ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুই বার ঘোষণা দিয়েও পুরস্কারের অর্থ প্রদান করেনেনি নারী ফুটবলারদের

ক্রীড়া উপমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির কী হলো?

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ক্রীড়া উপমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির কী হলো?

রুমেল খান ॥ প্রতিশ্রুতি কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি, কিভাবে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করে তা ঝুলিয়ে রাখতে হয় দীর্ঘসময় ধরে ... এগুলোর সবচেয়ে ভাল সংজ্ঞা কে দিতে পারবে, বলুন তো? যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। নির্দিষ্ট করে বললে যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর। ঢাকার কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে সাফ অ-১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে স্বাগতিক বাংলাদেশ ১-০ গোলে ভারতকে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। খেলা শেষে মাঠে দাঁড়িয়েই আবেগের আতিশয্যে জয় তার মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের জন্য পাঁচ লাখ টাকা অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করেন। এখানেই শেষ নয়। আবারও তিনি ‘ঐতিহাসিক’ এ রকম আরেকটি ঘোষণা দেন ৩ এপ্রিল রাতে, ঢাকার শাহ্জালাল বিমানবন্দরে। সেদিন মেয়েদের একই দল ঢাকায় ফিরেছিল হংকংয়ে অনুষ্ঠিত জকি কাপ আসরে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে। সেই রাতেও আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে জয় মেয়েদের ছয় হাজার ডলার (পাঁচ লাখ টাকার সামান্য বেশি) পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। ডিসেম্বর চলে গেছে। চলে গেছে এপ্রিল। এখন চলছে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। এই নয় মাসেও বাংলাদেশের অ-১৫ জাতীয় নারী ফুটবল দল ‘জয়-ঘোষিত’ একটি টাকাও পায়নি! কদিন আগে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি সংবর্ধনা দেয় ২০০৩ সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন এবং ২০১৮ সাফে অংশ নেয়া বাংলাদেশ ফুটবল দলকে। সেই অনুষ্ঠানেও জয় বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদীকে দিয়ে যৌথভাবে ঘোষণা দেন জাতীয় দল এবারের সাফে চ্যাম্পিয়ন তিনি ও সালাম আলাদাভাবে জাতীয় দলকে পুরস্কার হিসেবে ৫ লাখ টাকা করে দেবেন। ভাগ্যিস বাংলাদেশ দল গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছে। নইলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলে এই টাকার প্রতীক্ষায় হয়তো ‘হার্ট এ্যাটাক’ই করে ফেলত! দায়িত্ব বলে একটা ব্যাপার আছে। সেই দায়িত্ব পালন করলে ঠিকমতো তা পালন করা উচিত। কিন্তু যদি আধা-খ্যাঁচড়াভাবে যদি সেই দায়িত্ব পালন করা হয় তাহলে অবশ্যই তা অনুচিত। আর এই কাজটিই ‘সুষ্ঠুভাবে’ করেছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। কয়েক মাস আগে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত এএইচএফ কাপ হকিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশ জাতীয় হকি দলকে সংবর্ধনা দিয়েছিল যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং এনএসসি। অনুষ্ঠানে জাতীয় হকি দলের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের প্রত্যেককে শুধু একটি করে ক্রেস্ট তুলে দিয়েই দায়িত্ব সারা হয়। অতিথিরা তাদের মূল্যবান ভাষণে হকি দলকে প্রশংসায় ভাসান, হকি দল নিয়ে সরকারের আলাদা ভাবনার কথা জানান, দলের ভবিষ্যত সাফল্য কামনা করেন ... কিন্তু কেউই ভুলেও মাইক্রোফোনের সামনে উচ্চারণ করেননি হকি দলের এই গৌরবময় সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং তাদের উৎসাহিত করার জন্য কোন আর্থিক প্রণোদনা দেয়া হবে অথবা জমি বা গাড়ি পুরস্কার দেয়া হবে। অথচ যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রীসহ এনএসসির অনেক উর্ধতন কর্মকর্তাকেই অতীতে দেখা গেছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলকে কোন ওয়ানডে বা টি২০ ম্যাচ জিততে দেরি, সঙ্গে সঙ্গে বিবৃতি দিয়ে তাদের প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে তাদের ৫, ১০ বা ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থ পুরস্কার উপহার দেয়ার ঘোষণা দিয়ে দিতে। পরে ঘটা করে সংবর্ধনার আয়োজন করে তাদের হাতে সেই টাকাও তুলে দিতে। শুধু টাকাই নয়- গাড়ি, বাড়ি, জমিসহ আকর্ষণীয় অনেক কিছুই দিতে। অথচ বিস্ময়কর হলেও সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয় নারী দল বা হকি দল শিরোপা জিতলে তাদের ভাগ্যে জোটে মামুলি ক্রেস্ট, গালভরা প্রতিশ্রুত কিংবা সস্তা মূল্যের কোন ‘হোম এ্যাপ্লায়েন্স।’ হোম এ্যাপ্লায়েন্সের কথা আসছে এজন্যÑ কারণ সোমবার বাফুফে ভবনে বাংলাদেশ অ-১৫ নারী জাতীয় দলকে সংবর্ধনা দেয় একটি ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। ভুটানে অনুষ্ঠিত সাফ অ-১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের কাছে ফাইনালে ০-১ গোলে হেরে রানার্সআপ হয় বাংলাদেশ। কথা ছিল চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে দলের সবাইকে একটি করে ফ্রিজ উপহার দেবে ওয়ালটন। রানার্সআপ হলে কোন ঘোষণা ছিল না। তবে তাদের উৎসাহ দিতে ওয়ালটন তাদের স্বল্প মূল্যের কিছু হোম এ্যাপ্লায়েন্স প্রদান করে। বাফুফের সাধারণ সম্পাদক জানান, আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর আরও একটি সংবর্ধনা পেতে যাচ্ছে মেয়েরা। সেটি দেয়া হবে জনতা ব্যাংকের পক্ষ থেকে। তবে ওই সংবর্ধনায় আর্থিক প্রণোদনা দেয়া হবে কি না, তা জানানো হয়নি। এমনটা বলার কারণÑ হংকং থেকে ফিরে আসার পর মেয়েদের সংবর্ধনা দিয়েছিল আরেকটি ব্যাংকÑ মধুমতি ব্যাংক। বিস্ময়করভাবে তারাও মেয়েদের কোন আর্থিক প্রণোদনা দেয়নি। দিয়েছিল একটি করে ক্রেস্ট! উপমন্ত্রী জয়ের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। তার মন্ত্রণালয় থেকে সেই টাকা এখনও বাফুফের হাতে তুলে দেয়া হয়নি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বাফুফে। তবে খুব শীঘ্রই টাকাটা পেয়ে যাওয়ার আশা বাফুফের। এক সাফ জয়ের পর আরেক সাফের রানার্সআপ হয়ে মেয়েরা এখন আরও সামনে এগুনোর জন্য পরিশ্রম করছে। অথচ তাদের প্রতিশ্রুত পুরস্কারের টাকা নিয়ে এখনও বাফুফে-যুব ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের চিঠি চালাচালিই চলছে! মেয়েদের জন্য অবশ্য আরেকটি সুখবর হচ্ছে অ-১৬ দলের ক্যাম্পে যারা আছে তাদের মাসে দশ হাজার টাকা করে দেয়ার পরিকল্পনা করছে বাফুফে। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, ব্যবসায়ী মহল, নেতা-নেত্রী এবং জাতীয় ক্রীড়াপরিষদের ব্যক্তিরা নিজেদের মনটাকে আরও উদার বা বড় করে মহিলা ফুটবলের উন্নয়নের জন্য এগিয়ে আসুন, এটাই ক্রীড়াপ্রেমীদের নিগূঢ় প্রত্যাশা। বরাবরের মতো পুরস্কার দেয়ার ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছেন যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী। এই কারণেই সমালোচিত ক্রীড়া উপমন্ত্রী জয়কে অনেকেই বলছেন ‘ঘোষণা-সর্বস্ব ক্রীড়া উপমন্ত্রী’! এখন দেখার বিষয়, মেয়েদের ১০ লাখ টাকা দিয়ে এই অপবাদ ঘোচাতে পারেন কি না তিনি।
×