ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান কেট ব্ল্যানচেটের

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান কেট ব্ল্যানচেটের

সময়টা ১৯৯৮ সাল, ওই বছর শেখর কাপুরের ‘এলিজাবেথ’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য অস্কার মনোনয়ন পেলেও পুরস্কারটা ফস্কে গিয়েছিল কেট ব্ল্যানচেটের হাত থেকে। মার্টিন স্করসিসের ‘দ্য এ্যাভিয়েটর’-এর জন্য সেরা সহ-অভিনেত্রী শাখায় অস্কার পেয়েও মন ভরেনি তার। মোট ছয়বার করে অস্কার ও বাফটায়, আটবার গোল্ডেন গ্লোবের মনোনয়ন আছে তার ঝুলিতে। কিন্তু প্রতিবারই সেরা অভিনেত্রীর অস্কারটা অধরা থাকার অতৃপ্তি ঠিকই ছিল। অবশেষে ‘ব্লু জেসমিন’-এর মাধ্যমে তার ঘরে সেই পুরস্কার। এই ছবি তার ক্যারিয়ারের মুকুটে নীল হীরের মতো ঝলমল। মাত্র ১০ বছর বয়সে পিতৃহারা এই অভিনেত্রীর জীবনটা সবসময়ই লড়াইয়ের। ১৯৯৭ সালে নাট্যকার এন্ড্রা আপটনকে বিয়ে করেন ব্ল্যানচেট। তিনি তিন ছেলের জননী। খুব বাস্তববাদী কেট এক সাক্ষাতকারে তার সন্তানদের তার ভাবনা বলতে গিয়ে বলেন ‘যেদিন দেখব ওরা গাছ কাটতে পারছে, আগুন জ্বালাতে শিখেছে, ঘোড়ায় চড়ছে, বৃদ্ধাকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দিচ্ছে; সেদিন বুঝব ঠিকভাবে মানুষ করতে পেরেছি ওদেরকে।’ দুই যুগের অভিনয় জীবনে কেট ব্ল্যানচেট বাস্তবের চার বিখ্যাত ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে ‘এলিজাবেথ’ [১৯৯৮] ও ‘এলিজাবেথ : দ্য গোল্ডেন এজ’ ছবিতে ব্রিটেনের রানী প্রথম এলিজাবেথ, ‘আই এ্যাম নট দেয়ার’ ছবিতে বব ডিলান, ‘দ্য এভিয়েটর’ ছবিতে ক্যাথেরিন হেপবার্ন চরিত্রে দেখা গেছে তাকে। একজন অভিনয় শিল্পী ছাড়া ও কেট ব্ল্যানচেটের আরও একটি পরিচয় আছে তিনি হলেন মানবাধিকার কর্মী। বিশ্বের যে প্রান্তেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হোক না কেন তিনি সেখানেই যাচ্ছেন ছুটে। ২০১৬ সালের মে মাসে কেট ব্ল্যানচেটকে ইউএনএইচসিআরের শুভেচ্ছাদূত ঘোষণা করা হয়। সিরিয়ার সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়া শরণার্থী ও রাষ্ট্রহীন লোকজনের বিষয়ে তথ্যানুসন্ধানী মিশনে লেবানন ও জর্ডান সফর করেন কেট ব্ল্যানচেট। গত মার্চে মিয়ানরমারের রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে ইউএনএইচসিআরের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে চারদিনের সফরে কেট ব্ল্যানচেট কক্সবাজারে ঘুরে যান। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে গত ২৮ আগস্ট তিনি তার মতামত তুলে ধরেন। তিনি বলেন আমি এখানে শুধু একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে হাজির হয়েছি। আমি এখানে সেই ধরনের একজন মানুষ হয়ে উপস্থিত হয়েছি, যে নিজের চোখে কিছু জিনিস দেখে এসেছে এবং তা থেকে তার পক্ষে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সেখানে কোন মাত্রায় মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে এবং সেখানে কী কী মানবিক সহায়তা দরকার, তা নিজের চোখে দেখে এসেছি। আমি যা দেখেছি, তার ভয়াবহতার ব্যাপ্তি কোনভাবেই আমার পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সেখানকার যেসব চরিত্র আমার স্মৃতিজুড়ে ছড়িয়ে আছে, তার মধ্যে প্রধান চরিত্র হলো লায়লা নামের একজন অষ্টাদশী নারী। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে গত আগস্টে যে ৭ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে, লায়লা তাদের একজন। জ্বালিয়ে দেয়া নিজ গ্রাম থেকে শিশুপুত্র ইউসুফকে নিয়ে তিনি কোন রকমে পালিয়ে বাংলাদেশে গেছেন। সন্তানকে কোলে দোলাতে দোলাতে লায়লা বলছিলেন, তাঁর স্বামীকে কয়েকজন এসে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পাঁচ দিন পর সেই লোকগুলোই আবার ফিরে এসেছিল। তারা তাঁর ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তাঁকে বাচ্চা নিয়ে পালিয়ে যেতে বলল। লায়লার চোখের সামনে তাঁর চাচাকে তারা কুপিয়ে মেরে ফেলল। লায়লা আমাকে বললেন, ‘আমি চাচাকে মারার দৃশ্য দেখার পর উন্মাদের মতো ছুটেছিলাম।’ লায়লা তাঁর বাচ্চাকে নিয়ে পালিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ছিলেন। শুধু গাছের পাতা আর ফলমূল খেয়ে তিনি জীবন বাঁচিয়ে আসতে পেরেছেন। এরপর তিনি এক বিভীষিকাময় পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছাতে পেরেছেন। সেখানে এখন তিনি অন্য রোহিঙ্গাদের মতো এক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শরণার্থী শিবিরে থাকা একটি পরিবার লায়লাকে আশ্রয় দিয়েছে। যেখানে তিনি শিশুপুত্র ইউসুফকে নিয়ে আছেন। প্রায় প্রতিটি শরণার্থী পরিবারের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পেছনে এ রকম একেকটি গল্প রয়েছে। আপনাদের সবার মতো আমিও সেখানকার রক্ত হিম করা ঘটনার কথা শুনেছি। নিদারুণ নির্যাতন, নারীদের ধর্ষণ এবং প্রাণাধিক প্রিয় স্বজনকে চোখের সামনে নৃশংসভাবে মেরে ফেলার গল্প আপনাদের মতো আমিও শুনেছি। শরণার্থী শিবিরে এমন কিছু শিশু-কিশোর আছে, যাদের চোখের সামনে তাদের চাচা-চাচি, দাদা-দাদিকে ঘরের মধ্যে বেঁধে রেখে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন গত ৪০ বছরে মিয়ানমার থেকে গণহারে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এই ৪০ বছরে মিয়ানমার থেকে এত বেশি রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়েছে যে আজ মিয়ানমারে যত রোহিঙ্গা আছে, তার চেয়ে বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গা আছে মিয়ানমারের বাইরে। হত্যা-নির্যাতনের মুখে পড়ে ১৯৭৮ সালে দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছিল। পালিয়ে যাওয়া এই দলে গুল জাহার নামের এক নারী ছিলেন। তখন তাঁর বয়স খুব কম ছিল। বাংলাদেশ থেকে আবার তিনি সেখানে ফিরে গিয়েছিলেন। এর ১৪ বছর পর ১৯৯২ সালে আবার গণনির্যাতনের মুখে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। সেই দলেও গুল জাহার ছিলেন। আবার তিনি ফিরে গিয়েছিলেন। আজ বাংলাদেশে ৯ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। আজ গুল জাহারের বয়স ৯০ বছর। কী দুঃখের বিষয়, এই বয়সে আবারও তাঁকে নিজ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে হয়েছে। চার দশক ধরে গুল জাহার ছোটাছুটি করেছেন। এখন তিনি বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরের ঝুপড়ি ঘরে থাকেন। তাঁর আশা, তাঁর নাতিপুতিরা একদিন একটু ভাল থাকতে পারবে। তাদের ভবিষ্যত একদিন উজ্জ্বল হবে। কিন্তু মিয়ানমারে তাদের ভবিষ্যত নিশ্চিত করার জন্য এর আগে কোন দিনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আমরা যদি আজ সেই পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হই, তাহলে গুল জাহারের নাতিপুতিদের মতো নতুন প্রজন্মের অগণিত রোহিঙ্গা এই নিষ্ঠুরতার চক্র থেকে কোন দিনও বেরিয়ে আসতে পারবে না। বাংলাদেশ সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে যে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে, তা আমাদের এই চলমান ইতিহাসের এক বিরল দৃষ্টান্ত। রোহিঙ্গা শিবিরের কাছাকাছি বহু বাংলাদেশী গ্রামবাসী আছেন, যাঁরা নিজেরাই হতদরিদ্র্য এরপরও তাঁরা এক বছর ধরে রোহিঙ্গাদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছেন। এই হতদরিদ্র মানুষগুলো যদি তাঁদের ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন, তাহলে আমরা কেন পারব না? আমরা সবাই মিলে লায়লা অথবা ইউসুফ অথবা গুল জাহার এবং বাংলাদেশ ও মিয়ানমার বা যে কোন দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যত বদলে দিতে চাই। আমাদের সামনে এর কোন বিকল্প নেই। রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে আমরা ইতোপূর্বে ব্যর্থ হয়েছি। আর যেন ব্যর্থ না হই।
×