ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চার লাখ অবৈধ অস্ত্র ॥ নির্বাচন সামনে রেখে সীমান্তপথে আরও আসার আশঙ্কা

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

চার লাখ অবৈধ অস্ত্র ॥ নির্বাচন সামনে রেখে সীমান্তপথে আরও আসার আশঙ্কা

শংকর কুমার দে ॥ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের সীমান্তের চোরাইপথে আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদের চোরাচালান এবং জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশ ঘটানোর আশঙ্কা করছে গোয়েন্দা সংস্থা। দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রবেশ করে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণসহ নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করার উদ্দেশ্যে আন্ডারওয়ার্ল্ডে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের ব্যবহার বৃদ্ধিতে অস্থিতিশীল ও অরাজকতা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। জঙ্গীগোষ্ঠী, সন্ত্রাসী বাহিনী, দুর্বৃত্ত চক্রের হাতে গড়ে উঠেছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের ভান্ডার। খুব শীঘ্রই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের জন্য বিশেষ অভিযান পরিচালনা করার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। দেশের সীমান্তপথে সতর্কাবস্থায় ও নজরদারি বাড়ানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিজিবি, গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দফতর ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ সেন্টার (বিডিপিসি) গবেষণাসূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে ৪ লাখের মতো। প্রতিবছর দেশে ৫০০ কোটি টাকার অবৈধ অস্ত্র নিয়ে আসে অস্ত্র চোরাচালানি সিন্ডিকেট। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের সিন্ডিকেটের সংখ্যা প্রায় ১২৮টি। দেশের প্রায় ৩০টি সীমান্তপথে এসব আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আসছে অস্ত্র চোরাচালানি সিন্ডিকেট। অবৈধ অস্ত্র চোরাচালানির সঙ্গে জড়িত রয়েছে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র ও চোরাকারবারিদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এসব অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসায়ী অস্ত্রধারী ও গডফাদারদের সবার তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যা হালনাগাদ করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে কী পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই ও পরিসংখ্যান করা সম্ভবপরও নয়। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ সেন্টারের (বিডিপিসি) গবেষণাসূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্রের ১২৮টি সিন্ডিকেট রয়েছে। দেশে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে ৪ লাখের মতো। ওই গবেষণা সূত্রে আরও জানা যায়, আফগানিস্তান বাদে সার্ক দেশগুলোয় ২৫ হাজার কোটি টাকার অবৈধ অস্ত্র আছে, যার পেছনে আন্তর্জাতিক মাফিয়া ও চোরাকারবারিদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক কাজ করে। বাংলাদেশে এ সিন্ডিকেট প্রতিবছর ৫০০ কোটি টাকার অবৈধ অস্ত্র নিয়ে আসে। এসব অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসায়ী অস্ত্রধারী ও গডফাদারদের সবার তালিকা পুলিশের কাছে রয়েছে এবং প্রতি বছরই তাদের তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। দেশে জঙ্গীগোষ্ঠী, সন্ত্রাসী বাহিনী, দুর্বৃত্ত চক্রের হাতে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের ভান্ডার গড়ে উঠার খবর পাওয়া গেছে। খুব শীঘ্রই সারাদেশে অস্ত্র ও মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, গুলশানের হলি আর্টিজান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় যে পরিমাণ অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে, তাতে এটা নিশ্চিত যে দেশের অভ্যন্তরে বিপুল আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকেছে। জঙ্গীদের কাছেই রয়েছে অত্যাধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র। গুলশান হলি আর্টিজানে হামলাকারী জঙ্গীরা সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য। এতে কোন সন্দেহ নেই। সুইসাইড স্কোয়াডের এই সদস্যরা যেসব অস্ত্র এনেছিলেন তারা জানতেন অস্ত্রগুলো তাদের আস্তানায় আর ফিরবে না। এতেই বোঝা যাচ্ছে তাদের কাছে আরও কত অস্ত্র রয়েছে। ঢাকাসহ সারাদেশে দুই শতাধিক অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসায়ী রয়েছেন। সীমান্তপথে ভারত ও মিয়ানমার থেকে এসব রুটে সহজেই বাংলাদেশে আনছেন অস্ত্রের চালান। এ ছাড়া চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ে দেশী প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র তৈরি করা হয়। খুন-ডাকাতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ ছিনতাই কাজেও অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, দেশের অন্তত ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে অবৈধ অস্ত্র দেশে আসছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, সন্দ্বীপ, সীতাকুন্ড, রাঙ্গুনিয়া, বান্দরবান, রাঙ্গামাটির সাজেক, খাগড়াছড়ির রামগড় ও সুদারাম, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, মংলা, উখিয়া, রামু, টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, রাউজান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, হিলি ও সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিনই অবৈধ অস্ত্র আসছে। দেশেও নিজস্ব পদ্ধতিতে অস্ত্র তৈরির কারখানা রয়েছে। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের ব্যবসা রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এছাড়া দেশের আরও কয়েকটি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশের খবর রয়েছে যার মধ্যে মেহেরপুরের গাংনীর থানার সীমান্তবর্তী সর্দারপাড়া গ্রাম ও কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বিলগাথুয়া, জামালপুর, পাকুড়িয়া ভাঙ্গাপাড়া, মুন্সীগঞ্জ, চর মোহাম্মদপুর, চল্লিশপাড়া, ছলিমেরচর, গোড়েরচর, মরারচর, বাংলাবাজার এলাকা দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশের ঘটনা ঘটেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা, বিনোদপুর, পোল্লাডাঙ্গা, বকচর, হাকিমপুর, বাখর আলী, বাগডাঙ্গা, মাসদুপুর, শিংনগর, মনোহরপুর, রঘুনাথপুর, কিরণগঞ্জ ও চৌকা এলাকার প্রায় ১০ কিলোমিটার সীমান্ত দিয়ে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশের একটি অন্যতম রুট। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, কুমিল্লার বিবিরবাজার, চৌদ্দগ্রাম, ফেনীর বিলোনিয়া ও আমতলী এলাকা, দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ, বিরল, ফুলবাড়ী ও নওগাঁর ধামুরহাটের সীমান্তবর্তী ৩টি গ্রাম দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশ করে। এসব ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসায়ীদের ধরার অভিযান চালানোর পাশাপাশি সীমান্তে সতর্ক অবস্থা ও নজরদারি শুরু করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্র জানান, দেশের অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও দুর্ধর্ষ অপরাধীদের হাতে চলে আসা এসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ এখন খুবই বিপজ্জনক মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। অবৈধভাবে আসা এ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েই খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির মতো গুরুতর অপরাধ সংঘটিত করতে পারে ভয়ঙ্কর ধরনের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও অপরাধীরা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জঙ্গীগোষ্ঠীর তৎপরতা বেড়ে যাতে পারে, যাতে দেশে অস্থিতিশীল ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সারা বছর সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে যেসব অস্ত্র প্রবেশ করছে তা আন্ডারওয়ার্ল্ডে চলে যাচ্ছে। অবৈধ ও বৈধপথে আসা অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র দেশের ভেতরে প্রবেশের পর চলে যাচ্ছে অপরাধীদের দখলে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, সারা বছরই দেশের সীমান্ত এলাকার নির্দিষ্ট পয়েন্ট দিয়ে অবাধে ঢুকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রবেশ করা অব্যাহত থাকালেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুদ গড়ে তোলা হতে পারে, যা এখন থেকেই সতর্ক নজরদারি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের সীমান্তের চোরাইপথে জঙ্গীগোষ্ঠী ও সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বেড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক ঘটনা ধরে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও অরাজকতা সৃষ্টির জন্য পরিকল্পিতভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটাতে পারে। বিশেষ করে দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডে অস্ত্র ও গোলাবারুদের ভান্ডার গড়ে তুলতে পারে চোরাচালানি চক্র, জঙ্গীগোষ্ঠী ও সন্ত্রাসী বাহিনী। আন্ডারওয়ার্ল্ডে জঙ্গী, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোই নিয়ন্ত্রণ করছে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের বাজার। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে যাতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে অপরাধ কার্যক্রমে আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক ও নজরদারি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
×