ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মালয়েশিয়া থেকে উদ্ধার কাউছারের রোমহর্ষক কাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:১২, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

  মালয়েশিয়া থেকে উদ্ধার কাউছারের রোমহর্ষক কাহিনী

গাফফার খান চৌধুরী ॥ প্রবাসী বাংলাদেশীদের নিরাপত্তা আরও জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মালয়েশিয়ায় পড়তে যাওয়া বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের ওপর কঠোর মনিটরিং শুরু করেছে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকার। মালয়েশিয়ায় এক বাংলাদেশী শিক্ষার্থী অপহরণের ঘটনায় দুই দেশের আন্তর্জাতিক অপহরণকারী চক্রের সন্ধান পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই। এক সদস্য গ্রেফতার হওয়ার পর বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার অপহরণকারী চক্রের নানা খবর। পুলিশ কৌশলে ওই ছাত্রকে মালয়েশিয়ায় জিম্মি দশা থেকে মুক্ত করে দেশে আনে। ওই ছাত্র ঢাকার সিএমএম আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দীতে অপহরণের রোমহর্ষক কাহিনী জানায়। মালয়েশিয়ায় থাকা অন্য আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে চেষ্টা চলছে। এ ঘটনার পর মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় যৌথ মনিটরিং সেল গঠন করা হয়। জানা গেছে, পিবিআই ও পুলিশ সদর দফতর সূত্রে পিবিআইর ঢাকা মেট্রোর অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার বশির আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, নজরুল ভূঁইয়া (৩৩) নামের এক ব্যক্তির যাত্রাবাড়ী থানায় দায়েরকৃত জিডির তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। জিডিতে বলা হয়, তার ভাতিজা এনামুল হাসান ভূঁইয়া ওরফে কাউছার (২০) মালয়েশিয়ায় পড়তে গিয়ে অপহৃত হয়েছে। অপহরণকারীরা কাউছারকে ছাড়াতে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করছে। টাকাগুলো অপহরণকারী চক্রের বাংলাদেশে থাকা সদস্যরা নেবে। পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে জানান, অপহরণকারীদের গ্রেফতার করতে পিবিআইর পাতা ফাঁদে দক্ষিণখান থানাধীন সুলতান মার্কেট থেকে ধরা পড়ে অপহরণকারী চক্রের সদস্য মোঃ রাকিবুল হাসান রাতুল (২৬)। তার কাছ থেকে মুক্তিপণের এক লাখ টাকাও উদ্ধার করা হয়। রাতুল জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তারা সংঘবদ্ধ অপহরণকারী চক্রের সদস্য। তাদের চক্রের মালয়েশিয়ার নাগরিকও আছে। পরে রাতুলের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় থাকা অপহরণকারী চক্রের সদস্য নাটোর জেলার বাসিন্দা আলম ওরফে আলমগীর ও দক্ষিণখানের বাসিন্দা মোঃ আলমগীর হোসেন এবং মালয়েশিয়ার অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের সঙ্গে অপহৃত কাউছারের লোক সেজে যোগাযোগ স্থাপন করে। রাতুল অপহরণকারীদের জানায়, তারা টাকা বুঝে পেয়েছে। এরপর মালয়েশিয়ার অপহরণকারীরা কাউছারকে ছেড়ে দেয়। মুক্তির পর কাউছার নিরাপত্তাজনিত কারণে মালয়েশিয়ায় থাকতে রাজি হয় না। পিবিআই তাকে দেশে ফিরিয়ে আনে। দেশে ফিরে কাউছার গত আগস্টে ঢাকার সিএমএম আদালতে ১৬৪ ধারায় অপহরণের ঘটনা বর্ণনা করে। কাউছার তার জবানবন্দীতে জানায়, একদিন মামার দোকানে এসে আলমগীর হোসেন ওরফে আলম এক লোক মামার খোঁজ করেন। মামা দোকানে ছিলেন না। আলমগীর তাকে বলে তার মামা তারও খুব পরিচিত। সে একটু বিপদে পড়েছে। তাদের বাসায় দুই দিন থাকতে চায়। মামাকে ফোন করে বিষয়টি জানাই। বিদেশে থাকা বাংলাদেশী হওয়ার সুবাদে মামাও তাকে চিনেন বলে জানান। শেষ পর্যন্ত আলম প্রায় দুই মাস তাদের বাসায় থাকেন। ভাল সম্পর্ক হওয়ার সুবাদে আলম তাকে সবজি চাষ করে অনেক টাকা রোজগারের প্রলোভন দেখায়। এতে রাজি হলে আলম তাকে সবজি চাষের জমি দেখাতে চান। সে মোতাবেক একদিন সকালে সে বাসা থেকে বের হয়। বাড়ির সামনেই এক মালয়েশিয়ান গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি এগিয়ে এসে আমাকে বলেন, আপনি কাউছার সাহেব। আলম সাহেব আমাকে আপনাকে নিতে পাঠিয়েছেন। তার সঙ্গে গাড়িতে উঠি। গাড়িতে ওঠার খানিক পরেই তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন, পাসপোর্ট, মানিব্যাগ, নগদ টাকা ও ব্যাংকের কার্ড নিয়ে যায়। আমাকে কুয়ালালামপুর শহর থেকে অনেক দূরে একটি জঙ্গলে নিয়ে রাখে। পরদিন আলম সেখানে হাজির হয়। সে আমার মোবাইল থেকে আমার পরিবারের কাছে ফোন করে। আমার মুক্তিপণ হিসেবে ২০ লাখ টাকা দাবি করে। মুক্তিপণের টাকা বাংলাদেশে নেয়ার জন্য লোক আছে বলে জানায়। পরিবার থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য ব্যাংক ও বিকাশ এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশে থাকা চক্রের সদস্যদের কাছে টাকা দিতে থাকে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমেও আমাকে মুক্ত করতে আমার পরিবার সবকিছু বিক্রি করে টাকা দিয়েছে। এমনকি আমার মামার কাছ থেকেও টাকা নেয় অপহরণকারীরা। এর কয়েকদিন পর বাংলাদেশে যোগাযোগের মাধ্যমে আমি মুক্ত হই। মুক্ত হয়ে দেখি আমার ব্যাংকের কার্ড দিয়ে বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১২ লাখ টাকার সমপরিমাণ রিঙ্গিত তুলে নিয়েছে তারা। মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশী ছাত্রদের অপহরণের এমন বিষয়ে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন, এটি একটি নতুন ট্রেন্ড। আগে মালয়েশিয়ায় শ্রমিকদের জিম্মি করে টাকা আদায়ের প্রবণতা ছিল। বর্তমানে মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী ছাত্রদের অপহরণ করে মুক্তিপণ হিসেবে টাকা আদায় করার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর সঙ্গে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের মানবপাচারকারী চক্র এবং মালয়েশিয়ায় ছাত্রদের পাঠানোর সঙ্গে জড়িত কতিপয় এজেন্সির জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। তাদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। টার্গেট হিসেবে ছাত্রদের বেছে নেয়ার কারণ হিসেবে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, যেসব ছাত্র মালয়েশিয়ায় পড়তে যায়, স্বাভাবিকভাবেই ওসব ছাত্রের পরিবার অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল। তাদের অপহরণ করতে পারলে মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়া যাবে। এমন ধারণা থেকেই অপহরণকারী চক্রগুলো ছাত্রদের টার্গেট করছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার কয়েকটি চক্রের জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। ছাত্র অপহরণের বিষয়টি পুলিশ সদর দফতর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মালয়েশিয়া সরকারকে জানানো হয়েছে। এরপরই মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের তরফ থেকে মালয়েশিয়া প্রবাসী ছাত্রদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে দেখভাল করার জন্য একটি যৌথ মনিটরিং সেল গঠিত হয়। নিরাপত্তা মনিটরিং সেলের সদস্য হিসেবে তিনি নিয়মিত এসব বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দফতরের মাধ্যমে মালয়েশিয়া সরকারকে অবহিত করে থাকেন। তিনি আরও জানান, অপহরণের সঙ্গে মালয়েশিয়ার যেসব নাগরিক জড়িত তাদের সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য সেদেশের সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো হয়েছে। আর মালয়েশিয়ায় থাকা যেসব বাংলাদেশী নাগরিক অপহরণকারী চক্রের সদস্য তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে চেষ্টা করা হচ্ছে। বিষয়টি সম্পর্কে পুলিশ সদর দফতরের স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স এ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোঃ মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘ দিন ধরেই বিশেষ করে মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা বাংলাদেশীদের অপহরণ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেককে উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের জবানবন্দীতে বার বার বাংলাদেশী ও ওসব দেশের নাগরিকদের জড়িত থাকার তথ্য এসেছে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের তরফ থেকে নানা উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে যৌথ মনিটরিং ব্যবস্থা। এর মধ্যে মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় যৌথ মনিটরিং ব্যবস্থা বার বার শক্তিশালী করার তাগিদ দেয়া হয়ে থাকে। তারপরেও অনেক সময়ই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে যায়। হালে এমন প্রবণতা আগের যে কোন সময়ের তুলনায় কম। পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, আমরা এ সংক্রান্ত অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করি। পাশাপাশি ওইসব দেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে আমরা সরাসরিও যোগাযোগ করে থাকি। এরপর আমরা নিজ উদ্যোগে ওইসব দেশের পুুলিশ বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। এতে করে সবচেয়ে দ্রুত কাজ হয়। পাশাপাশি দূতাবাসগুলোও স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে। নানামুখী পদক্ষেপে আগের তুলনায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের অপহরণ করার পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক কমেছে। ভবিষ্যতে যৌথ মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার হলে এ ধরনের অপরাধ একেবারেই কমে যাবে বলে আশা করছি।
×