ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডেঙ্গু বাড়ছে প্রতিদিন এ পর্যন্ত রাজধানীতে মারা গেছে ১০

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ডেঙ্গু বাড়ছে প্রতিদিন এ পর্যন্ত রাজধানীতে মারা গেছে ১০

নিখিল মানখিন ॥ রাজধানীতে বেড়েছে ডেঙ্গুর উপদ্রব। প্রতি বছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হয়ে থাকে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে দশ জনের। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বসতবাড়িতে এডিস মশার লার্ভা খুঁজে পেয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা। বেসরকারী হিসেবে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ডেঙ্গু প্রতিরোধে ইতোমধ্যে বিশেষ সভা আহ্বান করে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। রাজধানীর ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই এবং এ রোগে আক্রান্তের চিকিৎসার সুব্যবস্থা রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তবে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় চিন্তামুক্ত থাকতে পারছে না নগরবাসী। এডিস মশা প্রতিরোধে ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে জানান, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা বাড়লেও অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের সংখ্যা খুব বেশি নয়। পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং জনগণের আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। এডিস মশা নিধনে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। বাসাবাড়ি ও আশপাশের এলাকা পরিচ্ছন্ন ও শুষ্ক রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে মহাপরিচালক বলেন, বাড়ির ও তৎসংলগ্ন এলাকায় জমে থাকা পানিতে এই মশার বংশ বিস্তার ঘটে। বোতল, বালতি, পরিত্যক্ত টায়ার ও অন্যান্য জিনিসে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা জন্ম নেয়। আমাদেরকে এসব জিনিস পরিষ্কার রাখার পরামর্শ দেন মহাপরিচালক। বিশেষজ্ঞরা জানান, রাজধানী ঢাকায় বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশার উপদ্রব বাড়ে। এ সময়কে ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম ধরা হয়। বর্ষা মৌসুম এডিস মশার বিস্তার ও প্রজননের সবচেয়ে অনুকূল সময়। কাগজে কলমে শরৎকাল হলেও অক্টোবরের প্রথমার্ধে বিদায় নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু (বর্ষা)। তাই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আর বৃষ্টির জমা থাকা পানিতে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে বেশি মাত্রায়। তারই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়ে যায় এবং বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন এক সভায় এডিস মশার জীবাণু পেলে বাড়ির মালিককে জেল ও জরিমানা করার ঘোষণা দেন। এ কার্যক্রম নিয়মিত চলছে না বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসাীরা। তবে ডিএসসিসির কর্মকর্তারা জানান, এডিস মশার লার্ভা ও প্রজননস্থল ধ্বংসের কার্যক্রম পরিচালনায় প্রত্যেক ওয়ার্ডে একটি করে কমিটি করা হয়েছে। কমিটির কার্যক্রমও নিয়মিত চলছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা। এই মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এটি সহজে প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমরা প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাচ্ছি। তবে বর্তমানে এ রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা উপযুক্ত চিকিৎসায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর সুস্থ হয়ে উঠছেন। তিনি বলেন, ডেঙ্গু জীবাণুর উৎস এখনও বন্ধ হয়নি। এ কারণে মৃত্যুর হার কমে গেলেও আক্রান্ত হওয়ার প্রকোপ কমছে না। ডেঙ্গুর উৎস বন্ধ না হলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি থেকেই যাবে। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। অন্য ভাইরাসজনিত রোগের মতো ডেঙ্গু রোগের সরাসরি কোন প্রতিষেধক নেই, টিকাও নেই। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়। অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ আরও জানান, নগরীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গত বছরের মতো এ বছরও হিমোরেজিক ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যাই বেশি দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্তরা নাক ও দাঁত দিয়ে এবং কাশির সময় রক্তক্ষরণে ভুগে থাকে। আর আক্রান্তরা পিঠ, ঘাড়, মাথা ও চোখের পেছনে ব্যথা অনুভূত হওয়ার কথা বলে থাকে। তিনি বলেন, ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যে জ্বর না কমলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। আর চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া কোন ওষুধ দেয়া ঠিক হবে না। রোগীকে বেশি মাত্রায় পানি বিশেষ করে শরবত খাওয়ানো যেতে পারে। দিনের বেলায় ঘুমানোর সময়ও মশারি ব্যবহার করা উচিত। বাসায় খোলা পাত্রে পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। এতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। বাসায় সর্বত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য তিনি পরামর্শ দেন ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতি বছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। নগরীর সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে অনেক ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। সারাদেশের ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সঠিক সংখ্যা জানে না সরকার। কিন্তু হাসপাতাল-ক্লিনিক ছাড়াও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে ডেঙ্গু রোগীর আগমন বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বিশেষ মশক নিধন কার্যক্রম চালু নেই। পানি মেশানো ওষুধ ছিটানোর মাধ্যমেই নিজেদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখছে ডিসিসি। মশক নিধন কার্যক্রমের বরাদ্দ নিয়ে লুটপাতের খেলা চলে। বাড়তি টাকা না দিলে কোন বাসা বা এলাকায় ওষুধ ছিটাই না ডিসিসির কর্মীরা। ইপিডেমিওলজি ডিজিস কন্ট্রোল এ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদি সাব্রিনা জানান, তারা দেশের সব হাসপাতালের প্রতি ডেঙ্গুর বিষয়ে দৈনিক প্রতিবেদন পাঠানো এবং এই রোগের কারণ, লক্ষণ ও এর প্রতিরোধের উপায় নিয়ে লোকদের সচেতন করে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন। আইইডিসিআরের পরিচালক জানান, ডিজিএইচএসের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সহযোগে আইইডিআরসি ঘনিষ্ঠভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং তারা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। তিনি আরও বলেন, প্রয়োজনীয় তথ্য ও এ-সংক্রান্ত শিক্ষণীয় বিষয় আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে দিচ্ছি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর রাজধানীতে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ সামান্য বাড়লেও পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। তিনি নগরবাসীর প্রতি আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, নগরীর ৫৭টি ওয়ার্ডে মশা নিধনে একযোগে ক্রাশ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) বলছে, এ বছর বেশ আগ থেকে দক্ষিণ কর্পোরেশন ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি গিয়ে লার্ভা নিধন করেছে। ৩৩ হাজার বাড়ির লার্ভা নিধন করা হয়েছে। এখনও বাড়ি বাড়ি গিয়ে নগরবাসীকে সচেতন করার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। কয়েক দফা ডেঙ্গু প্রতিরোধে ক্র্যাশ কর্মসূচী পালন করেছে ডিএসসিসি। ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডাঃ শেখ সালাহউদ্দীন বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ আশঙ্কাজনক এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি, তবে এডিস মশা থেকে বাঁচতে ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। আর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) বলছে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে মসজিদ, স্কুল-কলেজে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। এ ছাড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের এলাকায় জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। আর ডিএনসিসির পাঁচটি আঞ্চলিক কার্যালয়ে জনসচেতনতামূলক সভা, র‌্যালিসহ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। এর পরও নগরবাসী সচেতন না হওয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডাঃ মোঃ জাকির হোসেন বলেন, ডেঙ্গু রাজধানীতে ভয়াবহরূপ ধারণ করেছে এটা সত্য। ইতোমধ্যে ১০ জন মারা গেছেন। আমরা আমাদের অবস্থান থেকে নানা ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম প্রহণ করেছি।’
×