ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিস্তার বন্যায় বাঁধ ও সড়কে ধস

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

তিস্তার বন্যায় বাঁধ ও সড়কে ধস

স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী ॥ গর্জে ওঠা তিস্তা নদীর পানি মঙ্গলবার সকাল ৯টায় বিপদসীমার দুই সেন্টিমিটার নিচে নেমে এসেছে। ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে সোমবার সন্ধ্যা ৬টার পর দফায় দফায় বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৫২ দশমিক ৬০ মিটার অতিক্রম করে রাত ১১টা পর্যন্ত দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার (৫২ দশমিক ৮০ মিটার) ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। বিষয়টি নিশ্চিত করেন ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল আলম চৌধুরী। তিনি জানান, উজানের ঢল কমে আসায় পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। তবে সতর্কতায় তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। এদিকে উজানের ঢলে ভারি বর্ষণে তিস্তা নদীর এই ভয়াবহ বন্যায় বিভিন্ন এলাকার বসতভিটায় বানের পানি প্রবেশ করে। এ ছাড়া ক্ষতির সম্মুখীন হয় বাঁধ ও এ্যাপ্রোচ সড়ক। এলাকাবাসী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানায়, সোমবার সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে নদীর পানি বাড়তে শুরু করে। নদীর পানি ক্ষণে ক্ষণে বাড়তে থাকলে ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী, গয়াবাড়ি, জলঢাকা উপজেলার, গোলমু-া, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের তিস্তা নদী বেষ্টিত প্রায় ১৫টি চর গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়ে। ডিমলা উপজেলার খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের দোহলপাড়ায় তিস্তা নদীর ডান তীরের চার নম্বর স্পারবাঁধের সামনের এ্যাপ্রোচ সড়কের ১০মিটার নদীতে বিলীন হয়েছে।একই উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের পূর্বখড়িবাড়ি ও দক্ষিণখড়িবাড়ি মৌজায় পানি প্রবেশ করে। রাতে আকস্মিক পানি আসায় ওই দুই গ্রামের সহ¯্রাধিক পরিবার পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতিতে নির্ঘুম রাত কাটায়। পানির তোড়ে পূর্বখড়িবাড়ি গ্রামে স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত দুই কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধটির ৪০০ মিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে খালিশাচাঁপানী ইউনিয়নের বাইশপুকুর গ্রামের স্কুল শিক্ষক বিপুল চন্দ্র সেন বলেন, সন্ধ্যার পর থেকে আকস্মিক নদীর পানি বাড়তে শুরু করে। ক্রমাগত পানি বাড়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে গ্রামে বসবাসরত ৩শ’ পরিবারের মাঝে। এ সময় স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাঁধটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাত ১২টার পর থেকে পানি কমতে শুরু করলেও রাত জেগে বাঁধের ক্ষতি হওয়া এলাকা সংস্কারের কাজ করতে হয়েছে গ্রামের মানুষকে। একই অবস্থা ঝুনাগাছ চাঁপানী ইউনিয়নের পূর্ব ছাতুনামা চরে। সেখানে মঙ্গলবার দেখা যায় নদীর পানি উপচে হু-হু করে প্রবেশ করে ঘরবাড়ি ডুবিয়ে দিচ্ছে। উপজেলার পূর্বছাতনাই ইউনিয়নের ঝাড়সিংহেশ্বর ও পূর্বছাতনাই গ্রামের ৫ শতাধিক বসতঘরে বন্যার পানি প্রবেশ করে। বন্যাকবলিত মানুষজন গবাদিপশু ও আসবাবপত্রসহ তিস্তা নদীর ডান তীর বাঁধ ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। অপরদিকে জেলার জলঢাকা উপজেলার ডাইয়াবাড়ি, গোলমু-া, শৈলমারী, কৈমারী ইউনিয়নের চরবেষ্টিত গ্রামগুলোতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে বলে জানা গেছে। নুরু মিয়ার আর্তনাদ ॥ ষাটোর্ধ নুরুল ইসলাম শেখ। এলাকার সকলে তাকে নুরু মিয়া বলেই ডাকে। দুচোখ দিয়ে তার গড়িয়ে পড়ছে পানি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। এগিয়ে গিয়ে কথা বলতেই হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। তার বুকফাটা আহাজারী ১৫ বিঘা আমন ধানের ক্ষেত তিস্তার ঢলের সঙ্গে মাটিচাপা পড়ে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এবার তার বাড়ির উঠানে আর আমন ধান উঠবে না। ফসল ও ফসলি জমি হারিয়ে বুকফাটা আর্তনাদে নুরু মিয়া বলেন আমার তিন ছেলে। ৭ বছর বয়সে একটি মাত্র মেয়েকে হারিয়েছি। আজ তিন ছেলের মধ্যে যদি এক ছেলে মারা যেত তাতে এত কষ্ট পেতাম না। পৃথিবীতে জন্ম নিলে একদিন মরতেই হবে। আর বেঁচে থাকলে কর্ম করে ফসল ফলিয়ে খেয়ে বাঁচতে হবে। তিস্তা আমার সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। এখন কি নিয়ে বাঁচব। ভিটে ছাড়া আর হাতে কিছুই রইল না। স্ত্রী জহুরা বেগম বেশ কয়েকবার সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিল। তিন ছেলেরে কইছে শহরে গিয়া কামকাজ খুঁইজ্জ্যা সংসার চালন লাগব। তোগো আর কিছুই দিবার পারলাম না। তিস্তা আমাগো পথের ফকির বানাই দিয়া গেল। উজান হতে নেমে আসা ঢলে শোঁ-শোঁ শব্দের দুর্বারগতিতে কাঁপিয়ে তুলে ভাটির দিকে ধাবিত হচ্ছিল তিস্তা নদীর পানি। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের তিস্তা নদীর ওপারে চরখড়িবাড়ি মৌজার পূর্বখড়িবাড়ি চরগ্রাম। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে এখানের তিস্তা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ষাটোর্ধ নুরুল ইসলাম শেখ এই কথাগুলো বলছিলেন। নদীর দিকে বার বার চেয়ে দেখছিলেন হারিয়ে যাওয়া ফসলি জমি। কথা বলা শেষে তিনি বলছিলেন আত্মহত্যা মহাপাপ। তা না হলে ফসলি জমির মতো আমিও তিস্তায় হারিয়ে যেতাম। আল্লাহ রহমত করো জোরে হাঁক দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি হন হন করে হাঁটা ধরলেন বাড়ির পথে। লালমনিরহাটে চরাঞ্চল প্লাবিত নিজস্ব সংবাদদাতা, লালমনিরহাট থেকে জানান, ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় লালমনিরহাটের তিস্তা ও ধরলার অববাহিকার চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। আকস্মিক সৃষ্ট বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে চরাঞ্চলের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। সোমবার রাত ৯টায় তিস্তা ব্যারাজের দোয়ানী পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার, যা বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপরে হলে মঙ্গলবার সকালে পানি কিছুটা কমে বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারত তাদের গজলডোবা ব্যারাজের অধিকাংশ গেট খুলে দেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন পাউবো কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, প্রচ- গতিতে পানি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। আরও কী পরিমাণ পানি আসবে তা ধারণা করা যাচ্ছে না। হাতীবান্ধা উপজেলার ধুবনী গ্রামের অস্থায়ী বাঁধগুলোও হুমকির মুখে পড়েছে। এ বাঁধগুলো ভেঙে গেলে তিস্তার পানি হাতীবান্ধা শহরে ঢুকে পড়তে পারে। আদিতমারী উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংস্কার না করায় হুমকির মধ্যে পড়েছে মহিষখোঁচা ও সদরের খুনিয়াগাছ বাগডোরা অংশও। ইতোমধ্যে চর এলাকাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে গেছে। কুড়িগ্রামে পানির নিচে ২০ ইউনিয়ন স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম থেকে জানান, ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমারসহ প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০টি ইউনিয়নের অর্ধশত চর গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এক হাজার পরিবারের ৫ হাজার মানুষ। মঙ্গলবার সকালে সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের মাস্টারের হাট এলাকায় বন্যার পানিতে ডুবে আব্দুস ছাত্তার নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ধরলায় ১২৩ সে.মি. ব্রহ্মপুত্রে ৭ সে.মি. ও দুধকুমারে ২০ সে.মি. ও তিস্তায় ৩৮ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। ধরলা নদীর অববাহিকার হলোখানা, ভোগডাঙা, মোঘলবাসা, বড়ভিটা, শিমুলবাড়ি, বেগমগঞ্জ, পাঁচগাছিসহ ২০টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। এসব এলাকার ৫ শতাধিক হেক্টর আমন ক্ষেতসহ সবজি, পাট, কলাসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত নিমজ্জিত হয়েছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সদর উপজেলার সারোডাব, মোঘলবাসা, যাত্রাপুর, ভোগডাঙা, উলিপুরের থেতরাই, চিলমারীর জোড়গাছ কয়েকটি এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙ্গন। সারোডোব এলাকায় ধরলার তীব্র ভাঙ্গনে ২৪ ঘণ্টায় ৫টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে আরো ২০-২৫টি পরিবার। তিস্তার ভাঙ্গনে উলিপুরের নাগরাকুড়া টি-বাঁধে ধস দেখা দিয়েছে এবং হোকডাঙা গ্রামটি বিলীনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
×