ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

শৈশব এক আনন্দময় খেলার জগত

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

শৈশব এক আনন্দময় খেলার জগত

বাবা-মায়ের পুরো সময়টাই কাটে শিশুকে নিয়ে। এত পরিশ্রম, এত পরিকল্পনা, এত উদ্যোগ, এত স্বপ্ন- এর বিরাট অংশজুড়েই আছে শিশু। যে ঘরে শিশু নেই সে ঘরটিতে যেন বড় ধরনের অপূর্ণতা রয়ে গেছে। এত ভালবাসা, এত সাধনার ধন শিশু, তাকে বড় করে তোলা কিন্তু সহজ নয়। বড়রা শিশুদের কাছে যেমনটা প্রত্যাশা করেন, শিশু কিন্তু অনেক সময় তেমনটা করতে আগ্রহী থাকে না। এটা বড় হওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ। এর মাধ্যমে শিশু বড়দের প্রত্যাশা ও আগ্রহের বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। সে তার নিজস্ব সত্তা সম্পর্কে ধারণা পায়। সে প্রশ্ন করে, কেন একটি কাজ তাকে করতেই হবে তা জানতে চায়। এই অভিজ্ঞতাগুলোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে তার ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। বেশ কিছু বিষয় সে বড়দের থেকেও নেয়। সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠে তার নিজস্ব সত্তা। সে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের এবং এক ধরনের স্বাধীনতার স্বাদ পায়। শিশু যদি বাবা-মায়ের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে বিনা প্রশ্নে মেনে নিত তবে সে হয়ে উঠত বাবা-মায়ের ব্যক্তিত্বের কপি, যা মোটেই কাম্য নয়। মানব প্রজাতির বিকাশে বৈচিত্র্যের কোন বিকল্প নেই। ব্যক্তিত্বের কার্বণ কপি দরকার নেই। দরকার নতুন ধরনের মানুষ। বহু আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। এক মা তাঁর সন্তানের নিষ্পাপ সরলতায় মুগ্ধ। সন্তানকে জীবনের জটিলতার ছোঁয়া থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখারই চেষ্টা করেন মা। বাইরের বাচ্চাদের সঙ্গে বেশি মিশতেও দেন না; পাছে তারা সোনামণিকে অবাঞ্ছিত কথা শেখায়। একদিন একজন আত্মীয় মেয়ে তাদের বাড়িতে আসে, যে কিনা খুব ‘পাকা’। মা তটস্থ। পাছে সে সোনামণিকে পাকিয়ে দেয়! দুশ্চিন্তায় এক সময় মা চুপি চুপি ওদের কথা শুনতে আসেন। সবিস্ময় বুঝতে পারেন, জীবনের কোন জ্ঞানই সোনামণির অজানা নয়। সঙ্গিনীকে সোনামণি জানাচ্ছে যে, বড়দের কথা থেকে সে সবই জেনে গিয়েছে। কিন্তু বেচারি মায়ের ওপর তার ‘মায়া’ হয়। তাই ‘ন্যাকামি’ করে সে সরল শিশু সেজে থাকে। বাস্তবেও অনেক মা-বাবার এই ধরনের মোহভঙ্গ ঘটে। যে সন্তানের সব মনটা আমার আয়ত্তে আছে ভাবছি, হঠাৎ বুঝি তাকে আমি চিনি না। কখনও তা ঘটে পরিবারের ভিতরেই সন্তানের আচরণে, স্কুলের বা প্রতিবেশীর অভিযোগে, কখনও সন্তানের সমাজবিরোধী কাজের খবরে, কখনওবা ভয়াবহভাবে তার আত্মহত্যার চেষ্টায়। এই ধরনের ঘটনা শুনলে অন্যরা ভাবে মা-বাবার তরফেই কোন ত্রুটি ছিল, এমনকি মনোবিজ্ঞানীরাও তাঁদের দ্বারস্থ হওয়া মা-বাবাদের অনেক সময় বকুনি দেন সন্তানের মনের খবর না রাখার জন্য। কেউ আবার এর দায় বেশি করে চাপান চাকরিজীবী মায়ের ওপরে। ফলে তাঁদের মানসিক চাপও বহু গুণ বেড়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে এই অবহেলা সত্য হলেও বহু সময়ই কিন্তু এ দায় শুধু দায় চাপানোই। বিষয়টির ব্যাখ্যা বা সমাধান এত সহজ নয়। অনেক সময় বাবা-মায়ের অবহেলা নয়, অতিরিক্ত মনোযোগই শিশুটিকে মনস্তাত্ত্বিকের চেম্বারে হাজির করে। প্রায়ই শুনি আজকাল শিশুদের শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলা বললেই আমাদের মনে ফুটে ওঠে এক আনন্দময় খেলার জগত, যেখানে বাস্তবের দায় নেই, সময়ের সীমারেখা নেই, কল্পনা যেখানে মুক্ত, পারস্পরিক বন্ধুত্ব যেখানে এমন স্বাচ্ছন্দ্য যে, আজ আড়ি কাল ভাব করাই চলে। প্রকৃতি স্বাভাবিকভাবেই শিশুর মনকে এমন করে তৈরি করেছে যাতে সে খেলার মধ্য দিয়ে এই স্বাধীন আনন্দকে উপভোগ করতে পারে। কিন্তু এর মূল্য শুধু আনন্দেই শেষ নয়, এই আনন্দই শিশুর জীবনের লক্ষ্য ও সৃষ্টিশীলতা তৈরির মহড়া। আজকের দিনে শিশুদের আর বড়দের জগতের মধ্যে স্থানগত নৈকট্য বাড়ছে। কিন্তু তাতে মানসিক নৈকট্য বাড়বেই এমন নিশ্চয়তা নেই। আগে খেলার মাঠ সুলভ ছিল। তাই শিশুদের প্রতিটি মুহূর্ত বড়দের সঙ্গে ভাগ করতে হতো না। ছোটদের আর বড়দের জগতের মধ্যে শারীরিক দরকারের বাইরে যোগাযোগ হতো নিছক ভালবাসার কিংবা সীমিত সময়ের শিক্ষার জন্য। তার বাইরে অনেকটা বেহিসেবি পরিসর থাকত। এখন পরিবার ছোট, বাসস্থানও। সন্তান একটি, বড়জোর দুটি। ফলে ছোট্ট জায়গায় শিশুর ওপরেই মা-বাবার মনোযোগ নিবিষ্ট থাকে। তাতেও কিন্তু মা-বাবারা ছেলেমেয়েদের মনের নাগাল পাচ্ছেন তা নয়। বরং কঠিনতর সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছে ইন্টারনেটের নেশা। আজকাল অভিভাবকরা ‘সচেতন’। সন্তানের মনের খোঁজ রাখার চেষ্টা তাঁরা করেন। তার দৈনন্দিন রুটিন, খেলাধুলাকে নিজেদের বোধবুদ্ধি অনুসারে সুন্দরভাবে সাজানোর চেষ্টাও করেন। স্কুলে কী হলো খোঁজ করেন, পড়াশোনায় সাহায্য করেন, টিউশনের ব্যবস্থা করেন। পাঠ্য বিষয়ের বাইরে তাকে নাচ, গান, ক্রিকেট শেখান, যাতে শিশুর সৃষ্টিশীলতা বাড়ে। তারপরও গোলমালটা কোথায়? এক অর্থে অভিভাবকরা তাঁদের করণীয় কাজগুলো তো করছেনই অথচ ফলটা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে উল্টো। কারিকুলাম আর এক্সট্রা কারিকুলামের সাঁড়াশি চাপে শিশুটি হাঁসফাঁস, মায়েরা গলদঘর্ম, বাবারা হতাশ। এ ছবি বহু ক্ষেত্রে চেনা। বাবা-মায়েরা কেন এই এক্সট্রা কারিকুলামের শিক্ষার ওপরে এত জোর দেন? এর সবটাই তাঁদের সামাজিক সম্মানের ইচ্ছা বললে বাবা-মায়ের শুভ কামনাকে ছোট করে দেখা হয়। আসলে তাঁরা চান সন্তানের জন্য পাঠ্যের অতিরিক্ত একটা জানালা খুলে দিতে, যেখানে সে সৃষ্টিশীলতার আনন্দের খোঁজ পাবে। অথচ সৃষ্টিশীলতা কি বাড়ছে? সৃষ্টিশীলতার অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো বহুমুখী চিন্তা, অর্থাৎ ছকভাঙ্গা ভাবনা। সারা পৃথিবীতেই শিশুদের সৃষ্টিশীলতা বাড়াবার জন্য বাবা-মা ও স্কুলগুলো এখন সচেষ্ট। আজকাল শিশু, বিশেষত কিশোরদের সামনে নানা ধরনের আত্মপ্রকাশ ও প্রতিযোগিতার সুযোগ। অন্যদিকে শিশুদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধির ধরনটিও এমন যে, ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই তার সৃষ্টিশীলতা সব থেকে বেশি ডালপালা মেলার কথা। অথচ আন্তর্জাতিক সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে, তিন-চার বছরের শিশুদের মধ্যে বয়সোপযোগী ছকভাঙ্গা ভাবনার ক্ষমতা যেখানে ৯০ শতাংশের বেশি, সেখানে বয়ঃসন্ধিতে তা এসে ঠেকছে ১০ শতাংশে। এই আপাত বিরোধিতার ব্যাখ্যা হতে পারে যদি আমরা মেনে নিই যে, আমাদের সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার ধারণার মধ্যে একটা বড়সড় গোঁজামিল আছে। নিশ্চিত উত্তর আমরা জানি না; কিন্তু শিশুদের শৈশব মুছে ফেলা এর একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। প্রকৃতির সহজ স্পর্শের বাইরে দু’কামরার ফ্ল্যাটের মধ্যে শৈশবের আর পূর্ণ বয়স্কের নিরন্তর ঠোকাঠুকি লেগেই চলেছে। কিন্তু অভিভাবকরা, বস্তুত বিজ্ঞানী ও মনস্তাত্ত্বিকরা ঠিকভাবে জানেন না শিশুদের সৃষ্টিশীলতাকে রূপ দেয়ার জন্য ঠিক কিভাবে পথনির্দেশ করতে হবে। অথচ এই অজ্ঞতাকে স্বীকার করতে আমাদের ভয়। কিন্তু প্রকৃতির ওপর খবরদারি করতে না পারা কি সত্যিই এত লজ্জার? বরং শিক্ষার সেই বহু পুরনো সংজ্ঞাটিই হয়তো ঠিক। শিশু একটি চারাগাছ যাকে আমরা রক্ষা করব, কিন্তু সে বাড়বে তার নিজের মতোই। আমার ঘর সাজানোর ইচ্ছে অনুসারে চারাগাছের বৃদ্ধির পথ বেঁধে দিলে তাকে বনসাই বানানো যায়, শিকড়গুলোকে বারবার ছেঁটে দিলে সে ছোট্ট টবেও ফলন্ত হয়ে ওঠে; কিন্তু সে ফল প্রায়শ খাবারযোগ্য নয়। সে গৃহকোণের সাজ, আকাশচারী শাখা পল্লবের সৌন্দর্য় নয়। শিশুকে পথনির্দেশ করছি আমরা মা-বাবারা বা পেশাদাররা যারা অনেকে হয়তো নিজেদের জীবনটাকে নিজেদের পছন্দমতো গড়ে তুলতে পারিনি। তাই এক অর্থে অন্ধ পথ দেখাচ্ছে আর একজনকে, যার চক্ষু আছে কি-না ভাবতেই আমরা রাজি নই। এর মূলে আছে আমাদের উদ্বেগ, আর ফলত সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা। একটু অন্তর্মুখী হলেই মা-বাবারা এই উদ্বেগকে চিনতে পারেন, এর কুফলও বুঝতে পারেন। কিন্তু অনিশ্চয়তার বিকল্পকে স্বীকার করতে পারেন না। আমার সন্তানকে আমিই ঠিক পথ দেখাব এই অহঙ্কারের বদলে যদি আমরা প্রকৃতির পথ দেখানোর ওপর নির্ভর করতে পারতাম, কী ভালই না হতো। শিশুকে তো নাচগানের নির্দিষ্ট পদ্ধতি শেখানোর থেকে বেশি দরকার পথ খুঁজতে শেখানো, যাকে শিক্ষাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে শিখতে শেখা। শিখতে শেখা মানে মনকে এমনভাবে উন্মুক্ত করা যাতে জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোকে শিশু নানাভাবে ব্যবহার করার সাহস পায়। জীবনকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার এই সাহসটুকু উপদেশ দিয়ে শেখানো যায় না। শিশুর দরকার জীবনের সহজ পথ চলার অধিকার, যার অন্য নাম শৈশব উপভোগের অভিজ্ঞতা। অন্য শিশুদের সঙ্গে মেলামেশার স্বাধীনতা, প্রকৃতির কাছাকাছি স্বচ্ছন্দ বিচরণ, প্রকৃতিকে লক্ষ্য করা আর অকাজের অবসর, এর প্রধান উপকরণ। সমস্যা হলো অনেক বড়দের কাছেও অবসরের মানে টিভি দেখা বা চ্যাট করা। শিশুরা বড়দের অনুকরণ করে। স্বাধীনতা দিতে আমরা ভয় পাই। বাস্তবে বিপদের কিছু ভয় তো আছেই; কিন্তু আরও একটা কারণ হলো, আমরাই নির্ধারণ করে দিতে চাই কী করলে বা ভাবলে সন্তানের ভাল হবে, যেখানে নিজেদের ভালটাই নিখুঁতভাবে খুঁজে পাইনি। মনে রাখতে হবে ঘর সাজাতে হলে শিশু প্রয়োজন। যত মূল্যবান আসবাবপত্রের মাধ্যমেই গৃহ পূর্ণ করা হোক না কেন একটি শিশু ঘরটিকে যত জীবন্ত, আনন্দময় এবং সুন্দর করে তোলে, অতি মূল্যবান আসবাবপত্রও তার তুলনায় মূল্যহীন। তার কাছ থেকে যেন অন্যরা শিখতে পারে সে ব্যাপারে তাকে জ্ঞান দিন। আপনার সমর্থন আপনার সন্তানদের শান্ত রাখবে। যখন তারা জানবে আপনি তাদের পাশেই আছেন, তারা চমৎকার অনুভূতি অনুভব করবে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×