ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াতের মদদে ফের সঙ্কটে তবলীগ জামাত

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

   জামায়াতের মদদে ফের সঙ্কটে তবলীগ জামাত

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ জামায়াত মদদপুষ্ট কয়েক হেফাজত নেতার অপরাজনীতির কারণে আবার সঙ্কটের মুখে অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন তবলীগ জামাত। এবার হজ থেকে ফেরার পর তবলীগ জামাত বাংলাদেশের প্রধান কার্যালয় রাজধানীর কাকরাইল মসজিদে প্রবেশের সময় তবলীগের মুরব্বিদের ওপর হামলা চালিয়েছে সেই বিশেষ গোষ্ঠীর অনুসারিরা। শনিবার মধ্যরাতে হামলার ঘটনার পর থেকে রীতিমতো শান্তিপ্রিয় মুসল্লিদের বের করে দিয়ে কাকরাইল মসজিদ দখলে রেখেছে তবলীগের আড়ালে সক্রিয় রাজনৈতিক মদদপুষ্টরা। যাকে পাকিস্তানপন্থীদের চক্রান্ত অভিহিত করে দ্রুত সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন দেশের মুসল্লিরা। তবলীগ জামাত বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ধর্মীয় প্ল্যাটফর্ম। ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষের কাছে একটি আস্থার প্রতীক। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে যাওয়াই তাদের কাজ। এদের কোন রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই। এ জামাতের প্রধান কার্যালয় ভারতের দিল্লীর নিজামুদ্দিনে। বাংলাদেশে প্রধান কার্যালয় ঢাকার কাকরাইল মসজিদ। তবে মসজিদে কয়েক মাস ধরে অব্যাহতভাবে ঘটে চলা অপ্রীতিকর ঘটনার নেপথ্য কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, একটি স্বার্থান্বেষী মহল অহিংস তবলীগ জামাতকে বিতর্কিত করার চক্রান্তে লিপ্ত। এই চক্রান্তের হোতা হিসেবে কাজ করছেন তবলীগ জামাতের বিশ্ব আমির দিল্লীর মাওলানা সাদ কান্ধলভি বিরোধী একটি গ্রুপ ও কয়েক হেফাজত নেতা। যারা বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কওমিপন্থী অধিকাংশ হেফাজত নেতাকর্মীও তাদের এই তৎপরতায় ক্ষুব্ধ। অরাজনৈতিক তবলীগ জামাতকে এভাবে রাজনীতিকরণ পছন্দ করছেন না তবলীগের শূরা সদস্যসহ সাথিরা। কাকরাইল মসজিদের মুকিমরা হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, তবলীগ জামাতের মূল কেন্দ্র দিল্লী নিজামুদ্দীন মার্কাজকে উপেক্ষা করে তবলীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানকে সহায়তা করতে মরিয়া দেশে তবলীগ নিয়ে রাজনীতি করা চক্রটি। তাদের কারও লক্ষ্য আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন, কারও উদ্দেশ্য পাকিস্তানকে সহায়তা করা, কারও উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করা। চক্রটি চাচ্ছে তবলীগ জামাতের মূল কেন্দ্র দিল্লী নিজামুদ্দীন মার্কাজকে উপেক্ষা করে কেন্দ্র পাকিস্তানে সরিয়ে নিতে। একটি সঙ্কট তৈরি করে বিশ্ব ইজতেমাকেও পাকিস্তানে সরিয়ে নেয়া তাদের লক্ষ্য। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সাধারণ মুসল্লিরা আরও বলছেন, তবলীগের সব কার্যক্রম প্রচলিত রীতি ও রাজনীতির বাইরে ছিল। সাধারণ মুসল্লি ও তবলীগের শূূরা সদস্যরা ইতোমধ্যেই তবলীগ নিয়ে যে কোন ধরনের রাজনীতি প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে বলেছেন, তবলীগে হেফাজত-জামায়াতের রাজনীতি চলবে না। তবলীগ জামাতের মূল কেন্দ্র দিল্লী নিজামুদ্দীন মার্কাজকে উপেক্ষা করে তবলীগের নেতৃত্ব পাকিস্তানের হাতে তুলে দেয়ার চক্রান্ত সফল হতে দেয়া হবে না। জানা গেছে, মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারী শূরা সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামসহ কয়েক মুরব্বি ও সাথী এবার হজে গিয়েছিলেন। শনিবার রাতে এশার নামাজের পর সাদের অনুসারী তবলীগের মুরব্বিরা কাকরাইল মসজিদে প্রবেশ করতে গেলে বাধার মুখে পড়েন। এসময় কাকরাইল মসজিদের ভেতরে ছিলেন সাদবিরোধী পক্ষের মুরব্বি মাওলানা যোবায়ের। কাকরাইল মসজিদের ভেতরের মাদ্রাসার ছাত্ররা বাইরে এসে সাদ বিরোধীদের ওপর হামলা চালায়। এসময় হাতাহাতির ঘটনায় কয়েকজন আহত হয়েছেন। রাতে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। দু’পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেয়া হয়। মুসল্লিরা বলছেন, এবারের হামলার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন লালবাগে জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে পুরো পরিবারসহ জড়িত মাওলানা যোবায়ের। অস্থিরতা সৃষ্টির লক্ষ্যে মাদ্রাসার ছাত্রদের দিয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে; যা তবলীগের ইতিহাসে কোনদিন ঘটেনি। মাওলানা আব্দুল্লাহ বলেন, রাতে মসজিদের ভেতর থেকে কিছু লোক এসে মুরব্বিদের ওপর হামলা চালায়। তাদের ভেতরে প্রবেশে বাধা দেয়। হজ শেষে তারা দেশে এসে এ পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। মাওলানা জুনায়েদ সিদ্দিক বলছিলেন, পাকিস্তানপন্থীরা মুরব্বিদের ওপর হামলা করেছে। সারাদেশের প্রতিটি মুসল্লিই শুধু নয়, শান্তিপ্রিয় প্রতিটি মানুষ এদের তৎপরতায় উদ্বিগ্ন। সাধারণ মানুষের মনে তবলীগ সম্পর্কে ভয় ঢুুুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলছেন, এ তৎপরতা বিশ্ব ইজতেমাকে পাকিস্তানে সরিয়ে নেয়ার চক্রান্তের অংশ। সাদ বিরোধী অবস্থান থাকলে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ বিদেশীরা এখানে আসবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এসব জেনেই ওরা সঙ্কট তৈরি করছে। তাদের কোন আল্টিমেটাম দেশের কোটি কোটি শান্তিপ্রিয় মানুষ মানবে না। তবলীগ নিয়ে রাজনীতি চলবে না। এদিকে ঘটনার পর কাকরাইল মসজিদ রীতিমতো দখলে রেখেছে গ্রুপটি। বাইরে চলে এসেছে তবলীগ নিয়ে রাজনীতি বন্ধের দাবিতে সোচ্চার বিশাল অংশটি। তারা রবিবার সকালে প্রথমে সার্কিট হাউস মসজিদ ও পরে গুলিস্তান সেন্ট্রাল মসজিদে অবস্থান নিয়েছেন। ক্ষুব্ধ মুসল্লিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে উল্টো পাকিপন্থীদের প্রতি নমনীয়তার অভিযোগও তুলেছেন। কিন্তু কারা আছেন তবলীগকে সঙ্কটের ফেলার এ তৎপরতায়? অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১১ শূরা সদস্যের মধ্যে ৬ জন নিজামুদ্দীনের পক্ষে থাকলেও বাকি ৫ জন আলমি শূরার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আলোচিত ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ও ২০ দলীয় জোটভুক্ত কয়েক রাজনীতিবিদও যুক্ত হয়ে পড়েছেন ওই ৫ আলমি শূরার সদস্যের পক্ষে। তবলীগের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এ রাজনৈতিক নেতাদের সংশ্লিষ্টতার পরই তবলীগের কার্যক্রম রাজপথে গড়ানো শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সাধারণ মুসল্লি; যারা তবলীগ নিয়ে যে কোন রাজনীতির বিপক্ষে। বিগত বিশ্ব ইজতেমায় তবলীগের বিশ্ব আমির মাওলানা সা’দ ও নিজামুদ্দীনের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসেও ইজতেমায় অংশ নিতে পারেনি বিশেষ ওই চক্রের বিরোধিতায়। কিছুদিন আগে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম সাবেক শরিক দল খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হকের সভাপতিত্বে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অংশ্রগ্রহণ করেন ২০ দলীয় জোটভুক্ত জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহসভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, হেফাজতে ইসলাম ঢাকা উত্তর জোনের যুগ্ম আহ্বায়ক কেফায়েতুল্লা আজহারী। অরাজনৈতিক তবলীগ জামাতের বিষয়টির এভাবে রাজনীতিকরণ পছন্দ করছেন না তবলীগের সাথিরা। কাকরাইল মসজিদের কয়েক মুকিম হতাশা প্রকাশ করে বলেন, তবলীগের সব কার্যক্রম প্রচলিত রীতি ও রাজনীতির বাইরে ছিল। এভাবে রাজনৈতিক স্টাইলে তবলীগ নিয়ে কর্মকা- করাটা দুঃখজনক। মুসল্লিরা বলছেন, সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এভাবে ধর্মীয় ইস্যুতে মাঠ ঘোলা করাটা অবশ্যই স্বার্থসংশ্লিষ্ট কিছুর ইঙ্গিত। তবলীগ জামাত সব সময় রাজনীতির বাইরে ছিল, এখনও রাজনীতিমুক্ত রাখতে হবে। আমরা এক হয়ে কাজ করতে চাই। কিন্তু বিশ্ব ইজতেমাকে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নেয়ার যে চক্রান্ত শুরু হয়েছে তাতে আমাদের হতাশা বাড়ছে। পাকিস্তানীরা কোনভাবেই সহ্য করতে পারছে না বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা হোক। সম্প্রতি কাকরাইল মসজিদের বিষয়ে সাধারণ মুসল্লি একটি বৈঠকে বসেছিলেন। যেখানে তারা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মূল কেন্দ্র ও ইজতেমা পাকিস্তানে সরিয়ে নেয়ার চক্রান্তের ঘটনায়। এদিকে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ইতোমধ্যেই মূল কেন্দ্র দিল্লী নিজামুদ্দীন মার্কাজকে উপেক্ষা করার বিষয়ে বলা হয়েছে এটা হলে ইজতেমা বাংলাদেশে থাকবে না। জানা গেছে, পরিস্থিতির বিষয়ে কিছুদিন আগেই তবলীগের বাংলাদেশ শূরা ও সরকারকে শূরা কানাডা, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া চিঠি দিয়েছে। এসব চিঠিতে মাওলানা সাদকে যেন ইজতেমার আমির ও ফয়সালের (সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী) পদ থেকে সরানো না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। জিম্মাদার সাথিরা বলছেন, কারো অধিকার হরণ করা আইনত দ-নীয় অপরাধ। আমাদের তবলীগ আমাদের মতো চলবে।
×