ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মজিবর রহমান

আবারও ‘ধরাধরি’ শুরু হয়ে গেছে ফুটবলে!

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আবারও ‘ধরাধরি’ শুরু হয়ে গেছে ফুটবলে!

কালো মেঘ চিরে বাংলাদেশের ফুটবলের আকাশে যখন এক ফালি চাঁদ উঁকি দিচ্ছিল ঠিক তখনই শুরু হয়ে গেল ‘ধরাধরি’। ব্রিটিশ কোচ জেমি ডে’র তালিকায় না থাকলেও অদৃশ্য শক্তির বেহায়াপনা হস্তক্ষেপে হুট করেই জাতীয় দলের একাদশে ঢুকে পড়লেন গোলরক্ষক শহিদুল আলম সোহেল। বনে গেলেন নিয়মিত একাদশের সদস্য। তার হাস্যকর ভুলে বা বাজে গোল হজমে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত সাফ ফুটবলে দর্শক বনে গেল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ফুটবলে ধরাধরির ইতিহাস নতুন নয়। নিরপেক্ষ কাউকে কর্মকর্তা/ম্যানেজার নিয়োগ না করায় তা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। আর এ কারণে স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিনিয়ত মাসুল গুনছে জাতীয় দল। যদিও বিগত প্রায় দেড় যুগ বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে। সাফল্য না থাকলে মানুষ খোঁজ-খবর রাখবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে হঠাৎ পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসে দেশের ফুটবল। শুরু হয় আবার নতুন করে স্বপ্ন বুনা। চলমান সাফ ফুটবলে টানা দুই ম্যাচ জেতার পর প্রত্যাশার পারদ আরও ওপরে উঠতে শুরু করে। দুর্দান্ত এই ধারাবাহিকতার মাঝে সম্ভবত কেউ কল্পনাও করেননি সুবিন্যস্ত এই দলটি গ্রুপপর্ব থেকে ছিটকে পড়বে। সমান ৬ পয়েন্ট নিয়েও গোলগড়ে নেপাল-পাকিস্তানের পেছনে পড়ে হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাবেন জামাল ভুঁইয়ারা। কার্যত সেটাই ভাগ্যে জুটলো। সঙ্গী হলো এক রাশ হতাশা। যার অন্যতম কারণ ক্লাবপ্রীতি। কোচের ক্যাম্পের বাইরে থাকা গোলরক্ষক খেলিয়ে ফুটবলের ললাটে আবার এঁকে দেয়া হলো কলঙ্কের কালিমা। প্রথম শ্রেণীর ঘরোয়া আসরে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে দুরবীন দিয়ে দর্শক খুঁজে পাওয়া না গেলেও নানা ইস্যু নিয়ে মতিঝিলে ফুটবল ভবনের সামনে প্রায়ই ফুটবলপ্রেমীদের ভিড় চোখে পড়তো। সেটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে গরম কফির পেয়ালায় চুমুক দেয়া কর্মকর্তাদের সাধুবাদ জানাতে নয়। সমাবেশ হতো প্রতিবাদের, ফুটবল বাঁচানোর। সেই প্রতিবাদমুখর মানুষগুলো যখন মনের খোরাক পেয়ে গেলেন, তখন তারা মতিঝিল ছেড়ে ঠিকই ফুটবলের টানে ফিরে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর গ্যালারিতে। সাফ ফুটবলে যে দর্শক দেখা গেছে বিগত ১৫/২০ বছরে তা চোখে পড়েনি। কিন্তু বাংলাদেশ দলের করুণ বিদায়ে ফুটবলের এই পুনর্জাগরণে বা জোয়ারে যে বড় একটা ধাক্কা তাতে কোন সন্দেহ নেই। অবশ্য এতে কিছুই যায় আসে না ‘ধরাধরি’ করে যারা ফুটবলের বারোটা বাজিয়েছেন তাদের। বাংলাদেশের অসহায় বিদায় নেয়ার পেছনে অন্যতম কারণ, কোচকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেয়া। কোচের ওপর খবরদারি করে ঘর থেকে ডেকে আনা গোলরক্ষককে নিয়মিত একাদশে জায়গা করে দেয়া। এরচেয়েও বড় অপরাধ স্বাগতিক দল হয়েও বাড়তি সুবিধা না পাওয়া। যা সারাবিশ্বে আয়োজক দল নিয়ে থাকে। সাত জাতির এ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের গ্রুপে রাখা হয় চার দল। অন্য গ্রুপে তিনটি। আসর শুরুর পর পাঁচদিনে তিন ম্যাচ খেলতে গিয়ে নেপালের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ফুটবলাররা ছিলেন কিছুটা হলেও ক্লান্ত। চার দলের গ্রুপে থাকার কারণে দুই ম্যাচ জিতেও সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্ন-স্বাদ পূরণ করতে পারেননি দেশের ফুটবলাররা। অথচ বিপরীত গ্রুপে এক ম্যাচ জিতেই সেমিফাইনালে নাম লিখিয়ে ফেলে ভারত। প্রসঙ্গত সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের (সাফ) সভাপতি হচ্ছেন কাজী সালাউদ্দিন। আর সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক হেলাল, ওরফে গিরিঙ্গি হেলাল। এখানে সভাপতির কোন দোষ নেই। নিজের জনপ্রিয়তা, যোগ্যতা দিয়েই তিনি টানা তিন টার্ম এই মসনদে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের মতো সাফ বিশ্ব ফুটবলের অভিভাবক ফিফা আইনে পরিচালিত হয় না। এখানে সাধারণ সম্পাদকই সর্বেসর্বা। খেলা শুরুর আগেই গুঞ্জন চলছিল নিজের পদ টিকিয়ে রাখতে ভারতের তাবেদারি করতে গিয়ে বাংলাদেশের গ্রুপটা ভারি বানিয়েছেন হেলাল। আর সহজ করে দিয়েছেন ভারত থাকা গ্রুপটা। দেশপ্রেমের চেয়ে হেলালের কাছে যে নিজের পদ টিকিয়ে রাখাই মুখ্য। কারণ তিনি স্বাগতিক দেশের নাগরিক হয়েও নিজ দলের জন্য বাড়তি সুবিধা না নিয়ে উল্টো ঠেলে দিয়েছিলেন তোপের মুখে। যার মাসুল গুনলো বাংলাদেশ জাতীয় দল। জানা গেছে পুরস্কার হিসেবে ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন নাকি আগামীতেও হেলালকে এই পদে দেখতে চায়। সাফের পরবর্তী নির্বাচনেও সাধারণ সম্পাদক পদে হেলালকেই সমর্থন জানাবে ভারত। কোচ জেমির তালিকায় নাম না থাকা গোলরক্ষক সোহেলকে জাতীয় দলের গোলপোস্টের নীচে দেখা যায় নীলফামারীতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফিফা আন্তর্জাতিক ফ্রেন্ডলি ম্যাচে। ওই পরীক্ষায় তিনি ফেল করেছিলেন বাজে গোল খেয়ে। বাংলাদেশ দল মাঠ ছেড়েছিল এক গোলের পরাজয় নিয়ে। এই সোহেলের কারণে ঠিক একইভাবে বিদায় ঘণ্টা বাজলো দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বকাপ খ্যাত সাফ ফুটবল থেকে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, সোহেলের খুঁটির জোর কোথায়? বিষয়টা পরিষ্কার তার বড় যোগ্যতা ঢাকা আবাহনীর গোলরক্ষক তিনি। আর বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রভাবশালী ম্যানেজার সত্যজিৎ দাস রূপু হচ্ছেন ঢাকা আবাহনীর ম্যানেজার। দরজায় কড়া নাড়ছে ঘরোয়া ফুটবল। নিজ দলের গোলরক্ষককে তাতিয়ে নিতে রূপুই কোচের ওপর খবরদারি করে যে সোহেলকে রাতারাতি জাতীয় দলে জায়গা করে দিয়েছেন এটা ‘কানার ভাই অন্ধরও’ এখন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সাফ সম্পাদক হেলাল খুশি করিয়েছেন ভারতকে। আর নেপালীদের স্বপ্ন পূরণ করেছেন গোলরক্ষক সোহেল। নেপাল ফুটবল দলের কাছে তিনিই জয়ের মহানায়ক। অনুমানিক ৪০ গজ দূর থেকে নেয়া নেপালের ফরোয়ার্ডের দূরপাল্লার দুর্বল শটের বল সোহেলের হাত ফসকে যেভাবে জালে প্রবেশ করেছে তা বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৫ নারী ফুটবল দলের গোলরক্ষককেও ফাঁকি দিতে পারতো বলে মনে হয় না। এ রকম অহরহ ভুল করার অতীত রেকর্ড সোহেলের রয়েছে। কিন্তু তারপরও খুঁটির জোরে ক্যাম্পের বাইরে থেকেও জাতীয় দলে ঠাঁই করে নিতে অসুবিধা হয়নি সোহেলকে। এখানে তার কোন দোষ নেই। যারা তাকে সুযোগ করে দিয়েছেন দায়টা তাদেরই। রেফারির শেষ বাঁশি বাজার পর ডি বক্সের বাইরে বিষণœœ বদনে গা এলিয়ে মাটিতে বসে থাকতে দেখা যায় সোহেলকে তার কৃতকর্মের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের কোন খেলোয়াড় তাকে সান্ত¡না দিতে যাননি। তবে ভুল করেননি নেপালীরা। চারপাশ ঘিরে সোহেলকে তারা সান্ত¡না দিয়েছেন। আর মনে মনে হয়তো বলছিলেন, তুমিই তো আমাদের জয়ের নায়ক। তুমি আমাদের জন্য যা করেছ বা উপহার দিয়েছ তা কোনদিন আমরা ভুলবো না। নেপালবাসী তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। যদিও ম্যাচ শেষে সংবাদ সন্মেলনে কোচ জেমি পরাজয়ের অন্যতম নায়ক সোহেলের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেছেন, ফুটবলে এমন ভুল হতেই পারে। এটা তো ভদ্রতার কথা। সেটাই দেখিয়েছেন জেমি। প্রকাশ্যে প্রকাশ করেননি অন্তরে লুকিয়ে থাকা যন্ত্রণা। কারণ তার হাতে তো দেশসেরা একজন গোলরক্ষক ছিলেন, যাকে নিয়ে সদ্য সমাপ্ত এশিয়ান গেমসে তিনি গর্ব করার মতো সাফল্য এনে দিয়েছিলেন বাংলাদেশকে। সাফ ফুটবলের সম্ভাব্য একাদশটাও ঠিকঠাক করে রেখেছিলেন। কিন্তু রূপু গংদের কারণে তিনি সাফ ফুটবলে খেলাতে পারলেন না সেই গোলরক্ষক আশরাফুল ইসলাম রানাকে। মাঠে নামতে পারেননি তার পছন্দের তারুণ্যনির্ভর একাদশও। তিন ম্যাচেই রানার ঠিকানা ছিল রিজার্ভ বেঞ্চ। এশিয়ান গেমসে কাতারের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন রানা। অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে দলের ও কোচের মন জয় করেছিলেন তিনি। কাতার, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পরিচালিত ক্যাম্পে ও প্রস্তুতি ম্যাচে দলের সেরা ও এক নম্বর গোলরক্ষক ছিলেন রানা। সাফ ফুটবলের জন্য তাকে আরও পরিণত করেছিলেন কোচ জেমি বিদেশের মাটিতে নিয়মিত মাঠে নামিয়ে। কিন্তু কোচের সব পরিকল্পনা তামাদি হয়ে গেল দ্বিতীয়পক্ষের হস্তক্ষেপে। অথচ এই এশিয়াডের সাফল্যই ফুটবলের মরা নদীতে জোয়ার এনেছিল। এশিয়াডে ভাল করায় গ্যালারিতে দর্শক টানতে সক্ষম হয় সাফ ফুটবল। ওয়াকিবহাল মহলের মতে জাতীয় দলের কর্মকর্তা/ম্যানেজার করা উচিত নিরপেক্ষ কাউকে। যিনি কোন ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত নন। রূপুর চেয়েও অনেক বড় সাবেক তারকা ফুটবলার রয়েছেন যারা কোন ক্লাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। নিরপেক্ষ সংগঠকেরও অভাব নেই। সাফে ব্যর্থতার পরও ফুটবল যেহেতু নতুন করে আশা দেখাতে শুরু করেছে সেহেতু বাফুফের উচিত দলীয়করণ থেকে বেরিয়ে আসা। তা নাহলে যুগের সমস্যা ‘ধরাধরি’ থেকে মুক্তি পাবে না দেশের ফুটবল। বিষয়টা নিয়ে ভাবা উচিত বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের। কারণ ব্যর্থতার বদনাম রূপুদের নয়। তার ওপরই বর্তাবে মানুষ।
×