ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

তাড়াশে তাল সড়ক

বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা দেয়- বেড়ে ওঠে পরিচর্যা ছাড়াই

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা দেয়- বেড়ে ওঠে পরিচর্যা ছাড়াই

বাবু ইসলাম ॥ ঐ দেখা যায় তালগাছ, ঐ আমাদের গাঁ, ঐ খানেতে বাস করে কানা বগির ছা... কবি খান মুহাম্মদ মইনুদ্দীনের এই কবিতা এখন অনেকেই ভুলতে বসেছেন। ছোটবেলায় এই কবিতা পড়েননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই তালগাছ এখন গ্রামে গ্রামে নতুন করে রোপণ শুরু হয়েছে। বজ্রপাতে মানুষের জানমালের ক্ষতির কবল থেকে রক্ষায় তালগাছ রোপণ করা হচ্ছে। বৃহত্তর চলনবিলের সিরাজগঞ্জের তাড়াশে রাস্তার দুই ধারে সারি সারি তালগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ পানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি তালগাছ, গাছে গাছে ধরা তালফল ও বাবুই পাখির ঝুলন্ত মনোরম বাসা। তাল আমাদের পরিচিত একটি ফল। গ্রামবাংলায় আবহমান কাল থেকে পরিচিত এই ফলটির কদর রয়েছে। বিভিন্ন প্রকারের খাবার তৈরি করা যায় তাল দিয়ে। তাল খুব সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। তালগাছের বৈজ্ঞানিক নাম ইড়ৎধংংঁং ভষধনবষষরভবৎ। তালগাছ ৩০ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এই গাছ কম-বেশি ১০০ বছর বাঁচে। তাল শুধু ফল হিসেবে নয়, পাকা তাল খাওয়ার পর উচ্ছিষ্ট আঁটিটা রেখে দিলে কিছুদিন পর আঁটির ভেতরে যে সাদা শাঁস হয়, তা খাওয়া যায় রান্না করে তরকারি হিসেবে। সাদা শাঁস কাঁচা খেতেও ভারি মজার। গুরুত্বের কারণেই তালগাছ স্থান পেয়েছে কবিতায়, উপন্যাসে, কথায়, উপমায়, প্রবাদ বাক্যে। তালপাতার সেপাই, এক তাল, তাল বেতাল, তিল থেকে তাল, পিঠে তাল পড়া এমন অনেক উপমা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাংলা সাহিত্যে। গ্রামবাংলায় পরিত্যক্ত জমিতে, বনে-বাদাড়ে আঁটি পড়ে থাকলে সেই আঁটি থেকে কোন পরিচর্যা ছাড়াই তালগাছ জন্মে এবং বেড়ে ওঠে। আবার বীজতলা তৈরি করেও তালগাছ জন্মানো যায়। তালগাছ বড় করে তোলার জন্য বিশেষ পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। তালগাছ কিন্তু দীর্ঘজীবী। পৃথিবীর বহু দেশে তালগাছ আছে। গাছটি তার দীর্ঘজীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই ফল দেয়। শুধু ফল নয়, তালের রস অত্যন্ত উপাদেয় এবং সুস্বাদু। এই রস কাঁচা খাওয়া যায় আবার রস জ্বালিয়ে গুড় বা গুড়ের পাটালি তৈরি করা যায়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তালের রস উৎপাদন হয়। গ্রামবাংলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পরিবেশবান্ধব তালগাছ। একসময়ে তালগাছ ছিল গ্রামবাংলার সৌন্দর্যের প্রতীক। গ্রামীণ অর্থনীতিতেও তালগাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কাঁচা ফল হিসেবে খাওয়ার জন্য কচি তালই উপযুক্ত। বছরে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের গরমে কচি তাল পাওয়া যায়। তখন বাজারে বেশ দামে পানি-তাল বিক্রি হয়। গ্রামের ঘর তৈরিতে বিশেষ করে গ্রামের গরিবের এসিখ্যাত মাটির ঘর তৈরিতে তালগাছ ছিল অতুলনীয়। কালের আবর্তে তালগাছের অস্তিত্ব আজ অনেকটাই সঙ্কটে পড়েছে। এখন গ্রামাঞ্চলে আগের মতো তালগাছ চোখে পড়ে না। তবে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা সদরে তালগাছ চোখে পড়ে। সড়কে দুই ধারে সারি সারি তালগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শাহজাদপুরে তালগাছের আধিক্য থাকায় উপজেলার একটি এলাকার নামকরণ করা হয়েছে তালগাছি। তালগাছের একটি বৈশিষ্ট্য এর কোন শাখা-প্রশাখা নেই, আলো বাতাস প্রবাহে বাধা প্রদান করে না। তাই আবাদযোগ্য জমির ধারে (আইলে) তালগাছ রোপণ করা যায়। আমাদের দেশে বড় লম্বা গাছগুলোর মধ্যে তালগাছ অন্যতম। চমৎকার পত্রপল্লব বিশিষ্ট এই তালগাছ বাবুই পাখির প্রধানতম আশ্রয়স্থল। শক্ত বুননের এ বাসাটি শিল্পের এক ঐশ্বর্য, যা প্রবল ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও ঝুলতে থাকে তালের পাতার সঙ্গে। বাবুই ছাড়াও অঞ্জন, বাদুড়সহ নানা প্রাণী আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয় তালগাছকে। ‘তালের পাখার এমনই গুণ, বাতাস খেলে আসবে ঘুম’Ñ ছড়ার এই বাক্যটির মাধ্যমে বোঝা যায় গ্রামবাংলায় তালের পাখা কতটা প্রিয়। তালগাছের পাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরি হয় যা গ্রামের মানুষের গরম থেকে রক্ষার একমাত্র বাহন। আর পাতার শিরা দিয়ে সুন্দর টুপি তৈরি করা হয়। আগের দিনে তালগাছে শত শত বাবুই পাখি বাসা বাঁধত। পূর্ণ বয়স্ক একটি তালগাছ ৭০ থেকে ৮০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। তালগাছ ৯০ থেকে ১২০ বছর বা তার চেয়ে বেশি বছর বেঁচে থাকে। তালগাছের কাঠ অত্যন্ত মজবুত। এজন্য কথায় আছে ‘যদি পাকে তালগাছ, এক এক যুগ দেখে এক এক বাত।’ তালগাছের কাঠ দিয়ে ঘরে খুঁটি ছাড়াও নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া গ্রামের ঐতিহ্য বর্ষাকালে ডিঙ্গি নৌকা তৈরি করা যায়। তালগাছকে ওয়াটার প্রফ গাছ বলা হয়। তালগাছ স্ত্রী-পুরুষ দুই জাতের হয়। পুরুষ গাছ কোন ফল দেয় না তবে এর আছে মিষ্টি সুস্বাদু উপকারী রস আর স্ত্রী জাতের গাছ তাল দিয়ে থাকে ভাদ্র মাসে তাল পাকে গ্রামে তালের তৈরি পিঠা খেতে ভারি মজা লাগে অবশ্য কাঁচা তালের শাঁস খেতেও মজা লাগে। এ ছাড়াও বজ্র থেকে রক্ষা পেতে তালগাছের বিকল্প নেই। পরিবেশ ও অর্থনৈতিক দিক থেকে তালগাছ খুব লাভজনক বৃক্ষ। তাই সবাইকেই বেশি বেশি তালগাছ রোপণ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে তাড়াশ উপজেলা বন কর্মকর্তা মোঃ মুসলেম উদ্দিন বলেন, তালগাছের মতো উপকারী দ্বিতীয় কোন গাছ নেই। যা শুধু রোপণ করলেই হয় আলাদাভাবে এর জন্য কোন শ্রম বা ব্যয় করতে হয় না।
×