ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের ষষ্ঠ কনভেনশনে প্রধানমন্ত্রী;###;দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতার ওপর গুরুত্বারোপ

আর হাতপাতা নয় ॥ খাদ্যের নিশ্চয়তা আমাদের লক্ষ্য-

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আর হাতপাতা নয় ॥ খাদ্যের নিশ্চয়তা আমাদের লক্ষ্য-

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, দেশের যে অগ্রযাত্রাটা শুরু করেছি, সেটা যেন থেমে না থাকে। আমরা শুধু এটুকু চাই, ২১০০ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন যেন অব্যাহত রেখে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে এবং খাদ্যের জন্য যেন আর কোনদিন বাংলাদেশকে কারও কাছে হাত পাততে না হয়, সেটা নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য। এ ব্যাপারে কৃষিবিদদের লক্ষ্য রাখতে হবে। শনিবার রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (কেআইবি) ষষ্ঠ জাতীয় কনভেনশন এবং এ উপলক্ষে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারের উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আর যেন বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে ভিক্ষার হাত বাড়াতে না হয় সেদিকে বিশেষভাবে কৃষিবিদরা লক্ষ্য রাখবেন, আমরা সেটাই চাই। এটুকুই আপনাদের কাছে অনুরোধ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, সামনে আমাদের নির্বাচন। আমরা একটানা দুই মেয়াদে থাকলাম (সরকারে), তৃতীয় মেয়াদে জনগণ ভোট দিলে আসব, না দিলে নয়। কিন্তু আমরা চাই, যে অগ্রযাত্রাটা শুরু করেছি, বাংলাদেশকে আজকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছি, সেটা যেন থেমে না থাকে। আমাদের আওয়ামী লীগের নীতিই হচ্ছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করব, কারও কাছে হাত পাতব না। আর বিএনপির নীতি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া যাবে না, বিদেশ থেকে ভিক্ষা আনতে হবে। তিনি এ সময় কৃষিক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিজ্ঞানী, কৃষিবিদসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু আমাদের এখন এসব পণ্যে ভ্যালু এ্যাড করতে হবে, প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে হবে। কারণ, আমাদের দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে, বিদেশে বাজারও তেমনি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এগুলো আমরা দেশে যেমন বিক্রি করতে পারব তেমনি বিদেশেও রফতানি করতে পারব। তাই কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণের দিকে আমাদের বিশেষভাবে নজর দেয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। সেজন্য আমরা উৎসাহিত করছি আমাদের বিনিয়োগটা যেন এদিকে হয়। আমরা তাহলে অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হতে পারব। সরকারপ্রধান বলেন, স্বল্প মেয়াদি, মধ্য মেয়াদি এবং দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তার সরকার দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন আমাদের দেশের মানুষ খাবারের জন্য হাহাকার করত। বিদেশ থেকে চাল আমদানি করেও চাহিদা মেটানো যেত না। ১৯৯৬ সালে আমরা যখন সরকার গঠন করি তখন দেশে ৪০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতি ছিল। ২০০১ সালে আমাদের দায়িত্ব ছাড়ার সময় ঘাটতি পূরণ করে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যের পরিমাণ ছিল ২৬ লাখ মেট্রিক টন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে এসে দেশকে আবার খাদ্য ঘাটতির দেশে পরিণত করে। কারণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে বিদেশ থেকে নাকি খাদ্য সাহায্য আসবে না। লুটপাটও বন্ধ হয়ে যাবে। রাসায়নিক সার, সেচ, জ্বালানি তেল এবং কৃষি যন্ত্রপাতি সহজলভ্য করার জন্য তার সরকার কৃষিতে বিপুল ভর্তুকির ব্যবস্থা করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন বর্গাচাষীদের মধ্যে জামানত ছাড়াই নামমাত্র সুদে কৃষিঋণ দেয়া হচ্ছে। ২ কোটি ৮ লাখ ১৩ হাজারেরও বেশি কৃষক কৃষি উপকরণ কার্ডের মাধ্যমে কৃষি সহায়তা পাচ্ছেন। মাত্র ১০ টাকায় কৃষকদের জন্য ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ আজ কৃষিপণ্য উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এখন দানাদার খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। চাল, শাক-সবজি, মাছ-মাংসসহ বেশ কিছু কৃষিপণ্য আমরা বিদেশে রফতানি করছি। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে চতুর্থ, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয়, ফসলের জাত উৎপাদনে প্রথম অবস্থানে রয়েছে। তিনি বলেন, কৃষি গবেষণা, উপকরণ সরবরাহ ও সম্প্রসারণ সেবাখাতের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আজকের এ উন্নতি অর্জন সম্ভব হয়েছে। উন্নয়নের জন্য গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্দেশে বলেন, ইতোমধ্যে খরা, লবণাক্ততা ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু কিছু ফসল, ফলদবৃক্ষ ও অন্যান্য গাছের উচ্চফলনশীল জাত আপনারা উদ্ভাবন করেছেন। এ কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত তার সরকার কাজ করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশজুড়ে আমরা ভাসমান কৃষিক্ষেত করতে পারি। ইতোমধ্যে গোপালগঞ্জের কিছু জায়গায় শুরু হয়েছে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে। আমার এলাকায় (গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া-কোটালীপাড়া) কচুরিপানার ওপর বেড তৈরি করে মানুষকে ফসল ফলাতে দেখেছি। এরপর কৃষিমন্ত্রীকে বলেছি। সারাদেশে একই প্রক্রিয়ায় চাষাবাদ শুরু করলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। দেশের বিভিন্নস্থানে কিন্তু অনেকে এভাবে চাষ করতে শুরুও করে দিয়েছে। কৃষিক্ষেত্রকে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দেয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প নিয়ে আমরা প্রত্যেকটা পরিবারকে উৎসাহিত করছি। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক করে দিয়েছি। কেউ ১০০ টাকা সঞ্চয় করলে ব্যাংক থেকে তাকে আরও ১০০ টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে মানুষের সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি বাড়বে। একই সঙ্গে কোথাও এক টুকরো জমিও খালি রাখা যাবে না, ফসল ফলাতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা লাভের পর অল্প সময়ের মধ্যে জাতির পিতা এ দেশকে গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু তার নেয়া সব উন্নয়ন পরিকল্পনা বন্ধ করে দেয় জিয়াউর রহমান ও পরবর্তী এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকার। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের উদ্দেশ্যই ছিল এদেশের মানুষকে শোষণ করা। এদেশের মানুষ ভিক্ষা করবে, এটাই চেয়েছিল ক্ষমতা দখলকারীরা। তিনি বলেন, বিএনপি যখন সরকারে ছিল, সারের জন্য কৃষককে ধর্ণা দিতে হয়েছে। গুলি খেয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে। কিন্তু এখন সারের জন্য ধর্ণা দিতে হয় না, বরং সারই কৃষকের হাতের মুঠোয় পৌঁছে যায়। প্রধানমন্ত্রী সারের দাম কমানো প্রসঙ্গে বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তিন দফায় সারের দাম কমিয়েছে। কৃষককে যেন ব্যাংকে আসতে না হয়, বরং ব্যাংকই কৃষকের দ্বারে গিয়ে তাকে ঋণ পৌঁছে দেয়, সেই ব্যবস্থাও করেছি। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে আপদকালের জন্য খাদ্য মজুদ রাখার ওপরও গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কখন বিপদ-আপদ আসে, বলা যায় না। একটা ফসলের ওপর নির্ভর করলে হবে না। বহুমুখী ফসল চাষাবাদের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিপদের সময় যাতে খাদ্য সরবরাহ করতে পারি, সেজন্য সাইলো নির্মাণ করে আমরা খাদ্য মজুদ রাখার প্রস্তুতি নিয়েছি। তিনি বলেন, ২১০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ কেমন হবে সেই পরিকল্পনা করে আমরা ‘ডেল্টা প্ল্যান’ করেছি। সেখানে কৃষি ও পানিকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। ব্লু-ইকোনমি শক্তিশালী করার জন্য সমুদ্র গবেষণা কেন্দ্রও করা হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত তার সরকার কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ ইন এ্যাগ্রিকালচারকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, পটুয়াখালী কৃষি কলেজ ও দিনাজপুরের হাজী দানেশ কৃষি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এছাড়া দেশের প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও কৃষি সংশ্লিষ্ট শাখা খোলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হয়ে মূলমঞ্চে যাওয়ার আগে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের পতাকা উত্তোলন করেন কৃষিবিদ এ এম এম সালেহ। এ সময় জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে কনভেনশনের উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে দেশের কৃষিক্ষেত্রের উন্নয়নের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র পরিবেশিত হয়। প্রধানমন্ত্রী দু’দিনব্যাপী এ কনভেনশন উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণীকার মোড়কও উন্মোচন করেন। কেআইবি সভাপতি এ এম এম সালেহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, আইএফডিসি’র প্রেসিডেন্ট এবং সিইও স্কট জে এ্যাঞ্জেল এবং কেআইবি মহাসচিব মোঃ খায়রুল আলম প্রিন্স প্রমুখ। কৃষিবিদ ড. মীর্জা আব্দুল জলিল, আব্দুল মান্নান, ড. আব্দুর রাজ্জাক এবং কৃষিবিদ আফম বাহাউদ্দিন নাছিম মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। কৃষিক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অনুষ্ঠানে কৃষিবিদ আফম বাহাউদ্দিন নাছিমকে কেআইবির পক্ষ থেকে আজীবন সম্মাননা পদকে ভূষিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তার হাতে এই পদক তুলে দেন।
×