ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বজুড়ে সচেতনতা দিবস পালন ॥ আড়াই শ’ শকুনের অভয়াশ্রম মাত্র দুটি

শকুন বিলুপ্তির কারণে দেশে জলাতঙ্ক ও এ্যানথ্রাক্স বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

  শকুন বিলুপ্তির কারণে দেশে জলাতঙ্ক ও এ্যানথ্রাক্স বাড়ছে

সমুদ্র হক ॥ শকুন; অলুক্ষণের প্রতীক হিসেবে দীর্ঘদিন চিহ্নিত। কিন্তু এটি উপকারি পাখি। শকুন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দেশে বর্তমানে শকুনের সংখ্যা মাত্র আড়াই শ’। শকুন কমে যাওয়ায় দেশে এ্যানথ্রাক্স, জলাতঙ্ক ও অন্যান্য জুনোটিক রোগের সংক্রমণ ঘটছে। তাই শকুন প্রজাতিকে রক্ষার লক্ষ্যে জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন নেচার (আইইউসিএন) দেশে দেশে নানা কর্মসূচী নিয়েছে। শকুন বিলুপ্তির অন্যতম একটি কারণ হলো : পশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রফেন নামক ওষুধ। ওষুধ দুটি যে পশুর পেটে থাকে সেই পশু মারা গেলে এবং তা খেলে শকুন মারা যায়। শকুন রক্ষায় দেশে ’১০ সালে পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও শকুনের নিরাপদ এলাকায় ’১৭ সালে কিটোপ্রফেন নিষিদ্ধ করা হয়। এই দুই ওষুধের পরিবর্তে পশু চিকিৎসায় মেলেক্সিকানের প্রয়োগের পরামর্শ দেয়া হয়। আইইউসিএন, বন অধিদফতর, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে রবিবার বগুড়া, খুলনা ও সিলেটে শকুন সচেতনতা দিবস পালিত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের প্রথম শনিবার আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস পালিত হয়। আইইউসিএনের বাংলাদেশের কনসালট্যান্ট মিজানুর রহমান জানান, আইইউসিএন ও বন অধিদফতর বাংলাদেশের দুই এলাকাকে শকুনের নিরাপদ আশ্রম ঘোষণা করে। একটি হলো সিলেটের রেমাকালিঙ্গা অপরটি সুন্দরবন সংলগ্ন ছ’টি পয়েন্ট। সেখানে বিশেষায়িত খাদ্য গুদামে শকুনের খাবার সংরক্ষণ করা হয়। কোন পশু মারা গেলে তা শকুনের ভক্ষণের আগে পরীক্ষা করে দেখা হয়। এর বাইরে অসুস্থ শকুনের চিকিৎসা ও পরিচর্যায় নাটোরের সিংড়া জাতীয় উদ্যানে একটি কেন্দ্র খোলা হয়। এই বিষয়ে বগুড়ায় শিক্ষার্থীদের পরিবেশবাদী সংগঠন টিম ফর এনার্জি এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চের (তীর) সভাপতি আরাফাত রহমান জানান, ওই কেন্দ্রে এ পর্যন্ত ১৮ অসুস্থ শকুনের চিকিৎসা ও পরিচর্যা করে অবমুক্ত করা হয়েছে। অসুস্থ শকুনগুলো বগুড়া, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় থেকে আনা হয়। বন অধিদফতর জানায়, সত্তরের দশকে দেশে যত শকুন দেখা যেত তার ৯৮ শতাংশই বিলুপ্ত হয়েছে। শকুনের প্রধান খাদ্য মৃত প্রাণীর মাংস। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও ঘ্রাণ শক্তির অধিকারী শিকারি পাখি শকুন মৃত পশুর সন্ধান পায়। বিশ্বে ১৮ প্রজাতির শকুন টিকে আছে। পশ্চিম গোলার্ধে ৭ প্রজাতি ও পূর্ব গোলার্ধে ১১ প্রজাতি। ঈগলের সঙ্গে সম্পর্কিত ১১ প্রজাতির শকুনের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশে আছে ৬ প্রজাতি; যার ৪ প্রজাতি স্থায়ী ও ২ প্রজাতি পরিযায়ী। এগুলো হলো : বাংলা, রাজ, গ্রিফন, হিমালয়ী, ইউরোপীয় ও কালা শকুন। গ্রিফন প্রজাতির শকুন চোখে পড়ে না। মহাবিপদের মধ্যে আছে রাজ শকুন। রাজ শকুন বাচ্চা ফোটানোর জন্য ঠোঁটে পাথর বহন করে ডিমের ওপর নিক্ষেপ করে। আইইউসিএন জানায়, গত শতকের আশির দশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও নেপালে প্রায় ৪ কোটি শকুন ছিল। এই সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ৪০ হাজারে। গত তিন দশকে উপমহাদেশে ৭৫ শতাংশ শকুন মারা গেছে। ভারতে প্রতিবছর ৩০ শতাংশ করে শকুন মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশে শকুন বিলুপ্তির পথযাত্রায় টিকে আছে মাত্র ২৫০। প্রজননের মাধ্যমে শকুন উৎপাদন হচ্ছে না। শকুন রক্ষায় ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব অব ভেটেরি মেডিসিনের গবেষক ড. লিন্ডসে প্রমাণ করে দিয়েছেন, পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক প্রয়োগে শকুন বিলুপ্তি হচ্ছে। খাদ্য শৃঙ্খলে শকুন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মরা, পচা বিভিন্ন খাবার খেয়ে এরা রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। শকুনের গলা, ঘাড় ও মাথায় কোন পালক থাকে না। প্রশস্ত ডানায় বহুদূর উড়তে পারে। এদের আবাস পুরনো বট, পাকুড়, অশ্বত্থ, ডুমুরসহ বিশাল শাখা-প্রশাখার গাছ। কখনও থাকে গুহা ও পাহাড় চূড়ায়। শকুনের এই আবাসের মধ্যে বড় বৃক্ষ কাটা হচ্ছে। বগুড়ার এক প্রবীণ মাসুদার রহমান বললেন, আগে অনেক শকুন দেখেছি, এখন চোখে পড়ে না। স্মৃতি থেকে বললেন, কোথাও মরা গরু পড়ে থাকলে শকুন উড়ে আসত দলবেঁধে। প্রধান শকুন আসার পর ওরা সাবাড় করত মরা পশুটি।
×