ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম ও আইডি কার্ড পাওয়া গেছে তাদের কাছে

আটক বারো ছাত্রই শিবির কর্মী

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আটক বারো ছাত্রই শিবির কর্মী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অবশেষে আলোচিত ১২ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার দেখাল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা ছাত্র শিবির কর্মী। তারা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত। এসব ছাত্রদের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় দায়ের হওয়া দুটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে তারেক আজিজ নামে এক ছাত্রের বিরুদ্ধে আইসিটি এ্যাক্টে এবং বাকিদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাজে বাধাদান ও হামলার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের দুই দিন করে রিমান্ডে পাঠিয়েছে ঢাকার মহানগর হাকিম আদালত। রবিবার দুপুরে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন নিখোঁজ ১২ শিক্ষার্থীর পরিবারের সদস্যরা। তাদের দাবি, রাজধানীর মহাখালী ও তেজগাঁও এলাকা থেকে গত ৫ সেপ্টেম্বর অভিযান চালিয়ে পুলিশ কিছু শিক্ষার্থীকে নিয়ে যায়। এর মধ্যে ১২ শিক্ষার্থীকে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। সোমবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মোঃ মাসুদুর রহমান জানান, গত ৯ সেপ্টেম্বর ১২ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা সবাই শিবির কর্মী। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন চলাকালে গুজব সৃষ্টিকারীদের মধ্যে অন্যতম মূলহোতা তারেক আজিজ রয়েছে। বাকিরাও গুজব ছড়ানোর সঙ্গে নানাভাবে জড়িত। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের মনোগ্রামসহ ১২ সেট ইউনিফর্ম, উদ্ধারকৃত ইউনিফর্মগুলো বিএএফ শাহিন কলেজ, নিউভিশন, আইডিয়াল ও নটরডেম কলেজের। ১৩টি ফিতাসহ আইডি কার্ড (যদিও গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের কেউই ওইসব স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী নয়), হ্যান্ডমাইক, ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাস, হাতুড়ি, স্ক্রু-ড্রাইভার, তিনটি ল্যাপটপ, ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্ম পদ্ধতির বিভিন্ন ফরম, শিবিরের কিশোর কণ্ঠ ম্যাগাজিনসহ বিভিন্ন ইসলামী বই, বিভিন্ন কার্যক্রমের বিষয়ে লেখা ডায়েরি ও ফেসবুকে পোস্ট করা বিভিন্ন ভিডিওসহ ছবি। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার্থী আল আমিন ও জহিরুল ইসলাম হাসিব, টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মুজাহিদুল ইসলাম, সরকারী তিতুমীর কলেজের চতুর্থ বর্ষ অনার্সের ছাত্র জাহাঙ্গীর আলম, টাঙ্গাইলের করটিয়া সরকারী সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের চতুর্থ বর্ষ অনার্সের ছাত্র সাইফুল্লাহ বিন মনসুর, গাজী এম বোরহান উদ্দিন, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেকানিক্যাল বিভাগের ৫ম পর্বের ছাত্র তারেক আজিজ, কম্পিউটার সাইন্সের ৩য় পর্বের ছাত্র মাহফুজ, কেমিক্যাল বিভাগের ৮ম পর্বের ছাত্র রায়হানুল আবেদীন ও ইফতেখার আলম, অটোমোবাইল বিভাগের ৫ম পর্বের ছাত্র আজিজ ও মেহেদী হাসান রাজীব। এদের মধ্যে তিন জন ছাত্র শিবিরের সক্রিয় কর্মী ও সংগঠক, দুই জন কোটা ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। বাকিরা ছাত্র শিবিরের নতুন সদস্য হিসেবে সংগঠনের জন্য সাংগঠনিক কাজ করছে। গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান আরও জানান, গত ২৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে এমইএস বাসস্ট্যান্ডে প্রতিদিনের মতো যানবাহনের জন্য অপেক্ষারত শিক্ষার্থীদের চাপা দেয় যাত্রীবাহী জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস। এতে ঘটনাস্থলেই শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী দিয়া খানম মীম ও বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আব্দুল করিম রাজিব নিহত হয়। আহত হয় অন্তত ১৫ শিক্ষার্থী। এমন ঘটনার জেরে সারাদেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে থাকে। আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ানো হতে থাকে। এর জেরে বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। যারা গুজব ছড়িয়ে ছিল তাদেরকে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করতে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে আইনশ্ঙ্খৃলা বাহিনী। সেই ধারাবাহিকতায় গ্রেফতার হয় এরা। গ্রেফতারকৃতরা আন্দোলন চলার সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ও নিরাপদ সড়কের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করতে ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন উস্কানিমূলক লেখা, পোস্ট, ফটো ও ভিডিও’র মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে ছিল। তিনি আরও জানান, গত ৬ আগস্ট বেলা পৌনে ১২টার দিকে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যলয়ের বহিরাগত ৪শ’ থেকে ৫শ’ ছাত্র একত্রিত হয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সরকারবিরোধী বিভিন্ন উত্তেজনাকর সেøাগান দিয়ে রাস্তায় নেমে ছিল। উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা রাস্তা বন্ধ করে ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন ধরনের সেøাগান দিয়েছিল। সেই অবরোধ থেকে ছাত্ররা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করেছিল। ছাত্রদের ইট পাটকেলের আঘাতে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পিআই আবু হাজ্জাজ, এস আই ইমাম হোসেন, এএসআই আজাদ, এএসআই ইব্রাহিমসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। ছাত্র আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করা ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম মূল হোতা তারেক আজিজ ফেসবুক টাইম লাইনের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালিত করত। গ্রেফতারকৃত শিক্ষার্থীদের সাত দিনের পুলিশ রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে জানান গোয়েন্দা পুলিশ (উত্তর) ক্যান্টনমেন্ট জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার হান্নানুল ইসলাম। আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, সোমবার নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে দায়ের করা পৃথক দুই মামলায় গ্রেফতারকৃত ১২ শিক্ষার্থীকে আদালতে হাজির করে সাতদিন করে রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। আসামি পক্ষের আইনজীবী জসিম উদ্দিন, কামাল হোসেন প্রমুখ রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেছিলেন। শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম নুরুন্নাহার ইয়াসমিন শিক্ষার্থীদের দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। প্রসঙ্গত, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন চলার সময় গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার দায়ে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হন ফারিয়া মাহজাবিন (২৮)। এর আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কুমিল্লার ব্যারিস্টার মিলহানুর রহমান নওমীকে বন্ধুবান্ধব ও লোকজনসহ ঢাকায় এসে ছাত্র আন্দোলনে নেমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দিতে আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। এ সংক্রান্ত অডিওটি ভাইরাল হয়ে পড়ে। এ ঘটনায় গত ১১ আগস্ট চট্টগ্রামে দায়েরকৃত মামলায় নওমীকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। এর আগে ঢাকা এ্যাটাক সিনেমার অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ ফেসবুক লাইভে চার শিক্ষার্থীর মৃত্যু ও চার ছাত্রী ধর্ষণের গুজব ছড়িয়ে দেন। এমন মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর দায়ে র‌্যাব গত ৪ আগস্ট উত্তরা থেকে তাকে গ্রেফতার করে। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি পুলিশ। গত ৫ আগস্ট রাতে ধানম-ি থেকে দৃক গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা ও আলোকচিত্রী ড. শহিদুল আলম আন্তর্জাতিক এক গণমাধ্যমে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সম্পর্কে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য দেয়ার দায়ে ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। গত ৭ আগস্ট রাতে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে নিরাপদ সড়ক দাবির আন্দোলনকারীদের নাশকতামূলক কর্মকা-ে উস্কে দেয়ার দায়ে ছাত্র শিবিরের বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কর্মী বুয়েটের মেকানিক্যাল বিভাগের ১৫তম ব্যাচের ছাত্র দাইয়ান প্রধানকে গ্রেফতার করে চকবাজার থানা পুলিশ। এছাড়া গত ৭ আগস্ট র‌্যাব শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় গুজব ছড়ানোর দায়ে ধানম-ি থেকে আকতারুজ্জামান টনি (২২), আসাদুল্লাহ আল গালিব (২২) ও মুনইম সরকার (২৩) নামে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিবির কর্মীকে গ্রেফতার করে। গত ১৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের সময় গুজব ছড়ানোর দায়ে সিরাজগঞ্জের বেলকুচির যমুনা নদীর দুর্গম চরাঞ্চল ক্ষীদ্র চাপড়ির চর থেকে ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্রী লুৎফুন্নাহার লুমা। তাকেও রমনা থানায় দায়েরকৃত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এছাড়া সিআইডির হাতে গ্রেফতার হয় আহমাদ হোসাইন (১৯) ও নাজমুস সাকিব (২৪) নামে দুই শিক্ষার্থী।
×