ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবাসীর ইলিশ দিন

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

প্রবাসীর ইলিশ দিন

এই নগরে মাছের আকাল সে কথা কোন শত্রুও বলতে পারবে না। কারণ হাডসন আর ইস্ট এমন নামের দু’দুটো নদী বইছে আমাদের নিউইয়র্ক নগরীর কোলঘেঁষে। হিসাব মতে দুশ’টিরও বেশি প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় সেই নদীগুলোতে। তারপর এগুলোর সংযোগস্থলে রয়েছে সুবিশাল আটলান্টিক মহাসাগর। সেখানে সামুদ্রিক মাছ ছাড়া আরও কিছু মাছ থাকে যেগুলো মূলত আটলান্টিকেই ঘোরাঘুরি করে এবং বছরে না হলেও একবার বা দুবার উপস্থিত হয় নদীর জলে। এদেশে নানা মৎস্যের নানা নামÑ সিহর্সেস, সানফিশ, ফ্ল্যান্ডার্স, বাফেলো। আরও আছে ব্ল্যাক ব্যাশ, পার্চ, তেলাপিয়া, ক্যাটফিশ- যেটা দেখতে স্বাদে আমাদের মাগুর মাছ, আরও কত কত নাম। এ প্রসঙ্গে বলতে হয় আমেরিকান স্যাডের কথা, যেটা দেখলে বাঙালীর জিভের জল আপনি বেরিয়ে আসবে। কারণ এটি দেখতে একেবারে যেন নধরকান্তি ইলিশ। কিন্তু সব সত্ত্বেও মাছের জন্য কেমন এক হাপিত্যেশ নিয়েই বহু বাঙালীর জীবন চলেÑ ওয়াটার ওয়াটার এভরি হোয়ার এ্যান্ড নট এ ড্রপ টু ড্রিঙ্ক!। প্রবাসে প্রথম এসে মাছের বিরহ ব্যথায় রবি কবির অনুকরণে একছত্র কবিতা লিখেছিলাম- ‘কোথা সে কৈ সখী কোথা সে রুই, কোথা সে বেলিফুল চামেলী জুঁই।’ সারারাত ধরে নদী সমুদ্রে মাছ ধরে জেলেরা আর ভোর না হতেই বিক্রির জন্য পাইকাররা নিয়ে যায় পাইকারি বাজারে। সেখান থেকে কেনাকাটা করে বাজারে নিয়ে যায় দোকানিরা। এখানে একটা মজার কথা বলে নেই আমাদের নিউইয়র্কে যত মৎস্য দোকান তার অধিকাংশ মালিকই চীনাম্যান। তবে চাইনিজরাই কি এ শহরে একমাত্র মোছলিখোর? পরাধীনতার আমলে নানা রকম গালমন্দের সঙ্গে মোছলিখোর বলে বাঙালীদের গাল পাড়ত পাকিস্তানীরা। ওটা মনে হয় আঙ্গুর ফল টকের মতো। বাংলার নদী খাল-বিল-পুকুর এতসব জলাশয় পশ্চিমাদের থাকলে তবেই না ওরা মাছ খেতে পারত! সে যাই হোক, ফিশস্টোরের অন্যতম ক্রেতারা যে ওই নাক চ্যাপ্টা জাতি তাতে কোন সংশয় নেই। তবে ওদের দোকানে আজকাল বঙ্গ দশ থেকে আগত বহু মানুষই আসে।তবে অবাক করার ব্যাপার বাঙালী ছাড়া উপমহাদেশের আর কোন জাতিকে ফিশস্টোরে আমি তো কখনও দেখিনি। ভারতীয় চেহারার যেসব মানুষ দেখা যায় তারা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান। একই এলাকার কালো মানুষদেরও দেখা যায় প্রচুর মাছ কিনতে। রাশিয়ানরাও মাছ খায়-আমার এলাকায় তাদের একটা রুই জাতীয় বিশেষ মাছ কিনতে দেখি যার নাম কার্প, দামেও সস্তা। কিন্তু কোন আমেরিকান কোন শ্বেতাঙ্গ অথবা কালো মানুষ কি আসে এসব দোকানে? উত্তর হবে-নৈব নৈব চ! ধুর সেটাই বা কি করে হয়, কালো বা শ্বেতাঙ্গরা কি মাছ খায় না? এদেশে মাছের গাড়িতে লেখা থাকে ইট ফিশ লিভ লং। টিভিতেও ডাক্তার কিংবা পুষ্টিবিদদের কণ্ঠে প্রায়শই শোনা যায় মাছ একটি অতি চমৎকার স্বাস্থ্যসম্মত খাবার। তারপরও তাদের খাবার তালিকা থেকে কি মাছ বাদ? মাছ তো আমার অনেক সহকর্মীদের মুখে রান্না করার কথা শুনেছি। কিন্তু ফিশস্টোর থেকে আঁশসহ মাছ কিনে সেসব পরিষ্কার করা? তারপর রান্না করে কাঁটা বেছে খাওয়া? আমার কায়দা-কানুন শুনে তারা ভিরমি গেছে-ইম্পসিবল। দীর্ঘ কাজের জীবনে শুনেছি যারা রান্না করে তারা সুপার মার্কেট থেকে কিনে নেয় পরিষ্কার করা কিংবা কাঁটা বাদ দিয়ে ফিলে করা মাছ। যেগুলো ধুয়ে শুধু পছন্দমতো মসলা মাখিয়ে ফয়েল পেপারে মুড়িয়ে ফ্রিজে রেখে দেয়া হয়। কাজ ফেরত বাড়ি এসে ফয়েল পেপার শুদ্দু ওভেনে বেক করতে দিয়ে এবার রেফ্রিজারেটর থেকে ব্রেড বের করে স্নান শেষে আহারে বসবার আগে শুধু সালাদ তৈরি করে নেয়া। পুরুষ মানুষের বাজারের বিষয়ে কোন কথা না বলাই ভাল। তাই গ্রোসারি করার সঙ্গে বাঙালী বাজারের সওদাটি করার কাজ আমি নিজেই সাগ্রহে বেছে নিয়েছি। নিউইয়র্ক নগরীর প্রতিটি কাউন্টির কোণে কোণে রয়ে গেছে যেন লিটল বাংলাদেশ। আমার এলাকা থেকে মাত্র চারটি সাবওয়ে স্টেশনের পর সেই আদি জ্যাকসন হাইটস যাওয়া যায়। যেটি আসলে কেবল বাঙালীর নয় পুরো উপমহাদেশের। গত হপ্তাঅন্তের আগে আগে সেখানে গিয়ে একটা গ্রোসারি থেকে মুরগির অর্ডার দিয়ে রাস্তায় বেরুতেই চোখ গেল ওপারের এক দোকানের দিকে, যেখান থেকে একদিন একটা ভাল ইলিশ কেনা হয়েছিল। আজ ইচ্ছে তেমন ছিল না তারপরও এক রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে এগোলাম পায়ে পায়ে। বেশির ভাগ সময়ে চিনে দোকান থেকে মাছ কেনা হয়- কাল সেখানে যাবার পরিকল্পনা তার পরেও যায় যায় করে ডাকছে চেনা সুর। তাই একটু ঘুর ঘুর করে ফিরে আসব কিনা ভাবছিলাম। কিন্তু যখন গ্রোসারির এক ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন ‘আপনি কি কিছু কিনতে এসেছেন’ তখন মনে মনে দু-একবার নিজেকে না না বলেও মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল... ‘ইয়ে এই একটা ভাল ইলিশ খুঁজছিলাম...’। যারা মাছ-মাংস কাটাকাটি করেন তিনি তাদের একজনকে ডেকে বললেন ‘ওনাকে একটা ভাল ইলিশ মাছ দেনতো’। আজকাল ঝাঁকে ঝাঁকে ফ্রোজেন ইলিশ আসে দেশ থেকে। সব বাংলাদেশী গ্রোসারিতেই আজকাল ইলিশের প্রাচুর্য। ইলিশের চরিত্র অনুসারে বরফের মধ্যে থেকেও যার স্বাদ থাকে প্রায় অক্ষুণœ। জাতপাত দেখেশুনে নিতে পারলে সেটারই ‘ওয়াও ‘সুস্বাদ! এখানে সাইজ অনুসারে ইলিশের ৩-৪ রকম দাম আছে। বেছে দেয়া জন বললেন, স্বাদ চাইলে অন্তত পাউন্ড ১২ ডলারেরটা নেন। এর চেয়ে বড়টা চাইলে ১৬ ডলার হবে। হাডসন ইস্টের বিশেষ জলজপ্রাণীগুলোর দাম তুচ্ছ করে দু’চোখের উজ্জ্বলতা নিয়ে দেখছিলাম বাংলাদেশের নানা সাইজের রকমারি ইলিশ। এদেশের সবচেয়ে দামী স্যামন মাছের ফিলে (কাঁটা কুটো ছাড়া) কিনতে গেলে পড়বে ৮ ডলার-পাউন্ড। প্রায় দোকানেই হাডসন নদীর তাজা তাজা মাছ কেনা যায় এক-দুই ডলার থেকে শুরু করে। ওইসব দোকানে যেসব জিওল মাছ পাওয়া যায় সেগুলো ৩-৪ ডলারের বেশি নয়। শুরুতেই বলেছিলাম স্যাড মাছের কথা-রূপ লাবণ্যে সে যেন ইলিশ তবু যার দাম তিন ডলারের ওপরে নয়। কিন্তু সেই শৈশবে শোনা একটা গানের কলি ছিল ‘রূপ যদি না মানিক হলো কণ্ঠে দিয়ে মনিহার, চোখ ভোলানো জায়গো শুধু মন ভোলানো যায় না আর। স্যাডের শুধু চোখ ভোলানোই সার- ইলিশ ভেবে জিভের তলায় পড়লে ভেঙ্গে চুরমার হবে সব আবেশ। মাছ কাটা ভদ্রলোক খুঁজে পেতে যেটা বের করলেন সেটার ওজন ৩ পাউন্ড অর্থাৎ দেশের হিসাবে দেড় কেজি এবং মূল্য ৩৬ ডলার। দেশের মাছ বাজারের মতো দরাদরির অবকাশ তো নেই- ওনারা যেটা বলবেন তাই সই। বাড়ির কর্তা তো এর আগে জ্যাকসন হাইটস থেকে বাড়ি এসেছিলেন ৫০ টাকা দিয়ে ইলিশ কিনে। ল্যাজ মুড়ো সেগুলোর পাশাপাশি কিছু টুকরো বাদে গাদা-পেটির মিলিত একটি টুকরো তিনবেলা সাধ মিটিয়ে খাওয়া গেছে। আজকেরটা হয়ত দুবেলা চলবে। ভদ্রলোক ইলিশ কাটার আগে জিজ্ঞেস করলেন- পেটি-গাদা একসঙ্গে হবে? বলি-অবশ্যই। এরপর পাশের ইন্ডিয়ান দোকান থেকে লাউ ঝিঙে তো কিনলাম ৬ ডলারে। এরপর মুরগি পিকআপ করতে গেলাম। -মুরগির দাম কত হলো ভাই? -আপনার তিনটি মুরগির দাম ২১ ডলার। দু-হাতে গ্রোসারির ব্যাগ নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়ে মনে মনে অঙ্কের কাঁচা মাথাটা নিয়েও যোগ বিয়োগের হিসাবটা না কষে পারলাম না। ৩টা মুরগি এবং লাউঝিঙে মিলে ওজন হলো ১৫ পাউন্ড এবং দাম ২৭ ডলার আর একটা ইলিশ যার ওজন ৩ পাউন্ড মূল্য ৩৬ ডলার। শেষপর্ব : প্রতিদিন তো এই প্রবাসে ইলিশ মাছটি খাওয়া হয় না- হলে হয় কালেভদ্রে। তাই এই প্রবাসে যেদিন আমাদের ইলিশ মাছ দিয়ে রসনা তৃপ্তির সুযোগ আসে সেদিন আসে বেশ ত্বরিত করেই। প্রতিদিন তো খাওয়া হয় স্বাস্থ্যসম্মত ব্রাউন রাইস হলেই ইলিশ দিনে রান্না হয় দুধ-সাদা বাসমতি চালের ঝুরঝুরে ভাত। আমাদের মতো জন্ম বাঙালীদের ডেলিকেসি হলো এই ইলিশ মাছ! ভাঁপা নয় পাতুরি নয়- নানির খুব সাধারণ রেসিপি ধরে রান্না হলো গায়ে গায়ে মাখা দু’টুকরো গাদা-পেটির ইলিশ ঝোল। এর সঙ্গে সঙ্গত করল ঝুরি ঝুরি মচমচে আলুভাজি। সর্ষে দিয়ে লাউটা হলো বটে কিন্তু না হলেও ক্ষতি কি ছিল! প্রতিবার ইলিশ রান্না শেষে ভাবি এমন সুখাদ্য কি নিত্যদিনের বাসন-কোশনে খেতে আছে? আমার তো আবার শপিং সেন্টারের নজরকাড়া বাসনের দিকে সদাই দৃষ্টি। সেদিন পরিবেশনের জন্য বের করি সৌখিন কোন ডিশ প্লেট গ্লাস। হ্যাঁ, দিনটা অবশ্যি নির্ধারিত হয় উইকএ্যান্ডের ছুটিতে। লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী
×