ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অর্থনৈতিক অঞ্চলে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করতে চায় ভারত

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

অর্থনৈতিক অঞ্চলে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করতে চায় ভারত

এম শাহজাহান ॥ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে ভারতীয় উদ্যোক্তারা বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এছাড়া লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় দেশের অবকাঠামো খাত উন্নয়নে আরও ভূমিকা রাখতে চায় বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। এ লক্ষ্যে চলতি মাসে দেশটির বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসছে। ওই সময়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য-বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি অমীমাংসিত বেশকিছু ইস্যু নিয়ে সরকার টু সরকার পর্যায়ে আলোচনা করা হবে। এছাড়া দুদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যেও একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়তে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় গত আট বছরে প্রথম ও দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিট বা এলওসি চুক্তির আওতায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি করা হয়। তৃতীয় এলওসির আওতায় গত বছর আরও সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি করা হয়েছে। সবমিলিয়ে ভারত থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ হিসেবে পাওয়া যাবে। যা দিয়ে দেশের বড় ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি বাড়বে। একই সঙ্গে রফতানি বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রীর এই সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছে সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী চলতি সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ সফরে আসছেন এটি নিশ্চিত। ইতোমধ্যে ভারতের হাইকমিশন থেকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত করা হয়েছে। তার এই সফরের সময় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। ভারতীয় উদ্যোক্তারা, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ করতে চান। মূলত বিনিয়োগ সম্ভাব্যতা যাচাই করতে প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ সফরে আসছে। এছাড়া বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত যেসব বাধা ও সমস্যা রয়েছে তা নিয়ে এবার আলোচনা করা হবে। আশা করা হচ্ছে, প্রতিবেশী এই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করার উদ্যোগ থাকবে এবারের সফরে। জানা গেছে, ভারতীয় ঋণে দেশের বড় ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এগুলো হচ্ছে- রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে বিদ্যুত বিতরণ অবকাঠামো উন্নয়ন, পায়রা বন্দরের বহুমুখী টার্মিনাল নির্মাণ, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার ও তীর সংরক্ষণ, বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত দ্বৈতগেজ রেলপথ নির্মাণ, সৈয়দপুর বিমানবন্দর উন্নতকরণ, বেনাপোল-যশোর-ভাটিয়াপাড়া-ভাঙ্গা সড়ককে চার লেনে উন্নীত করা, চট্টগ্রামে কন্টেনার টার্মিনাল নির্মাণ, ঈশ্বরদীতে কন্টেনার ডিপো নির্মাণ, কাটিহার-পার্বতীপুর-বরনগর দিয়ে দুদেশের মধ্যে বিদ্যুত বিতরণ লাইন তৈরি, মংলা বন্দর উন্নয়ন, চট্টগ্রামে ড্রাই ডক নির্মাণ, মিরসরাইয়ের বারৈয়ারহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত চার লেনে সড়ক উন্নীত করা, মোল্লারাহাটে ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ, মিরসরাই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন, কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর হয়ে সরাইল পর্যন্ত চার লেন সড়ক নির্মাণ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে ১ লাখ এলইডি বাল্ব সরবরাহ প্রকল্প। এদিকে এলওসি চুক্তির আওতায় ভারতের কাছ থেকে ১ শতাংশ সুদে আগামী ২০ বছরে ঋণের টাকা পরিশোধের সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। ফলে বড় অঙ্কের ঋণের এই টাকা দ্রুত সময়ের মধ্যে পাওয়া গেলে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। দ্রুত বাড়বে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান। এছাড়া বাণিজ্য ঘাটতি দূর হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে ইতোমধ্যে ভারতীয় এই ঋণের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা হয়েছে। সংগঠনটির সভাপতি মোঃ সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, সাবেক প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী ও মোঃ জসিম উদ্দিন ভারতীয় ঋণে দ্রুত অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহারের জন্য তাগিদ দিয়েছেন। তারা বলছেন, ভারতীয় এই ঋণ ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। ভারতীয় ঋণে যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন হলে বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি বাড়বে। একই সঙ্গে রফতানি বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। তাই দ্রুত যাতে ঋণের এসব টাকা ব্যবহার করা যায় সেদিকে সরকারের সবচেয়ে বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন। জানা গেছে, ঋণ চুক্তির পাশাপাশি তিন বিষয় সামনে রেখে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- আঞ্চলিক যোগাযোগ, রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি। আঞ্চলিক যোগাযোগ বা কানেকটিভিটির আওতায় ভারতের ভূখ- ব্যবহার করে ভুটান ও নেপালে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে বাংলাদেশ। একইভাবে ভারত বাংলাদেশের ভূখ- ও বন্দর ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পাঠাতে পারবে। এজন্য বাংলাদেশকে নির্দিষ্ট হারে মাশুল প্রদান করবে ভারত। ভারতের সঙ্গে বড় অঙ্কের যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে তা দূর হবে রফতানি বাণিজ্যের মাধ্যমে। একই সঙ্গে জ্বালানি ও সেবাসহ বিভিন্ন খাতে ভারতের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণে ইতোমধ্যে ১০টি বর্ডার হাট চালু করতে যাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ-মেঘালয় সীমান্তে ৪টি বর্ডার হাট চালু করা হয়েছে। এছাড়া চলতি বছরের মধ্যে আরও ছয়টি বর্ডার হাট চালু করা হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সূত্রে জানা গেছে, সুরেশ প্রভুর এই সফরে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে জমি বরাদ্দের বিষয়ে আলোচনা করা হবে। চলতি বছরের মে মাসে ভারত সফরের সময়ে এসব অঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য ভারতীয় ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় দুদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনাকালে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ভারতীয় বিনিয়োগের জন্য জমি বরাদ্দের বিষয়টিও উল্লেখ করেছিলেন তিনি। এছাড়া বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এ বছর একাধিকবার ভারত সফর করেছেন। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সফরে সম্ভাব্য আরও কর্মসূচীগুলোর মধ্যে রয়েছেÑটেক্সটেক ইন্ডিয়া শীর্ষক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ, বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা নিয়ে আলোচনা, দুদেশের ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে সেমিনারে অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগে কর, কর্মসংস্থান ও শ্রমসংক্রান্ত নিয়মনীতি নিয়ে আলোচনা এবং বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিটুবি আলোচনা।
×