ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু ॥ এক বহুমাত্রিক দার্শনিক

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বঙ্গবন্ধু ॥ এক বহুমাত্রিক দার্শনিক

(গতকালের পর) কৌশলে তিনি সব করলেন, তবুও বিচ্ছিন্নতাবাদীর অপবাদ থেকে জাতিকে বাঁচালেন। তিনি প্রমাণ করলেন বাঙালীরা স্বাধীনতাকামী, বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়। ৭ মার্চ রেসকোর্সের চারপাশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র অবস্থান, আকাশে সামরিক হেলিকপ্টার ঘুরছিল শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুখ থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি শোনার অপেক্ষা। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হলো না। তবে ২৫ মার্চ এরা তার সুদসহ আদায় করেছিল। সেদিন পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনীর রিপোর্ট ছিল ‘চতুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সবাইকে বোকা বানিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে গেল আমরা কিছুই করতে পারলাম না।’ সম্ভবত এটাই নেতৃত্বের ক্যারিশমা। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা, পদ্ধতি কোন কিছুই বাদ দেননি। যারা বোঝার ঠিকই বুঝেছে। যারা বুঝেও অবুঝের মতো কাজ করেছে তাদের পরিণতি ইতিহাসই নির্ধারণ করে দিয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবন চরিত বিশ্লেষণের বেশি কিছু দরকার নেই। শুধু ৭ মার্চের ভাষণই যথেষ্ট। সেখানে তিনি বলেছেন মুক্তি ও স্বাধীনতার কথা। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ কথা দুটি ভাষণে তিনি দু’বার উচ্চারণ করেছেন- ‘আমরা যখন রক্ত দিতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না। আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’। আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব। এ সবের মধ্যেই স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধ তথা গেরিলা যুদ্ধের রূপরেখা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ভারতীয় মাউন্টেন ব্রিগেডের মেজর জেনারেল সোয়ান সিং ওভান আমাদের প্রশিক্ষণে একটা মন্তব্য করেছিলেন- ও I have never heard nor read such a historical speech and such a mighty word like Insallah. নেতাজী সুভাষ বসু বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’। আর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা যখন রক্ত দিতে শিখেছি কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ লক্ষণীয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এখানে কতটা অগ্রগামী ছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে ২০০১ সালে ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ উৎসবে এক আলোচনায় জানা যায় নৌ ও বিমান বাহিনীর অফিসার র‌্যাংকের কিছু বাঙালী সদস্য সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার পরিকল্পনা নিয়ে ভারত সরকারের সাহায্য কামনা করে। ভারত সরকার তাদের কাছে সিভিল নেতৃত্বের কথা জানতে চাইলে তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম প্রস্তাব করে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দেখ আমার দেশের মানুষ এখনও স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়নি। দেশের মানুষকে আগে জাগাতে হবে। তারাই একদিন স্বাধীনতা চাইবে। তা না হলে সশস্ত্র পথে স্বাধীনতা আসবে না।’ তিনি প্রসঙ্গক্রমে পলাশীর যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে বলেন, পলাশীতে নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং রবার্ট ক্লাইভের মধ্যে যখন যুদ্ধ চলছিল পাশে ভাগীরথীর নদীর অপর তীরে কৃষকরা ধান ক্ষেতে কাজ করছিল। তারা জানত না কি হচ্ছে। তাদের কাছে সেটা ছিল রাজায় রাজায় যুদ্ধ। জনতার সম্পৃক্ততা থাকলে ফলাফল অন্যরকম হতো। উদাহরণ টানলেন মাস্টারদা সূর্যসেন চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড় ৩ দিন দখল করে রেখেও স্বাধীনতা আনতে পারেননি। কারণ জনসম্পৃক্ততা ছিল না। অতঃপর নেতাজী সুভাস বসু জাপানের সহযোগিতায় আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে ইংরেজকে একটা ধাক্কা দিতে পেরেছিলেন, ক্ষুদিরাম বসুরা ইংরেজদের ঘুম হারাম করতে পেরেছিলেন; কিন্তু জনগণের সম্পৃক্ততা ও সচেতনতা না থাকায় স্বাধীনতা আসেনি। তাই আগে আমি আমার জনগণকে তৈরি করি। তারাই একদিন স্বাধীনতা চাইবে। যদি সেদিন আসে ভারত বা ত্রিপুরা সরকারের সেদিন সাহায্য লাগবে। বাস্তবে তাই হয়েছিল। কত বড় দার্শনিক ও দূরদর্শিতা থাকলে এটা সম্ভব আজ তা বিশ্লেষণের দিন এসেছে। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এক কোটি বাঙালীর সঙ্গে লক্ষাধিক মুক্তিযোদ্ধাও ভারতে গিয়েছিলেন। তোফায়েল আহমেদের ভাষায় ছাত্র যুবকরা ভারতে গিয়ে দেখে আগে থেকেই তাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা আছে। সবার থাকা-খাওয়া, ট্রেনিং, অস্ত্র স্বাধীনতার বা মুক্তিযুদ্ধের জন্য যা প্রয়োজন সবই আছে। নেতৃত্ব? তাও আছে। ট্রেনিং সেন্টারে যখন মাইকে বেজে উঠত ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ বাংলার স্বাধীনতা তাঁর জীবনে কেমনভাবে গ্রথিত হয়েছিল তা ভাবতেও অবাক লাগে। বাংলা তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ দুটি মোটা দাগে বিভক্ত। প্রথম পর্ব স্বাধীনতা সংগ্রাম, দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত পর্ব মুক্তিযুদ্ধ। ভাবতে অবাক লাগে বঙ্গবন্ধু তার সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোতে কোনদিন পূর্ব পাকিস্তান শব্দটি উচ্চারণ করেননি। তাঁর প্রকৃষ্ট প্রমাণ মিলে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে। তিনি বলেছিলেন ‘এই বাংলার’। সেদিন পাকিস্তানের শোষণ-নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তেইশ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস মনুষ্য নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। ‘লক্ষণীয় যে, তিনি বারবার বাংলা শব্দটি উচ্চারণ করলেও কখনও পূর্ব পাকিস্তান শব্দটি উচ্চারণ করেননি। এটাকে বলে আদর্শ। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি রাজনীতির কবি হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন। এ উপমহাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি স্তরে মহান নেতাদের বহু ভাষণ, আহ্বান রয়েছে। কিন্তু কোনটিই বিশ্ব সভায় স্থান পায়নি। এমনকি শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদাও পায়নি। সে অনন্য স্বীকৃতি মিলেছে ৭ মার্চের ভাষণে। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, মধ্যযুগের কবি, গীতিকার, বাউলরা তাদের রচনা বা সৃষ্টির মাঝে নিজেদের নাম যেভাবে ব্যবহার করতেন, যেমন মহাভারতের কথা অমৃত-সমান, কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান। এখানে কাশীরাম দাস নিজের পরিচয় ব্যক্ত করে সৃষ্টি ও স্রষ্টার মিলন ঘটিয়েছেন। তেমনি লালনের প্রতিটি গানে, হাছন রাজার প্রতিটি গানে, এমনকি রাধারমণ, সাম্প্রতিককালে শাহ আবদুল করিমের প্রতিটি গানে গীতিকার বা কবির পরিচয় সহজ-সরলভাবে এবং যথার্থ ব্যঞ্জনায় স্থান পেয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণ যদি যথার্থই একটি রাজনৈতিক কবিতা হয় তবে সেখানেও আমরা সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করি কবি তাঁর কবিতার মাঝে কালীদাস, হাছন, লালন, রাধারমণ, শাহ আবদুল করিমদের মতো নিজের নামটি যোগ করতে ভুল করেননি। যেমন তিনি উচ্চারণ করলেন- ‘১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স ডেকেছেন কিসের RTC? রক্তের দাগ শুকায় নাই। আর সেই তাজা রক্তের ওপর পা দিয়ে আর কিছুতেই RTC-তে শেখ মুজিব বসতে পারে না।’ ৭ মার্চের ভাষণটা যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই দিয়েছেন তার জ্বলন্ত স্বাক্ষর রেখে দিলেন। ৭ মার্চের ভাষণের পরে তিনি যে অসহযোগের ডাক দিলেন আজ থেকে খাজনা দেবেন না, তাতে তিনি মহাত্মা গান্ধীর চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। ২৬ মার্চের রাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে, সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিয়ে তিনি বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ট্রো এবং চেগুয়েভারার সমকক্ষ হয়ে রইলেন। তাই তো ক্যাস্ট্রোর ভাষায় ‘আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি’। ’৭০-এর নির্বাচনের ইস্তেহার ঘোষণার পাশাপাশি একটি পোস্টার/লিফলেট ছাপা হয়েছিল ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ শিরোনামে। পাকিস্তানের দুই অংশের বৈষম্যের চিত্র এতে স্থান পেয়েছিল। যা ছিল বাস্তব। কারণ পাকিস্তান সরকার এর কোন প্রতিবাদ করতে পারেনি। সেদিনও বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান নয়, এমনকি নিছক শুধু বাংলাও নয় উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বলে। একটা মানুষের রক্তে-মাংসে, অস্থি-মজ্জায় যে অবিনাশী চেতনা তা বিনাশের ক্ষমতা কি কারও আছে? নাকি ছিল? পৃথিবীর সব দেশেরই স্বাধীনতা দিবস আছে, কিন্তু বিজয় দিবস আছে কয়টি দেশের? এ সবের মূলে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। তবে তিনি শুধু পরিকল্পনাই করেননি, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বাস্তবমুখী পদক্ষেপও নিয়েছেন। স্বাধীনতার পর বিদেশে গিয়ে যত ভাল কিছু দেখেছেন তা নিজের দেশে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। মানুষের তথা নিজের দেশের মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম ভালবাসা ও অগাধ বিশ্বাস। তাইতো আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে সাংবাদিকরা তীক্ষè প্রশ্ন করে বলেছিলেন ‘ আপনার বড় গুণ কি’? তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমার মানুষকে ভালবাসি।’ ‘আপনার বড় দোষ কি?’ অবলীলায় তাঁর জবাব ছিল ‘আমি আমার মানুষকে বেশি ভালবাসি।’ পাকিস্তান আমলে বাঙালীদের সামরিক বাহিনীতে ভর্তি করা হতো না। অপবাদ ছিল এরা শুধু ভেতো বাঙালীই নয়, ভীতু বাঙালীও। বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি নির্দেশে এই ভেতো ও ভীতু বাঙালীর কাছেই বিশ্বসেরা বলে দাবিদার পাকিস্তানী সেনারা হাঁটু গেড়ে মাথানত করে লজ্জাজনক পরাজয়বরণ করেছিল। এই যে ইতিহাসের স্রষ্টা তিনি কি শুধুই একজন রাজনীতিক ছিলেন? না, মহাকাল তাঁকে একজন রাজনীতিবিদ, রাজনীতির অমর কবি, বহুমাত্রিক রাজনৈতিক দর্শনের বহুমাত্রিক রাজনৈতিক দার্শনিক হিসেবেও অভিষিক্ত করেছে। ১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি কুমিল্লার এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘অনেক ব্যথা, অনেক দ-, অনেক জুলুম, অনেক মামলার আসামি, অনেক কারাগারের নির্যাতন- আমি শুধু নই, হাজার হাজার কর্মী সহ্য করে বাংলার মাটিকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রাম করেছে। তোমাদের এখন একটা জিনিস মনে রাখা দরকার, দেশ যখন আমাদের আছে, মাটি যখন আমাদের আছে, বাংলাদেশের সোনার মানুষ যখন আছে, যদি আমরা সোনার ছেলে পয়দা করতে পারি ইনশাল্লাহ আমার যে স্বপ্ন সোনার বাংলা তা একদিন হবেই। আমি দেখে যাবার না পারি, কিন্তু ইনশাল্লাহ হবে।’ (সমাপ্ত) লেখক : সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×