ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

স্মৃতিলোপের ঝুঁকি কমাতে রক্তচাপ কম রাখুন

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

স্মৃতিলোপের ঝুঁকি কমাতে রক্তচাপ কম রাখুন

আলঝেইমার রোগ হচ্ছে মস্তিষ্কের ক্রণিক ক্ষয়জনিত রোগ যা সাধারণত ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং কালক্রমে এর অবনতি ঘটে। ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিলোপের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের কারণ হলো আলঝেইমার রোগ। প্রথমদিকের অতি সাধারণ লক্ষণগুলো হলো সাম্প্রতিককালে ঘটনাগুলো মনে রাখতে অসুবিধা হওয়া। একে বলে স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিলোপ। রোগের যতই অবনতি হয় এর লক্ষণগুলো ততই প্রকট আকারে প্রকাশ পেতে থাকে। এগুলোর মধ্যে আছে ভাষা বা কথা নিয়ে সমস্যা, বিভ্রান্তি, স্থান, কাল ও সম্পর্ক নিয়ে সচেতনতার অভাব, মেজাজ মর্জির হঠাৎ হঠাৎ পরিবর্তন, নিজের ব্যাপারগুলো সামলাতে না পারা, আচরণগত সমস্যা ইত্যাদি। ধীরে ধীরে শরীর তার নিজস্ব কাজকর্ম করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে শেষ পর্যন্ত মৃত্যু ঘটে। আলঝেইমার রোগের কারণ কী তা গবেষকদের কাছেও খুব বেশি পরিষ্কার নয়। এ রোগের প্রায় ৭০ শতাংশের জন্য এক বা একাধিক জিন দায়ী বলে মনে করা হয়। অন্যান্য কারণের মধ্যে আছে মাথায় আঘাত প্রাপ্তির কোন ঘটনা, বিষণœতা ও হাইপারটেনশন। তবে এক গবেষণামূলক পরীক্ষা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে রক্তচাপ কমিয়ে রাখলে আলঝেইমার রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত স্মৃতিলোপের লক্ষণসহ বোধশক্তি কমে যাওয়ার ঝুঁকি হ্রাস পায়। মার্কিন গবেষক মার্গারেট ড্যাফোডিল গ্রাহাম এই পরীক্ষাটি চালান। পরীক্ষায় দেখা গেছে রক্তচাপ কমিয়ে ফেললে চেতনাবোধ মৃদু হ্রাস পাওয়া (এমসিআই) ও সম্ভাব্য স্মৃতিলোপের ঝুঁকি কমানো যায়। এমসিআই হলো মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার একটা মাত্রা এবং একে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিলোপে প্রবেশ পথ বলে ধরা হয়। ২০৫০ সাল নাগাদ সারা বিশ্বে প্রায় ১৫ কোটি লোক ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশে আক্রান্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ৫৭ লাখ লোক আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত। ২০৫০ সাল নাগাদ এদের সংখ্যা বেড়ে ১ কোটি ৪০ লাখে দাঁড়াবে। আমেরিকার এফডিএ এ রোগের মূল কারণ নয় বরং এর লক্ষণগুলোর চিকিৎসা করার জন্য ৫টি অপূর্ব অনুমোদন করেছে। আলঝেইমারের যেসব ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছিল সেগুলো এযাবত কোন সাফল্য বয়ে আনেনি। বস্তুতপক্ষে গত বছর অনেক বড় বড় ওষুধ কোম্পানি আলঝেইমারের চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা হয় বন্ধ করে দিয়েছে অথবা নিউরোডিজার্নারেটিভ অবস্থার উন্নতির ওষুধ উদ্ভাবন বাদ দিয়েই বসেছে। জনসাধারণের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে হতাশাব্যঞ্জক। তবে এই হতাশার মধ্যেও আশার সঞ্চার করেছে গ্রাহামের ‘স্প্রিন্ট মাইন্ড’ নামক গবেষণা সেখানে হৃৎপি-ের সমস্যা আছে কিংবা হৃদরোগ দেখা দেয়ার অধিকতর ঝুঁকি আছে এমন ৯৩০০ শ’রও বেশি বয়স্ক লোককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের পাইকারিভাবে সবাইকে রক্তচাপ কমিয়ে সিস্টোলিক চাপ হয় ১২০ বা ১৪০-এর নিচে নামিয়ে আনতে বলা হয়। তাদের স্মৃতি ও নতুন তথ্য প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন জ্ঞানগত দক্ষতার ওপর গড়ে তিন বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। চিকিৎসকরা বলেন, এ কথাটা অর্থবহ যে রক্তচাপ ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিলোপকে প্রভাবিত করে। গাড়ির টায়ারের জন্য যেমন সঠিক বায়ু চাপ বজায় রাখতে হয়Ñ খুব বেশিও নয়, খুব কমও নয় তেমনি শরীরের বেলায়ও সঠিক রক্তচাপ দরকার। রক্তচাপ বেশি থাকলে কালক্রমে মস্তিষ্ক ও অন্যান্য অঙ্গে রক্ত বয়ে নিয়ে যাওয়া অতি নাজুক ধমনীগুলোর দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ থেকে এমন কিছু জিনিস তৈরি হয় যা আমরা ডিমেনশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত হিসাবে লক্ষ্য করি: যেমন প্রদাহ ও ছোটখাটো স্ট্রোক। পরীক্ষার ফল অনুযায়ী নিজেদের রক্তচাপ যারা সিস্টোলিক ১২০-এর নিচে রেখেছিল তিন বছরের গড় সময়ের পর তাদের এমসিআই বা সম্ভাব্য ডিমেনশিয়া দেখা দেয়ার ঝুঁকি যারা তাদের সিস্টোলিক রক্তচাপ ১৪০-এ রেখেছিল তাদের তুলনায় ১৫ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা শুধু হার্টের জন্যই নয়, মস্তিষ্কের জন্যও ভাল। এই প্রথম একটা পরীক্ষায় দেখা গেল যে, রক্তচাপ কমালে এমসিআই বা সম্ভাব্য ডিমেনশিয়া হ্রাস পায়। তার মানে এই নয় যে, রক্তচাপ পুরোদস্তুর ডিমেনশিয়ার ওপর কোন প্রভাব ফেলে না। ডিমেনশিয়া দেখা দিতে দীর্ঘ সময় লাগে। অন্তত এমসিআইএর চেয়ে বেশি সময় লাগে। তাই দীর্ঘ সময় ধরে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখলে ডিমেনশিয়ার আশঙ্কাও হ্রাস পাবে। পরীক্ষামূলক এই গবেষণার ফলাফলের পাশাপাশি অন্যান্য সূত্র থেকেও তথ্য-প্রমাণ মিলেছে যে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা জ্ঞানবুদ্ধি হ্রাস পাওয়ার বিরুদ্ধে একটা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘রাশ আলঝেইমা’র ডিজিজ সেন্টারের গবেষকদের অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, জীবনের শেষের বছরগুলোতে যারা দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপে ভুগেছে তাদের মস্তিষ্কের ক্ষতির মাত্রা বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কথাটাকে অন্যভাবে বলা যায় তাদের মস্তিষ্কে মৃত টিস্যুর এলাকার পরিমাণ বেশি থাকে সেখানে স্নায়ুকোষগুলো একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তাদের টাউ প্রোটিনের জট বেশি মাত্রায় থাকে। এটাও আলঝেইমার রোগের আরেক বৈশিষ্ট্য যা রোগের শেষ দিকে দেখা দেয়। রাশ কেন্দ্রের নিউরো সায়েন্সের প্রফেসর ড. জো আরভানিটাকিস বলেন তাদের গবেষণায় দেখা গেছে বয়স্কদের মধ্যে রক্তচাপের পরিবর্তনের সঙ্গে মস্তিষ্কের জ্ঞানবুদ্ধিগত ক্রিয়াকলাপ ও স্মৃতিলোপের পরিবর্তনের সম্পর্ক নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে। এই উপলব্ধি থেকে ক্যান্সার ও কিছু সংক্রামক রোগ যেমন নানা ধরনের থেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করা হয় তেমনিভাবে আলঝেইমার ও ডিমেনশিয়াও নানা ধরনের থেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করা সম্ভব। মায়ো ক্লিনিকের গবেষক পিটারসেন রক্তচাপ কম রাখা সংক্রান্ত সর্বশেষ তত্ত্বটি আলঝেইমার চিকিৎসায় এক ধাপ অগ্রগতি বলে মনে করেন। তিনি বলেন, এর সঙ্গে জীবন ধারায় পরিবর্তন ও ওষুধপত্র যুক্ত করা যেতে পারে। আলঝেইমার একাধিক কারণে হয়ে থাকে এই সত্যটি উত্তরোত্তর প্রমাণিত হওয়ায় শুধু কার্যকর ওষুধ দিয়েই এর চিকিৎসা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে আরও অন্য কিছুরও প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন পিটারসেন। তিনি বলেন, আলঝেইমারের ক্ষেত্রে যুক্ত চিকিৎসা নিশ্চিতভাবে প্রয়োজন। রক্তচাপ কম রাখা তারই একটা অংশ। রক্তচাপ কমিয়ে রাখার ব্যবস্থা ছাড়াও আলঝেইমার প্রতিরোধের আরও কিছু সম্ভাবনাময় উপায় আছে। যুক্তরাজ্যে ৯ হাজারেরও বেশি মধ্য বয়সী মানুষের ওপর ২৩ বছর ধরে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, যাদের অত্যধিক মদ্যপানের অভ্যাস আছে এবং যাদের একেবারেই অভ্যাস নেই তাদের ডিমেনশিয়া হওয়ার ঝুঁকি থাকেÑ সে সব মানুষের তুলনায় বেশি যারা পরিমিত মাত্রায় মদ্যপান করে থাকেন। যারা সপ্তাহে আট গ্লাস মদ্যপান করেন পরিমিত মদ্যপানকারীদের তুলনায় তদের এ রোগের ঝুঁকির আশঙ্কা বাড়ে ৪০ শতাংশ। আর যারা মদ স্পর্শই করেন না পরিমিত মদ্যপানকারীদের তুলনায় তাদের আলঝেইমার ও ডিমেনশিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে ৭৪ শতাংশ বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে মস্তিষ্কের নিউরনগুলো নষ্ট হয় এবং তার ফলে জ্ঞানবুদ্ধির কাজটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার একেবারেই মদ্যপান না করলে মস্তিষ্কে রক্তের প্রবাহ সুষ্ঠু রাখার কাজে এলকোহলের সুফল থেকে মস্তিষ্ক বঞ্চিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে আলঝেইমারে আক্রান্তে ৫৭ লাখ মানুষের দুই-তৃতীয়াংশই মহিলা। দেখা গেছে যেসব মহিলার তিন বা ততোধিক সন্তান আছে তাদের ডিমেনশিয়া হওয়ার আশঙ্কা এক সন্তানের মহিলাদের তুলনায় ১২ শতাংশ কম থাকে। সূত্র : টাইম
×