফুফের কোন হাত নেই। তবে এখানে প্রশ্ন হচ্ছে জনতা ব্যাংক তো বাফুফের কাছে দলের তালিকা চেয়েছিল। সেই তালিকা বাফুফে তিন কোচের নাম অন্তর্ভুক্ত করেনি কেন? এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা জনতা ব্যাংককে কোচ-খেলোয়াড় সবার নামের তালিকাই দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত নেয় শুধু দলের খেলোয়াড়দেরই টাকা দেয়া হবে।’ সেটা না হয় মানা গেল। কিন্তু এক্ষেত্রে আবারও প্রশ্ন ওঠে বাফুফে কোচদের বিষয়টি ভালমতো বোঝাতে পারল না কেন? চার কোচ কি দলের বাইরেই কেউ ছিলেন? এভাবে যে তারা বঞ্চিত হলেন, সেটাতে কি বাফুফের দায়ভার নেই? সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাফুফে সভাপতি কাজী মোঃ সালাউদ্দিন বলেন, ‘মেয়েরা দু’বার দক্ষিণ কোরিয়া গিয়েছে। সেখানে মংগাই চুং অনেক সহায়তা করেছেন। তাকে ধন্যবাদ। জনতা ব্যাংক মেয়েদের সংবর্ধনা দিচ্ছে সেজন্য তাদের প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ।’ মেয়েদের উদ্দেশ করে সালাউদ্দিন বলেন, ‘আজকের এই অনুষ্ঠান তোমাদের জন্য। এখানে আমরা কিছুই না। কাজ কর। ভাল কর। এখান থেকেই ভবিষ্যত গড়তে পারবে। ফুটবলের পৃথিবী অনেক বড়। এখানে হাজার হাজার কোটি টাকা। সেটা তোমাদের অর্জন করে নিতে হবে।’ দক্ষিণ কোরিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি মং গাই চুং বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে খুব কমই সহায়তা করতে পেরেছি। ছেলেদের দল এশিয়ান গেমসে দুর্দান্ত পারফর্মেন্স করেছে। প্রথমবারের মতো তারা গেমসের দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছে। আমি তাদের এ সাফল্যে অভিনন্দন জানাই। তারা বারবার আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলাদেশে খেলতে নিয়ে আসে। এ জন্য আমি খুবই আনন্দিত। মেয়েরাও ফুটবলে ভাল করছে। তাদের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।’ জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান লুনা শামসুদ্দোহা বলেন, ‘তোমরা অনেক ভাল ফুটবল খেল। আমি তোমাদের খেলা দেখে অভিভূত হয়েছি। জনতা পরিবার আশা করে ভবিষ্যতে তোমরা আরও ভাল ফল করবে।’ বাফুফে মহিলা ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ বলেন, ‘আমাদের ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি না থাকলে আজ মেয়েদের এই অবস্থানে নিয়ে আসা সম্ভব হতো না। তাদের এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান তার।’ উল্লেখ্য, গত এপ্রিলে হংকং থেকে জকি কাপ ফুটবলে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশে ফিরে আসার পর মেয়েদের সংবর্ধনা দিয়েছিল আরেকটি ব্যাংকÑ মধুমতি ব্যাংক। বিস্ময়করভাবে তারা মেয়েদের কোন আর্থিক প্রণোদনা দেয়নি। দিয়েছিল একটি করে ক্রেস্ট! বৃহস্পতিবার জনতা ব্যাংক অবশ্য মেয়েদের আর্থিক প্রণোদনা দিলেও পূর্ণাঙ্গভাবে দেয়নি। কারণ আর্থিক প্রণোদনা বঞ্চিত হয়েছেন মেয়েদের দলের চার কোচ। এই ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবেই নিন্দনীয়, দৃষ্টিকটু এবং কলঙ্কজনক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলেই মনে করছেন সচেতন ফুটবলপ্রেমীরা। আর পুরো ব্যাপারটির জন্য দায়ী বাফুফে। তাদের এই গাফিলতিতে দেশের ফুটবলাঙ্গনে সমালোচনা আর নিন্দার ঝড় বইছে। বাংলাদেশ দল ॥ মাহমুদা আক্তার, রূপনা চাকমা, সাগরিকা, আঁখি খাতুন, (সহ-অধিনায়ক), নাজমা, আনাই মগিনি, নিলুফার ইয়াসমিন নীলা, দীপা খাতুন, রুনা আক্তার, রুমি আক্তার, মারিয়া মান্দা, মনিকা চাকমা, তহুরা খাতুন, লাবণী আক্তার, শামসুন্নাহার, মুন্নী আক্তার, সোহাগী কিসকু, আনুচিং মগিনি, শামসুন্নাহার জুনিয়র, মারজিয়া খাতুন, সাজেদা খাতুন, ঋতুপর্ণা চাকমা, সুলতানা পারভীন। আর্থিক প্রণোদনা বঞ্চিত যারা ॥ হেড কোচ : গোলাম রব্বানী ছোটন, সহকারী কোচ : মাহবুবুর রহমান লিটু, মাহমুদা আক্তার অনন্যা এবং সাবিনা খাতুন।
×