ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এ পর্যন্ত পাস আউট হয়েছে ৬৯, নতুন বের হবে আরও ১৬

মেরিন একাডেমি থেকে উত্তীর্ণ পাঁচ ব্যাচের সব নারী ক্যাডেটই বেকার!

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মেরিন একাডেমি থেকে উত্তীর্ণ পাঁচ ব্যাচের সব নারী ক্যাডেটই বেকার!

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ বিষয়টি একদিকে যেমন বিস্ময়কর তেমনি উৎকণ্ঠারও। দেশে সমুদ্রগামী জাহাজে অফিসার পদের শুরুতে নিয়োগের পূর্বে ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য চট্টগ্রামে রয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের স্বীকৃত মেরিন একাডেমি। এ একাডেমি থেকে উত্তীর্ণ ক্যাডেটরা দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জাহাজে বিভিন্ন পদে কর্মরত রয়েছেন। এ একাডেমিতে বছরের পর বছর নারী পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ভর্তির কোন সুযোগ ছিল না। ২০১২ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ ও নির্দেশে প্রথমবারের মতো এই একাডেমিতে ২০ মহিলা ক্যাডেট ভর্তির সুযোগ পায়। যা এরপর থেকে অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে উত্তীর্ণ ক্যাডেটরা সকল পর্যায়ে বৈষম্যের শিকার। এই একাডেমি থেকে এই পর্যন্ত ৫ ব্যাচে যে ৬৯ ক্যাডেট সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে বের হয়েছে তারা সকলেই বেকার জীবনে রয়েছে। বর্তমানে একাডেমিতে দুই ব্যাচে ১৬ নারী ক্যাডেট অধ্যয়নরত। এর একটি ব্যাচের ক্যাডেটদের পাসিং আউটের সময় অত্যাসন্ন। বেকার নারী ক্যাডেটদের সূত্রে অভিযোগ করা হয়েছে, তারা সরকারী- বেসরকারী পর্যায়ের জাহাজী সংস্থার কাছে দিনের পর দিন ধর্ণা দিয়েও কোন সুফল বয়ে আসেনি। একজন ক্যাডেটও গত প্রায় ছয় বছরে কোন জাহাজে যোগদানের সুযোগ পাননি। তাদের বক্তব্য, যেখানে একটি দেশে সরকারে থেকে নারী দেশ চালাচ্ছেন, সংসদ চালাচ্ছেন, বিরোধী দলের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন এবং এর পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার আমলা পদে থেকে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন, এমনকি সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীতেও নারীদের কর্মসংস্থান হচ্ছে সেখানে একজন নারী জাহাজ চালাতে পারবেন নাÑ এটা কোন যুক্তিতে বলা যাবে। আসলে নৌবাণিজ্যে জাহাজে নারীদের কর্মসংস্থানে বৈষম্যের বড় একটি বিষয় প্রোথিত হয়েছে। আর যে কারণে দক্ষতা ও সফলতা নিয়ে বেরিয়ে আসা নারী ক্যাডেটদের কেউ জাহাজে নিয়োগ পাচ্ছেন না। বেকার নারী ক্যাডেটদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, মূলত নারীদের জন্য এদেশে সবকিছু খুব একটা সহজ না। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বাধার ওই দেয়াল উপড়ে ফেলেছেন। যে কারণে দেশে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে নারীদের অবস্থান এখন দৃশ্যমান। এরপরও কোথাও কোথাও এখনও বাধার দেয়াল রয়ে গেছে। যার একটি হচ্ছে জাহাজে নারীদের কর্মসংস্থানের বিষয়টি। নারী ক্যাডেটদের পক্ষে জানানো হয়, মেরিন একাডেমি থেকে পাস আউটের পর প্রত্যেককে সিডিসি (কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট) নিতে হয় শিপিং অফিস থেকে। যা কিনা বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি থেকে পাসকৃত সকল ক্যাডেটদের জন্যও প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে নারী হিসেবে ক্যাডেটগণ প্রথম বৈষম্যের শিকার হয় ২০১৪ সালে। শুরু হয় নতুন এক সংগ্রাম। নানা বাধা বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে অবশেষে সফলতা আসে। অর্থাৎ সিডিসি মিলে। কিন্তু সিডিসি পেলে কি হবে, কোন জাহাজ কোম্পানি সেটা সরকার বা বেসরকারী কেউ তাদের নিয়োগ দিতে আগ্রহী নয়। তাদের সকল যোগ্যতা রয়েছে এবং তা সরকারীভাবে স্বীকৃত। অযোগ্যতা একটিই- তা হচ্ছে নারী। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্নভাবে আলোচিত হওয়ার পর বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) এ বিষয়ে এগিয়ে আসে। এখানেও নেমে আসে জটিলতা। বিএসসি কিছু নারী ক্যাডেটকে অফিসার পদে নিয়োগ দেয়। কিন্তু বিনা বেতনে। অন্য সকল পর্যায় থেকে এসব নারী ক্যাডেটরা প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিএসসির সদয় বিবেচনাটি ছিল তাদের জন্য সোনার হরিণের মতো। এক বছর সমুদ্রগামী জাহাজে প্রশিক্ষণ সম্পন্নের পর বাংলাদেশ সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের অধীনে পরবর্তীতে পদোন্নতির পরীক্ষায় (সিওসি ক্লাস-থ্রি) অংশগ্রহণ করতে হয়, যেখানে প্রত্যেককে খরচ করতে হয়েছে ৩ লাখ টাকা হারে। কিন্তু বিপরীতে এক টাকাও তাদের আয় হয়নি। এরপরও নারী ক্যাডেটরা তাদের স্বপ্ন পূরণের অদম্য ইচ্ছা নিয়েই কর্মসংস্থানে অটল রয়েছে। ২০১৬ সালে মেরিন একাডেমি থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার পর নারী ক্যাডেটরা যেখানে বেকারত্বের জীবনে আছেন সেখানে একই ব্যাচে পুরুষ ক্যাডেটরা দেশী-বিদেশী বিভিন্ন জাহাজে কর্মজীবনে প্রবেশ করে ক্রমাগতভাবে উপরের সিঁড়িতে চলে যাচ্ছেন। ২০১২ থেকে বর্তমান ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই সাত বছরে কোন নারী ক্যাডেট কোথাও কর্মে নিয়োগ পাননি। ২০১৭ সালের ১৫ এপ্রিল ঢাকায় বিএসসির নবনির্মিত ভবন উদ্বোধনকালে নারী ক্যাডেটদের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে আশ্বাসও দেন। কিন্তু সমাধান এখন সুদূরপরাহত। বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে এসব নারী ক্যাডেটদের পক্ষে ধর্নার পর ধর্না দিতে হয়েছে। মন্ত্রী একবার আশ্বাস প্রদান করেন বিএসসির নতুন জাহাজে নারীদের কর্মসংস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। সে আশায় তারা বুক বেঁধে রয়েছেন। ইতোমধ্যে বিএসসির বহরে নতুন একটি জাহাজ যুক্ত হয়েছে। কিন্তু নারী অফিসার নিয়োগ নিয়ে কোন ইঙ্গিত এখনও মেলেনি। বিষয়টি মেরিন একাডেমি থেকে উত্তীর্ণ হয়ে বেকার জীবনে থাকা নারীদের জন্য নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
×