ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

প্রযুক্তি গবেষণা ও মানবিক বাংলাদেশের সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

প্রযুক্তি গবেষণা ও মানবিক বাংলাদেশের সম্ভাবনা

সম্প্রতি সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ ড. ইয়াসমিন হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একদল গবেষক ‘ননলিনিয়ার অপটিকস’ পদ্ধতির মাধ্যমে মানবদেহে ক্যান্সারের প্রাথমিক উপস্থিতি শনাক্তের উপায় বের করেছেন। খোঁজ-খবর নিয়ে আমি যতদূর বুঝতে পেরেছি এই পদ্ধতি ব্যবহার করে রক্ত-নমুনায় উচ্চ ক্ষমতার লেজার রশ্মি ফেলে রক্তের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা হবে। কয়েক সেকেন্ডের এই পরীক্ষায় শরীরে ক্যান্সারজনিত কারণে রক্তের পরিবর্তন কী মাত্রায় ঘটেছে গবেষকগণ এখন তার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করবেন। তাঁরা আশা করছেন আগামী বছরের মধ্যে তাঁরা রক্ত পরীক্ষার ব্যয়-সাশ্রয়ী ডিভাইসটির পূর্র্ণাঙ্গ রূপ তৈরি করে ফেলবেন। পদার্থবিদ্যার মৌলিক গবেষণায় এই কাজটি যত বড় সাফল্যই হোক বাংলাদেশের চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নয়নে প্রযুক্তি ব্যবহারে এর গুরুত্বও কিন্তু কোন অংশে কম নয়। ক্যান্সার নিয়ে গত ১০ বছর গ্রাম পর্যায়ে কাজের কারণে আমি এই খবর জানতে পেরে খুবই আশ্বস্তবোধ করছি ও ড. ইয়াসমিন হকসহ তাঁর সব সহকর্মীকে অভিনন্দন জানাই। আমার আশ্বস্তবোধের প্রধান কারণ এই গবেষকদল চিন্তা করেছে ক্যান্সার নির্ণয় নিয়ে। আমরা সবাই জানি, এখন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য জগতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে অসংক্রামক রোগ, যার মধ্যে ক্যান্সার অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১২ সালের হিসাবে (যা ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে) বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর শুধু নতুন ক্যান্সার রোগীর সংখ্যাই প্রায় ১৪ মিলিয়ন। প্রায় ৯ মিলিয়ন মানুষ ক্যান্সারে মারা যায়। গড়ে ৩৩ মিলিয়ন মানুষ ক্যান্সার রোগ নিয়ে বাস করছেন। এই মৃত্যুর হার এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মা রোগের চেয়েও বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশঙ্কা প্রকাশ করছে যে, মাত্র দুই দশকের হিসেবে শতকরা ৭৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্যান্সারে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা বছরে ১৪ মিলিয়ন থেকে ২২ মিলিয়ন হবে, যা হবে বিশ্ব উন্নয়নের জন্য এক বড় হুমকি। কারণ, শুধু ক্যান্সারেই মৃত্যুর হার বেড়ে দাঁড়াবে শতকরা ৪৫ ভাগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অপর এক হিসাবে ২০১১ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ক্যান্সারসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। অপরদিকে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞান এর সর্বাধিক সুযোগ নিতে তৎপর। জাতিসংঘের ২০০৩ সালের জেনেভা ঘোষণাপত্রের আলোকে বিশ্বব্যাপী যে ১১টি এ্যাকশন লাইন দেশগুলো মেনে চলছে তার মধ্যে ৭ নম্বরে উল্লিখিত ‘জীবনের সকল স্তরে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বাধিক ব্যবহার’ শীর্ষক কর্মসূচীর অন্যতম হলো ‘ই-হেলথ’। দূরসেবা কার্যক্রম নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রচুর গবেষণা করছে ও অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয়েছে। কম খরচে ক্যান্সার নির্ণয়ে দুনিয়ার নানা দেশে নানারকম গবেষণা হচ্ছে, যার অনেকগুলো সফল হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য সেসবের ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আশার কথা এই যে, বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ও গবেষকগণ এই নিয়ে কাজ করছেন। আমার জানামতে বিদেশে অনেক বাংলাদেশী গবেষক আছেন যারা নানা ক্ষেত্রে নিজেদের সাফল্য এনেছেন। বিশেষ করে চিকিৎসা জগতে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশী চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সুনাম ও সাফল্য অনেক বেশি। প্রয়াত অধ্যাপক ডাঃ এবিএফএম করীমের নাম যাঁরা জানেন তাঁদের জানা প্রয়োজন যে, প্যালিয়েটিভ স্তন ক্যান্সার চিকিৎসায় ‘এডমন্টন সিম্পটম এ্যাসেসমেন্ট মডেল স্কেল’ তৈরি ও জনপ্রিয়করণে তার ভূমিকা বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে মর্যাদা এনে দিয়েছে। তাঁর ও তাঁর বন্ধু বিশ্বখ্যাত মার্কিন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাঃ রিচার্ড লাভের ধারণা ও উৎসাহে বাংলাদেশেরই একদল প্রবাসী কম্পিউটার বিজ্ঞানী যুক্তরাষ্ট্রের মার্কুয়েট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. শেখ ইকবাল আহমেদের নেতৃত্বে তৈরি করেছেন ‘এডমন্টন সিম্পটম এ্যাসেসমেন্ট মডেল স্কেল’ ব্যবহারের মোবাইল এ্যাপ, যা এখন বিশ্বব্যাপী একটি অতি সাশ্রয়ী মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রফেসর করীম রিচার্ড লাভকে ২০০৬ সালে বাংলাদেশে এসে ক্যান্সার নিরাময়ে গবেষণা কাজ করতে আহ্বান জানান ও দুজনে মিলিত উদ্যোগে স্তন ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের উপযোগী চিকিৎসা গাইডলাইন তৈরি করেন। সেই থেকে রিচার্ড লাভের মতো বরেণ্য ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের ক্যান্সার চিকিৎসা উন্নয়নে প্রধানত খুলনা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, যশোর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে কাজ করেছেন। তিনি খুলনা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ও উদ্ভাবনী গবেষণায় ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। ডাঃ লাভ এখন প্রফেসর ইকবালকে উৎসাহ দিচ্ছেন ও অনুদান দিয়েছেন কী করে নন-ইনভেসিভ রক্ত পরীক্ষা বা রক্ত না নিয়ে ভিডিও করে রক্তের হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করা যায়। প্রফেসর ইকবাল ইতোমধ্যে বের করেছেন মোবাইল ফোনে দশ সেকেন্ড ভিডিও করে এই পরীক্ষা সম্ভব। ডাঃ লাভ এবং প্রফেসর ইকবাল আরও একটি গবেষণা কাজে হাত দিয়েছেন, যাতে মোবাইল ফোনেই রেটিনার ছবি তুলে রক্তচাপের পরীক্ষা করা যায়। শুনেছি প্রফেসর রিচার্ড লাভের শর্ত একটাই- গবেষণা কাজে যুক্ত হবে শুধু বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই আর এর ফলাফল যাবে প্রধানত বাংলাদেশে ব্যবহারের জন্য। প্রবাসী চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ চিকিৎসা বিজ্ঞান গবেষণায় যুক্ত। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে তাঁদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা নেই ও তাঁদের মেধা ব্যবহারের তেমন কোন পরিকল্পনা আমরা নিতে পারিনি। বাল্টিমোরে একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন যার নাম ডাঃ রফিক আহমেদ, যিনি জাপান, যুক্তরাজ্য ও পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে হৃদযন্ত্রের বিদ্যুত প্রবাহ (কার্ডিয়াক ইলেক্ট্রো ফিজিওলজি) নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং নিজ উদ্যোগে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, যাতে তাঁরা দেশে ফিরে হৃদযন্ত্রের বিদ্যুতপ্রবাহজনিত রোগের চিকিৎসা দিতে পারেন। সুযোগ পেলেই ডাঃ রফিক নিজ খরচে প্রতি বছর একাধিকবার দেশে আসেন এবং ঢাকা ও দেশের নানা প্রান্তের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেন। গত বছর নবেম্বরে আমি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের পরিচালক ডাঃ মাহমুদ-উজ-জাহান যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি উচ্চমানের বায়োল্যাব পরিদর্শনে গিয়ে ভার্জিনিয়ার ইনোভা ল্যাবে পাই এর ব্যবস্থাপক ডাঃ মইন আহমেদকে। আলোচনাকালে তিনি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারপ্রধান বায়োল্যাব স্থাপনের চিন্তা করছেন জানতে পেরে সকল প্রকার সহযোগিতা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ডাঃ মইন মনে করেন অন্তত ২০-২৫ জন প্রবাসী বায়োল্যাব বিশেষজ্ঞ তিনি বাংলাদেশে কাজ করতে সংযুক্ত করতে পারবেন। এরকম দেশ অন্তপ্রাণ ডাঃ মইন বা ডাঃ রফিকদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। আমাদের দরকার শুধু এদের খুঁজে বের করা ও দেশের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া। চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় সবচেয়ে বড় সঙ্কট অর্থ। আমাদের দেশে গবেষণা কাজে বরাদ্দ খুব কম। বর্তমান সরকার এই বিষয়ে যথেষ্ট সজাগ ও সরকারপ্রধান নিজে গবেষণা কাজে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। কিন্তু এসব কাজের কোন একাডেমিক ফলো-আপ থাকে না বলে অধিকাংশ গবেষণা ফলাফল কেবল পেপার রচনায় সীমাবদ্ধ থাকে, এসবের প্রয়োগ তেমন একটা দেখা যায় না। কৃষি ক্ষেত্রে ও জীববিজ্ঞানের কিছু শাখায় আমাদের বেশ কিছু গবেষণা ইতোমধ্যে অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। পাটের জিনোম সিকুয়েন্স উন্মোচনে প্রবাসী বাংলাদেশী অকাল প্রয়াত গবেষক মাকসুদ আলমের পথ ধরে সম্প্রতি ঢাকা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী-গবেষক প্রবাসী বাংলাদেশী গবেষক ড. মং সেনো মারমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইলিশ মাছের জিনোম সিকুয়েন্স উন্মোচন করেছেন। এর আগে গমের ক্ষতিকারক ব্লাস্ট রোগের জন্য দায়ী ফাঙ্গাসের জীবন রহস্যও উন্মোচিত হয়েছে আমাদের দেশেই। আমাদের জন্য এসব অর্জন নিঃসন্দেহে গৌরবের। এখন যেটা জরুরী তা হলো আমাদের গবেষকদের এসব উদ্ভাবনের প্যাটেন্ট নিশ্চিত করা। আমাদের দেশের প্যাটেন্ট প্রথা দুর্বল ও বিশ্ব স্বীকৃত নয়। তাছাড়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে আমাদের দরকার যৌথ অঙ্গীকারে প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা। এতে বিস্ময়ের আশঙ্কা যে নেই তাও নয় আমাদের উদ্ভাবন বা জীবন রহস্য উন্মোচনের ফলাফল অন্য কেউ নিজেদের করে নিয়েও নিতে পারে, যদি আমরা আমাদের বিজ্ঞানীদের কাজের প্যাটেন্ট ও মেধার স্বীকৃতির নিশ্চয়তা দিতে সতর্ক না থাকি। আসন্ন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন। এক ফাঁকে ঘণ্টাখানেক সময় বের করে যদি তিনি প্রবাসী বাংলাদেশী গবেষক, চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বসেন এবং দেশের কাজে নিজেদের মেধা আরও সমন্বয় করে কিভাবে দেশের জন্য তাঁরা উন্নয়ন সহায়ক হতে পারেন সে পরামর্শ দেন আমার বিশ্বাস প্রবাসীদের মধ্যে একটি বড় অংশ এতে উৎসাহিত হবেন। আর এতে মানবকল্যাণে আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় সম্ভাবনার স্বীকৃতি বিশ্ব দরবারে আরও উন্মুক্ত হবে, যা মানবিক বাংলাদেশ গঠনে প্রেরণা দেবে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্যে তথ্য-প্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×