ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে অচলাবস্থার নেপথ্যে

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে অচলাবস্থার নেপথ্যে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ লেবার হ্যান্ডেলিং ঠিকাদার, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর লিমিটেড এবং আমদানি-রফতানিকারকদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে মালামাল আনা-নেয়া বন্ধ রয়েছে। গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে বন্দরে এ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে সিএ্যান্ডএফ এজেন্টরা বন্দরে প্রবেশের গেট ভেঙ্গে ভুটান থেকে আমদানি করা ১০৩ ট্রাক পাথর নিয়ে গেছেন। এ অবস্থায় একদিকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছেন, অন্যদিকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন বন্দরের লোড-আনলোড শ্রমিকসহ বন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। সঙ্কট নিরসনে বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসনের আহ্বানে জরুরী বৈঠক ডাকা হলেও ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও সিএ্যান্ডএফ এজেন্টরা না আসায় বন্দর চালু হয়নি। বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১৪ মে ‘এটিআই লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে আমদানিকৃত পণ্য উঠানামার জন্য লেবার হ্যান্ডেলিংয়ের ইজারা দেয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী আমদানিকৃত পণ্য বন্দরে উঠানামা (লোড-আনলোড) বাবদ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ‘এটিআই লিমিটেড’কে সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা আমদানিকৃত পণ্যের টন প্রতি ১০৪ টাকা করে পরিশোধ করবেন। এই অর্থের সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ করা হবে। ব্যবসায়ীরা সরকারী রাজস্ব (ভ্যাট) বাবদ টনপ্রতি অতিরিক্ত ১৫.৬০ টাকা পরিশোধ করেন। মূল ১০৪ টাকার মধ্যে ‘এটিআই লিমিটেড’ কুলি শ্রমিক, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর লিমিটেডকে বন্দর চার্জ প্রদান করবে। বন্দরে লেবার হ্যান্ডেলিংয়ের ইজারা প্রদানের পূর্বে ব্যবসায়ীরা কুলি শ্রমিকদের মাধ্যমে নিজ উদ্যোগে পণ্য উঠানামা করতেন। সেক্ষেত্রে টন প্রতি তাদের কুলি শ্রমিক বাবদ ব্যয় হতো ৩১ থেকে ৩২ টাকা। ইজারার পর থেকেই ‘এটিআই লিমিটেড’ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করছে বলে অভিযোগ তাদের। তাদের মতে, ইজারাদার প্রতিষ্ঠানটি ১০৪ টাকা থেকে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে ১২.০২ টাকা, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর লিমিটেডকে ২৬.৪৫ টাকা, পণ্য আনলোড বাবদ কুলি শ্রমিকদের ১৯ টাকা এবং লোড বাবদ ২১ টাকা ছাড় দেন ব্যবসায়ীদের। আমদানিকারকরা ২১ টাকায় বন্দরের বাইরে থেকে পাথরসহ আমদানিকৃত পণ্য আবার লোড করে বিভিন্ন এলাকায় পাঠান। প্রতি টনে এটিআই লিমিটেড মুনাফা করে ২৫.৫২ টাকা। এই বন্দর দিয়ে শুধু আমদানিকৃত পাথর থেকেই প্রতিদিন ইজারাদার প্রতিষ্ঠানটি ২ লাখ টাকার বেশি মুনাফা করছে। এছাড়া ডাল, গম, চালসহ অন্য আরও অনেক পণ্য এই বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়। তাদের দাবি, ইজারাদার প্রতিষ্ঠান ২৫.৫২ টাকা মুনাফা করলেও তারা হিসাব দেখায় ২ থেকে ৩ টাকা মুনাফার। তারা সকল নিয়ম মেনেই আমদানি-রফতানি করতে চান। কিন্তু ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত মুনাফা লাভের মানসিকতা বন্দরকে অচল করে রেখেছে। তারা অভিযোগ করেন, অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে ইজারার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমাদের যে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা ছিল তারা সেই সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন না। শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই সঙ্কট সমাধানের জন্য মূল ইজারাদারকে নিয়ে বসতে হবে কিন্তু মূল ইজারাদার আসছেন না। তবে একটি কুচক্রীমহলের হীন স্বার্থের কারণে বন্দরের অচলাবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বলে দাবি করেছেন ইজারাদার প্রতিষ্ঠান এটিআই লিমিটেডের পার্টনার প্রতিনিধি মেহেদী হাসান খান বাবলা। তিনি বলেন, এই বন্দর নিয়ে এক কুচক্রী মহল দীর্ঘদিন ধরে একটি খেলায় মেতে উঠেছে। এই মহলের কাছেই বন্দরের প্রায় তিন কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এরাই সিএ্যান্ডএফ ও লেবারদের দিয়ে আন্দোলন করাচ্ছে। সাধারণ লেবার ও সাধারণ সিএ্যান্ডএফের কেউই এটি পছন্দ করছে না। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে এবং বন্দরের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। ওই মহল কোন সরকারী নিয়ম মানে না। আমরা চাই সরকার আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে বন্দরটিকে সচল রাখুক। এদিকে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, সিএ্যান্ডএফ এজেন্টের কাছে বন্দর চার্জ বাবদ প্রায় তিন কোটি বকেয়া রয়েছে। এই কারণে সম্প্রতি ভুটান থেকে আমদানি করা ১০৩ ট্রাক পাথর বন্দরে আটকে দেয়া হয়। বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও অনেকদিন থেকেই বন্দরের চার্জ পরিশোধ করছেন না কিছু সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট। উল্টো বন্দরের প্রবেশের গেট ভেঙ্গে ওই ১০৩ ট্রাক পাথর নিয়ে গেছেন। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত বা ভুটান থেকে যথানিয়মে বন্দরে পাথর আনা হলেও লোড-আনলোড করতে বন্দর কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ায় ব্যবসায়ীরা ক্ষিপ্ত হয়ে এ কাজ করেন। অন্যদিকে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়গুলোর তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখানে যদি সিএ্যান্ডএফ এজেন্টদের দায় থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ ১৯৯৭ সালে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর চালু হয়। শুরুতে নেপালের সঙ্গে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম চললেও পরে ভারত ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা হয়। বর্তমান এই বন্দর দিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন পণ্যবাহী ১৫০ থেকে ২৫০টি ট্রাক যাতায়াত করে। প্রতিদিন এই স্থলবন্দর দিয়ে সরকারের রাজস্ব আয় হয় প্রায় ২০ লাখ টাকা।
×