ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৫৯ রুটে পাঁচ হাজার লেগুনার পারমিট দেয় বিআরটিএ ;###;বিকল্প ব্যবস্থা না করে এভাবে থ্রি হুইলার বন্ধে ভোগান্তি বেড়েছে ;###;ক্ষুব্ধ লেগুনা মালিক, নগরবাসীও

দুর্ভোগে যাত্রীরা ॥ ঢাকায় হঠাৎ লেগুনা বন্ধ

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

দুর্ভোগে যাত্রীরা ॥ ঢাকায় হঠাৎ লেগুনা বন্ধ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ গুলিস্তান থেকে মাদারটেক বা গোড়ানে সরাসরি কোন বাস সার্ভিস নেই। সর্বোচ্চ বাসাবো পর্যন্ত গুলিস্তান থেকে বাসে আসা যায়। বাকি পথ সরু হওয়ায় এই রুটে লেগুনায় চলাচলই ছিল যাত্রীদের অন্যতম ভরসা। সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নির্দেশে লেগুনা চলাচল বন্ধ হয়। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। বুধবার সকালে বাসাবো টেম্পোস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা গেছে শত-শত অফিসগামী মানুষ রিক্সার অপেক্ষায়। সুযোগ বুঝে ভাড়া হাঁকানো হচ্ছে দ্বিগুণের বেশি। তাছাড়া অলি-গলিতে বেশিরভাগ ব্যাটারিচালিত রিক্সা হওয়ায় অনেকেই সরাসরি যেতেও পারছেন না। যারা ব্যাটারিচালিত রিক্সায় বাসাবো অথবা বৌদ্ধ মন্দির মোড়ে আসছেন তাদের বাসে উঠতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে দেখা গেছে। কারণ মিডওয়ে বাস বদলে হয়ে এখন মিডলাইন নামে সিটিং সার্ভিসে চলাচল করছে। ছোট ছোট বাস নামিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে অফিসগামী যাত্রীদের রাস্তায় রাস্তায় দুর্ভোগ পোহাতে দেখা গেছে। একই চিত্র ছিল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ১৫৯ রুটে প্রায় পাঁচ হাজার লেগুনা চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো অনুমোদিত যানবাহন কেন বন্ধ করা হয়েছে। যদি বন্ধ করতেই হয় তাহলে কেন বিকল্প গণপরিবহনের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, পরিবহন মালিক সমিতি ও বিআরটিসি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীঘ্রই গণপরিবহন সঙ্কটের সমাধান হচ্ছে না। নতুন পাঁচ হাজার অটোরিক্সা কবে নামবে কেউ বলতে পারে না। সিন্ডিকেটের কবলে ট্যাক্সি সার্ভিস। অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দুটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এখন নতুন ট্যাক্সি নামাতে সম্মত নয়। চার হাজার বাস নামানোর সিদ্ধান্ত কয়েক বছর ধরে চললেই সর্বশেষ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন জানিয়েছেন এসব বাস নামাতে সময় লাগবে আরও অন্তত দুই বছর। পরিবহন মালিকরা বলছেন, কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা না হওয়া ও যানজটের কারণে ঢাকায় বাস নামাতে আগ্রহ কমছে। গত পাঁচ বছরের বেশি সময় বন্ধ হয়েছে পঞ্চাশের বেশি বাস কোম্পানি। নতুন করে কিছু বাস নেমেছে। তবে চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম। মালিবাগ থেকে মুগদা, নগর ভবন থেকে চাঁদনী চক, বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে শনির আখড়া, মহাখালী কাঁচাবাজার থেকে গাবতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত চলাচল করত লেগুনা। এছাড়াও গুলিস্তান থেকে গোড়ান, বাসাবো মাদারটেক, মান্ডা, সিপাহীবাগ, খিলগাঁও; গুলিস্তান থেকে হাজারীবাগ, লালবাগ, চকবাজার; কামরাঙ্গীরচরের ঝাউচর থেকে নিউমার্কেট, ফার্মগেট পর্যন্তও লেগুনার চলাচল ছিল। আঁটি বাজার থেকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত লোকজনের যাতায়াতের মাধ্যম হিউম্যান হলার। ফার্মগেট থেকে মোহাম্মদপুর, মগবাজার-মহাখালী, ক্যান্টনমেন্টসহ বিভিন্ন এলাকায় চলত লেগুনা। সকাল-বিকাল এসব পয়েন্টে লাইনে দাঁড়িয়ে যাত্রীদের যাতায়াত করার দৃশ্য ছিল পুরনো। এসব এলাকায় সরাসরি কোন বাস যোগাযোগ নেই। ঢাকার ফার্মগেট থেকে ধানম-ি-জিগাতলা যাওয়ার কোন বাস নেই, রিক্সাও সরাসরি যেতে পারে না; এই পথে যাতায়াতকারীদের হিউম্যান হলারগুলোই ছিল একমাত্র ভরসা। ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া মহানগরীতে লেগুনা চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই বেশিরভাগ রুটে এসব যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। মোহাম্মদপুর থেকে গুলশান-বাড্ডা, গুলিস্তান থেকে পুরান ঢাকার লেগুনা চলাচল একেবারেই বন্ধ। পুরনো ঢাকার বেশিরভাগ রুটে বাসের চলাচল নেই। লেগুনা মালিক সমিতির লোকজন বলছেন, রেজিস্ট্রেশন ও বৈধ রুট পারমিট নিয়ে তারা গাড়ি পরিচালনা করছিলেন। আকস্মিক লেগুনা চলাচল বন্ধে ব্যাংক লোন পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা। সেই সঙ্গে বিনিয়োগের অর্থ কিভাবে উঠবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তো আছেই। সঙ্গে যোগ হয়েছে যাত্রী দুর্ভোগ। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়িতে রাজধানীতে বাসের সংখ্যা কিছুদিন ধরেই কম। তার মধ্যে লেগুনা চলাচল বন্ধ হয়ে হওয়ায় পথে নেমে মানুষকে পড়তে হয় দুর্ভোগে। বিকল্প তৈরি না করে একদিনেই হিউম্যান হলার বন্ধ করে দেয়ার পদক্ষেপে ক্ষোভ জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। ডিএমপি কমিশনার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ঢাকা শহরে কোন লেগুনা চলার কথা নয়, হিউম্যান হলার চলার কথা নয়। ঢাকা মহানগরীতে কোন ধরনের লেগুনা চলবে না অথচ ঢাকা মহানগরীতে চার হাজারের বেশি হিউম্যান হলারকে রুট পারমিট দিয়েছে যে কর্তৃপক্ষ (রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি-আরটিসি) তার প্রধান হলেন ঢাকার পুলিশ কমিশনার স্বয়ং। ঢাকার বিভিন্ন রুটে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি বা রুট পারমিট দেয় মহানগর আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি বা মেট্রো আরটিসি। ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার পদাধিকার বলে এর প্রধান। হিউম্যান হলারগুলোর ঢাকায় চলাচলের অনুমতি নেই- ডিএমপি কমিশনারের এমন বক্তব্য ঠিক নয় বলে দাবি করেছেন হাজারীবাগের ট্যানারি মোড়-নীলক্ষেত রুটের নিলয় বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক। মুগদা লেগুনা মালিক সমিতির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরাও চাই পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। কিন্তু হঠাৎ করে বৈধ পরিবহনগুলো বন্ধ করে যাত্রী দুর্ভোগ সৃষ্টি করা ঠিক হয়নি। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে সরকারের কোন গাইড লাইন থাকলে আমাদের জানাত পারত। সে অনুযায়ী আমরা যান পরিচালনা করতাম। মালিবাগে কথা হলো আশরাফের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি গত কয়েক বছর মালিবাগ থেকে মুগদা পর্যন্ত লেগুনার যাত্রী। হঠাৎ করে গাড়ি বন্ধ হওয়ায় বিপদে আছি। ২০ টাকার ভাড়ার ক্ষেত্রে এখন প্রতিদিন কমপক্ষে ২শ’ টাকা গুনতে হচ্ছে। বাসাবো বাজার এলাকার বাসিন্দা আসিফ জানালেন, সকালে লাইন ধরে লেগুনায় উঠতে হতো। তাও ছিল প্রয়োজনের তুলনায় কম। এখন তা বন্ধ হওয়ায় মহা বিপদে আছি। ব্যয় বেড়েছে অনেক। মোহাম্মদপুরে কথা হয় আলালের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রতিদিন মোহাম্মদপুর থেকে বাড্ডা পর্যন্ত লেগুনায় যাতায়াত করতাম। গাড়ি বন্ধ হওয়ায় ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাসে যেতে হয়। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে। তেমনি বেড়েছে ব্যয়ও। লেগুনা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ঠিক নয় বলে মনে করেন মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা নিরাময় সরকার। তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মানুষের দুর্ভোগ এবং খরচ বেড়েছে। মেট্রোরেলের কাজ চলমান থাকায় রোকেয়া সরণিতে সারাদিনই যানজট থাকে। ফলে আমি হিউম্যান হলার দিয়ে ৬০ ফুট সড়ক হয়ে ফার্মগেট চলে আসি। হিউম্যান হলার বন্ধ হওয়ায় আমি ফার্মগেট যাব কী করে? ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, শহরের ভেতরে লেগুনাগুলোর যে আধিক্য, সেটা আমরা কমিয়ে আনব। এটা নিয়ে কাজ শুরু করেছি। রি-এ্যারেঞ্জ করে পেরিফেরিতে নিয়ে যাব। তারা যেন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। কোন বিকল্প তৈরি না করে হিউম্যান হলার উঠিয়ে দেয়ায় মানুষের যে দুর্ভোগ হচ্ছেÑ এ প্রশ্নে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটাই, হিউম্যান হলার বন্ধ হবে। বিকল্প কী হতে পারে, ওইটা দেখা যাবে। সেটা নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনায় আছে। আমরা দেখব সেটা। কাজ শুরু করতে হবে, শুধু ট্রাবল দেখলে হবে না। কাউকে না কাউকে কাজ করতে হবে। ক্রাইসিস সব জায়গায়ই আছে, তারপরও আমাদের কাজ করে যেতে হবে। রাজধানীর যেসব সড়কে বাস চলাচল কম বা একেবারেই নেই, সেসব এলাকায় বেশিরভাগ হিউম্যান হলার চলাচল করে। মিরপুরের কালসি রোড থেকে বিভিন্ন ব্লকে, ১০ নম্বর সেকশন থেকে বিভিন্ন ব্লকে, গাবতলী থেকে মাজার রোড, মিরপুর ১৪ নম্বর থেকে ইসিবি চত্বর মাটিকাটা হয়ে বিভিন্ন এলাকায় হিউম্যান চলাচল করে। গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ী, যাত্রাবাড়ী থেকে জুরাইন, শ্যামপুর, পোস্তগোলা; যাত্রাবাড়ী থেকে ডেমরার বিভিন্ন রুটেও হিউম্যান হলার চলাচল করে। রামপুরা থেকে স্টাফ কোয়ার্টার এবং নন্দীপাড়া পর্যন্তও বেশকিছু হিউম্যান হলার চলাচল করে। উত্তরার হাউস বিল্ডিং, আজমপুর থেকে দক্ষিণখান-উত্তরখান, জসিমউদ্দিন থেকে বাউনিয়াসহ বিভিন্ন রুটে হিউম্যান হলারে যাতায়াত করে মানুষ। ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন কম বয়সী চালকদের বেপরোয়া চালানো এবং ফিটনেসবিহীন হিউম্যান হলারের কারণে দুর্ঘটনা ঘটানোর অনেক অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে জানাতে চাইলে নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, আমরা জনদুর্ভোগ চাই না। বিকল্প গণপরিবহনের ব্যবস্থা না রেখে হঠাৎ করে লেগুনা বন্ধ ঠিক হয়নি।
×