ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আজ বসছে পোশাক শিল্পের ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের পঞ্চম সভা

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আজ বসছে পোশাক শিল্পের ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের পঞ্চম সভা

রহিম শেখ ॥ মালিক ও শ্রমিকপক্ষ একমত না হওয়ায় এখনও চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কাঠামো। মালিকপক্ষ একজন গার্মেন্টস শ্রমিককে সর্বনিম্ন বেতন দিতে চায় ৬ হাজার ৩৬০ টাকা। এদিকে শ্রমিকদের একটি অংশ এই মুহূর্তে দাবি করেছে ১২ হাজার ২০ টাকা। অন্যটি ১৬ হাজারে অনড়। মালিকরা শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে রাজি না হওয়ায় এ নিয়ে এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এই জট খুলতে আজ বুধবার বসছে ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের পঞ্চম বৈঠক। এরপর আগামী ১৭ অক্টোবর সরকারের কাছে চূড়ান্ত প্রস্তাব পাঠাবে বোর্ড। বোর্ডের সুপারিশ পাওয়ার পর সরকার সেটি চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করবে। পরে তা উঠবে শ্রম মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ে। এসব কিছু চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত করে মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন করতে হবে। এরপর আগামী ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ন্যূনতম মজুরি কার্যকর করতে হবে। জানা গেছে, ২০১৩ সালে গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি যেখানে প্রায় শতভাগ বাড়ানো হয়েছিল। বর্তমানে ন্যূনতম মজুরি পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। সেই হিসেবে তাদের প্রস্তাব মতো অর্থাৎ মালিকপক্ষ দিতে চায় ৬ হাজার ৩৬০ টাকা, যা মাত্র ১৯ শতাংশের কিছু বেশি। এ লক্ষ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নতুন করে নির্ধারণের জন্য একটি মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি মাসিক ১৬ হাজার টাকার পরিবর্তে ৬ হাজার ৩৬০ টাকা দিতে চায় মালিকরা। মজুরি বোর্ডের তৃতীয় সভায় এ প্রস্তাব করেন গার্মেন্টস মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। এদিকে শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে যখন ব্যবধান বিস্তর তখন বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় শ্রমিক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার ভূঁইয়া ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ২০ টাকা করার প্রস্তাব দেন। তবে শামসুন্নাহার ভূইয়ার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনে থাকা শ্রমিক সংগঠনগুলো। ফলে নতুন করে জটিলতা তৈরি হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য লীগের সভাপতি সিরজুল ইসলাম রনি বলেন, আমাদের দাবি ছিল ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা। যিনি শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে ১২ হাজার ২০ টাকা মজুরি প্রস্তাব করেছেন, তা-ও আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না। কারণ তিনি সরকারের লোক। আর শ্রমিক নেতা হিসেবে তিনি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নন। আর মালিকরা যে মজুরি প্রস্তব করেছেন, সেটা হাস্যকর। কারণ পাঁচ বছর আগে যে ৫ হাজার ৩০০ টাকা মজুরি করা হয়েছিল, শ্রমিকরা এখন তার চেয়ে বেশি পান। কারণ ইনক্রিমেন্ট হয়েছে, যেটা মালিকরা প্রস্তাব করেছেন, সেই মজুরি এখন বাস্তব মজুরির চেয়ে কম। জানা যায়, গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকদের জন্য মজুরি কাঠামো নির্ধারণে সরকার গঠিত মজুরি বোর্ডের চতুর্থ বৈঠকে মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বিভিন্ন গ্রেডে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ মজুরি বাড়ানোর কথা জানায়। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তা নাকচ করে দেয় গার্মেন্ট শ্রমিকদের কয়েকটি সংগঠন। আজ বুধবার রাজধানীর তোপখানা রোডে ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পঞ্চম সভা। এতে বোর্ডের চেয়ারম্যান সিনিয়র জেলা জজ সৈয়দ আমিনুল ইসলাম, মালিক পক্ষের প্রতিনিধি, শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি ও নিরপেক্ষ প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। এদিকে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ চূড়ান্ত করতে হবে, যা আগামী ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কাঠামো ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে। এর আগে মজুরি নির্ধারণে ১৭ অক্টোবর বোর্ড থেকে সরকারের কাছে চূড়ান্ত প্রস্তাব পাঠানো হবে। এরপর মালিক ও শ্রমিক পক্ষের ওই প্রস্তাব পর্যালোচনা করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে মজুরি বোর্ড। পরে তা উঠবে শ্রম মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ে। বোর্ডের সুপারিশ পাওয়ার পর সরকার সেটি চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করবে এবং এর পরই তা কার্যকর করা হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, দুই পক্ষের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তিনি জানান, সর্বনিম্ন মজুরি ঘোষণার আগে নিয়ম অনুযায়ী কিছু কারখানা সরেজমিন ঘুরে দেখবেন মজুরি বোর্ডের সদস্যরা। আগামী তিন মাসের মধ্যে মজুরির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবে বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, কোনও জটিলতা সৃষ্টি হয়নি। সমাধান হয়ে যাবে। সুপারিশ প্রণয়নে এখনও হাতে সময় আছে। এ সুপারিশ ১ জানুয়ারি ২০১৯ থেকে কার্যকর করতে হবে। তাই সবার আলোচনার ভিত্তিতেই একটি সুন্দর সমাধান হবে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নাই। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা মূল্যস্ফীতি, উৎপাদন খরচ এবং বিশ্বে তৈরি পোশাকের দাম ও চাহিদা বিবেচনা করে ন্যূনতম মজুরি ৬ হাজার ৩৬০ টাকার প্রস্তাব করেছি। আমাদের উৎপাদনসহ অন্যান্য খরচ বেড়ে গেছে। এর বেশি মজুরি দিলে পোশাক কারখানা চালানো সম্ভব নয়। বন্ধ হয়ে যাবে। আর তাতে সবার ক্ষতি হবে। তিনি আরও বলেন, যাদের জন্য ন্যূনতম মজুরির কথা বলা হচ্ছে, তারা শিক্ষানবিস। তারা কাজ শেখে। পরে তাদের বেতন বেড়ে যায়। শিক্ষানবিসকে এর চেয়ে কে বেশি বেতন দেবে? শিক্ষানবিসরা ইনক্রিমেন্ট পান না। যারা বলেন ইনক্রিমেন্ট পেয়ে ৫ বছরে তাদের বেতন এখন আমাদের প্রস্তাবিত বেতনের চেয়ে বেশি, তারা না জেনেই কথা বলছেন। নিট গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি সেলিম ওসমান জনকণ্ঠকে বলেন, এ সরকার শ্রমিকবান্ধব। গত ১০ বছরে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি সেটা প্রমাণ করে। পোশাক মালিকরাও মজুরি বাড়ানোর পক্ষে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে মজুরি বাড়ানোর আগে মুনাফার বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা আছে, তার ওপর হঠাৎ হঠাৎ দাম বাড়ানো হচ্ছে। জ্বালানি তেলের কারণে পরিবহন খরচ বেড়েছে। ক্রেতারা পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে না। এ বিষয় বিবেচনা করতে হবে। বর্তমানে মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে মালিকরা আতঙ্কিত। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ১ ডিসেম্বর তিন হাজার টাকা মূল বেতন ধরে পোশাক শ্রমিকদের সর্বশেষ ৫ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে সরকার। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ওই বেতন পেতে শুরু করেন শ্রমিকরা। এরপর গত ১৪ জানুয়ারি, শ্রম মন্ত্রণালয় স্থায়ী মজুরি বোর্ড পুনর্গঠন করে। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন বোর্ড গঠনের আগে থেকেই ১০ হাজার টাকা মূল বেতন ধরে মোট ১৬ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলন করে আসছে।
×