ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জয় বাংলার কারণেই এত ভালবাসা, এত স্নেহ মায়া

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

জয় বাংলার কারণেই এত ভালবাসা, এত স্নেহ মায়া

মোরসালিন মিজান ॥ সেই শিশুমুখের হাসিটি নিয়ে উপস্থিত হলেন শাহাবুদ্দিন। জয় বাংলার লোক। তার শিল্পভাষায় কথা বলে বাংলাদেশ। বিদেশেও বিপুলভাবে সমাদৃত। খ্যাতির শীর্ষে। এরপরও ভেতরে যে সরলতা, যে কুসুম কোমল হৃদয়খানী, স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। বাইরে থেকে অনুভব করা যায়। মঙ্গলবার আরও বেশি অনুভব করা গেল। আরও বেশি আপন, আরও বেশি কাছের মানুষটি হয়ে এদিন শিল্পকলা একাডেমিতে এসেছিলেন তিনি। তারও আগে থেকে প্রস্তুত ছিল জাতীয় নাট্যশালার বিশাল মিলনায়তন। এত বড় মিলনায়তনে সাধারণত যে ধরনের আয়োজন হয়, তেমন কিছু ছিল না। বরং জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতা। আর কারও নয়, শিল্পী শাহাবুদ্দিনের জন্মদিন। ’৬৯তম জন্মদিনে মুক্তিযোদ্ধা শিল্পীকে ফুলে ফুলে ভরিয়ে দেন ভক্ত-অনুরাগী-বন্ধু-সুহৃদরা। বিপরীতে আর কী দেবেন তিনি? ওই হাসিটি উপহার দিলেন। জানালেন, বঙ্গবন্ধু বলেই বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশ বলেই আজকের তিনি। শরতের সন্ধ্যায় বর্ণাঢ্য এই জন্মোৎসবের আয়োজন করা হয়। তারও আগে থেকে শিল্পীরা আসছিলেন। বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা গাড়ি থেকে একে একে নামছিলেন। সবার হাতেই ফুল। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি¯œাত কাঁচা ফুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। মিলনায়তনের সিঁড়ি, সামনের খোলা জায়গা চমৎকার সাজিয়ে নেয়া হয়েছিল। এখানে ওখানে স্থাপন করা হয়েছিল শিল্পীর প্রতিকৃতি। এর কিছু সময় পরই আয়োজনকে পূর্ণতা দিতে উপস্থিত হন শিল্পী। সঙ্গে সঙ্গে বাদ্য বাজনা বেজে ওঠে। লোকজ সুর আর দলীয় নৃত্যের ছন্দে বরণ করে নেয়া হয় তাকে। দেখতে দেখতে শিল্পীকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেন গুণমুগ্ধরা। পাশাপাশি ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে বৃত্ত তৈরি করেন। বৃত্তের ভেতরে আটকে ফেলেন শাহাবুদ্দিনকে। এমন ভালবাসার বৃত্ত কেউ কি ভাঙতে পারে? চায়? অগত্যা দলবল নিয়েই সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে থাকেন বার্থডে বয়। ততক্ষণে সুগন্ধী ফুলের মালা গলায় পরিয়ে দেয়া হয়েছে। সুযোগ পেলেই হাতে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। মিলনায়তনের বাইরের অংশে সেল্ফ পোরট্রেইট। শাহাবুদ্দিনের নিজের আঁকা প্রতিকৃতির নিচে গাঁদা ফুলের পাপড়ি বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। ছোট ছোট প্রদীপে মিষ্টি আলো। যত দেখেন ততই অভিভূত হন শিল্পী। লবিতে প্রবেশ করার পর যেন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলেন না। এখানে বহুবিধ আয়োজন। হাতের বাম পাশে মস্তবড় পিয়ানো স্থাপন করা হয়েছে। সেখান থেকে হৃদয় ছোঁয়া সুর ভেসে আসছে। একটু এগোলে আলোকচিত্রে সাজানো অঙ্গন। আবু তাহেরসহ কয়েকজন আলোকচিত্রীর ছবিতে শাহাবুদ্দিন দৃশ্যমান। কখনও ঢাকার বাসায় রংয়ে লেপ্টে থাকা মুখ, কখনও প্যারিসের স্টুডিওতে। ফেলে আসা গ্রামের সঙ্গেও সখ্য তার। কোন কোন ছবিতে লাঙল হাতে দেখা যায় শাহাবুদ্দিনকে। ছবি দেখে দেখে নিজেই ক্যাপশন বলে দিচ্ছিলেন! ডান পাশে আবার চিত্রকর্ম। বেশ কয়েকজন অনুজ অগ্রজকে এঁকেছেন। কম সময় নিয়ে আঁকা। তবুও পেইন্টিং ড্রইং দেখে মন ভরে যায়। যাকে আঁকা, তিনিও আপ্লুত। এত প্রেম। উজার করা ভালবাসা। জবাবে কী বলবেন শাহাবুদ্দিন? শোনার জন্য অপেক্ষা করে ছিলেন সাংবাদিকরা। জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে কাছে এলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা শিল্পীর মুখে জয় বাংলা শোনার, আহ, কী আনন্দ! কিছু জানতে চাওয়ার আগেই শাহাবুদ্দিন বললেন, ‘নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবা, জন্মদিনে অনুভূতি কী আমার? অমনি হেসে ওঠলেন সবাই। সাংবাদিকরা এভাবে শুরু করেছিলেন, আজ আপনার জন্মদিন...। কিন্তু কথা শেষ করতে পারলেন না। পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলেন, আজ আমাদের জন্মদিন। হ্যাঁ, এমনই ছিল পরিবেশটা। আবেঘন পরিবেশে শিল্পী বললেন, ‘আমি খুবই আনন্দিত। উৎফুল্ল। কতটা? না, ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।’ এর পর আবারও জয় বাংলায় ফিরে গেলেন। বললেন, ‘আসলে জয় বাংলার কারণেই আমার এই ভালবাসা এই ¯েœহ মায়া পাওয়া হয়েছে। জয় বাংলার কারণেই পেয়েছি। এর চেয়ে বড় উপহার মনে হয় পৃথিবীর কম শিল্পীই পেয়েছেন।’ একাত্তরের জয় বাংলা এখন উন্নয়নশীল বাংলাদেশ। সামনে কী আশা করেন? জনকণ্ঠের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলে শিল্পী বলেন, ‘বাংলাদেশ শান্তির হবে। আমরা আরও উন্নত হব। এটা একদম আমি আগাগোড়াই ভাবছি। ভাবনাটি আরও প্রখর হচ্ছে দিনে দিনে।’ এ জন্য বাঙালীর ঐক্য ধরে রাখা জরুরী বলে মত দেন তিনি। সকলের প্রতি আন্তরিক আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘নিজেদের মাঝে যেন আমরা একত্রিত থাকতে পারি, যেমন একাত্তরে এক হয়েছিলাম।’ ঐক্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাঙালী ও জয় বাংলাÑ এ দুই জিনিস অন্তরে রাখতে হবে। কারণ বাংলাদেশের ভাষা, ছবি আঁকা, সাহিত্য, কবিতা নাটকÑ সবই তো স্বাধীন হওয়ার পর পৃথিবীতে ভেসে উঠেছে। এবং এগুলোই আমাদের সম্পদ।’ শাহাবুদ্দিনের মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা শুনলেই নয়। কী যেন অপূর্ণ থেকে যায়। এই প্রতিবেদক দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই দারুণ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন শিল্পী। বললেন, ‘আমি কিন্তু ধর, কারও কথা না ভাবলেও, সারাক্ষণ বঙ্গবন্ধুর কথা ভাবি। উনি, মনে হয় তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। সবকিছুই বঙ্গবন্ধুর কারণে হয়েছে।’ পুরনো আক্ষেপও শোনা যায় কণ্ঠে। বলেন, ‘মনে হয় না কোনদিন আর উনার (বঙ্গবন্ধু) শূন্যতা বা অনুপস্থিতি পূরণ হবে!’ মহান নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে নিজের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘আমরা, বিশেষ করে আমি উনার অগাধ ভালবাসা ¯েœহ পেয়েছি। উনার যে স্পিরিট, ওইটা আমি বহন করতে চেষ্টা করি। এবং এই ভালবাসা মনে হয় যে, আরও অনেক দূর নিয়ে যাবে আমাকে।’ আপনি এক হাতে তুলি ধরেছেন। অন্য হাতে অস্ত্র। কিন্তু বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পী ও শিল্প চর্চার স্বরূপটি কেমন দেখেন? এখনকার শিল্পীরা কতটা প্রতিবাদী চেতনার? জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখনকার শিল্পীদের মাঝে প্রতিবাদী চেতনা আছে। ওইভাবে হয়ত দেখা যায় না। বোঝা যায় যে, এখানে কোথায় যেন গরম হাওয়া আছে। যেটা অন্য দেশে নাই।’ এটাও স্বাধীনতার কারণে হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। শিল্প শহর প্যারিসে দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশকে তুলে ধরছেন আপনি। কতটা হলো? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এখন ওরা আমাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। বিশেষ করে আগে যে বন্যা দুর্ভিক্ষ মানুষ মারা যাওয়ার খবর নিয়ে কথা হতো, এইটা আর দেখা যায় না। কিছুদিন আগে, বাংলাদেশের স্যাটেলাইট গেছে না? সবাই অবাক। কেউ কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। এভাবে বাংলাদেশ নিয়ে এখন নেগেটিভ নিউজ আর দেখি না।’ চিত্রকলার আলোচনায় ফিরে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চিত্রকলা সম্পর্কে অনেককিছু জেনে গেছে ওরা। আগে ভাবত, আমি একাই বুঝি ছবি আঁকি। এখন জানে, বহু শিল্পী আঁকে বাংলাদেশে।’ নাতিদীর্ঘ আলাপচারিতা শেষ করে মূল মিলনায়তনে প্রবেশ করেন তিনি। ততক্ষণে প্রতিটি আসন পূর্ণ। প্রিয়জনদের সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে এগিয়ে যান শাহাবুদ্দিন। ঘনিষ্ঠদের জড়িয়ে ধরেন। তার পর মঞ্চে গিয়ে বসেন। সঙ্গে ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানসহ কয়েকজন। তারপর কথামালায় শাহাবুদ্দিনকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের চেষ্টা। আনুষ্ঠানিকভাবে ফুল দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো। অগণিত ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষে ফুল দেয়া হয়। ফুলে প্রায় ঢাকা পড়েছিলেন ভালবাসার মানুষটি। বিপরীতে কিছুই দেয়ার ছিল না শাহাবুদ্দিনের। লাজুক হাসি আর বিনয়ী অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছিল সব। তাতেই খুশি আয়োজকরা। শিল্পকলা একাডেমির সহায়তায় উৎসব আয়োজন করেছিল জন্মদিন উদ্যাপন জাতীয় পরিষদ। অনুষ্ঠানে আগত সবাই যে বরেণ্য শিল্পী কিংবা বঙ্গবন্ধুর ¯েœহধন্য শাহাবুদ্দিনকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেনÑ তা নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা শাহাবুদ্দিনকে কেউ কেউ খুশি করার চেষ্টা করছেন বলেও মনে হয়েছে। এমন স্থ’লদের কথা বাদ দিলে সুন্দর একটি সন্ধ্যা। দারুণ উপভোগ্য। এমন সন্ধ্যা জীবনে বার বার আসুক। শুভ জন্মদিন, প্রিয় শাহাবুদ্দিন।
×