ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফজলে রাব্বী হলে বসবাস করছে ঢামেকের মেধাবী ছাত্ররা

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফজলে রাব্বী হলে বসবাস করছে ঢামেকের মেধাবী ছাত্ররা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী রাফিন (ছদ্মনাম) গত দুই বছর ধরে চতুর্থ তলায় তার নামে বরাদ্দ একটি কক্ষে আছেন। রাফিন বলেন, গত রোজার ঈদের ছুটির পর বাড়ি থেকে ফিরে দেখি, ছাদ থেকে খুলে পরা ইটের টুকরো বিছানায়। নিশ্চিত হতে ছাদে লাঠি দিয়ে গুঁতো দিতেই ঝুরঝুর করে ইটের টুকরো পরতে লাগল বিছানার ওপর। অফিসে জানানোর পর স্যাররা এসে দেখে গেলেন, আশ্বাস দিলেন ঠিক করে দেবেন। কিন্তু গেল তিন মাসেও তা ঠিক হয়নি। রুমে থাকতে স্বস্তি পাই না, সব সময় একটা আতঙ্ক কাজ করছে এ হলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। হল কর্তৃপক্ষ আমাদের আশ্বস্ত করেছেন- কিন্তু আদৌ সে সংস্কার কবে করা হবে সেটা এখনও জানি না- বলেন রাফিন। এই হলের চতুর্থ তলারই আরেক কক্ষে থাকেন শাকিল (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ। সেদিন ক্লাস শেষ করে দুপুরে খাওয়ার পর কিছুটা রেস্ট নিয়ে বাইরে চলে যাই। সন্ধ্যার দিকে ফিরে দেখি, বিছানায় বালিশের ওপরে ছাদ থেকে খসে পড়া দেয়ালের পলেস্তরা, ইটের টুকরো। শাকিল বলেন, আমি যদি সেদিন অন্যান্য দিনের মতো ক্লাস করে এসে বিকেলে ঘুমিয়ে যেতাম তাহলে তো সব আমার মাথাতেই পড়ত। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংস্কার করা হোক, এতে আমরা রক্ষা পাব। সরজমিনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফজলে রাব্বি হলে গিয়ে দেখা যায়, চারতলার এই হলটির করুণ দশা। সিঁড়ির দেয়াল, কার্নিশ, কক্ষগুলোতে নোনা ধরা, কার্নিশের দেয়াল থেকে পানি চুইয়ে পড়ছে, কোথাও কোথাও ভেঙ্গে পড়া দেয়াল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব কক্ষেই বসবাস করছেন দেশের মেধাবী- মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার্থীরা। কক্ষগুলোর কোনটিতে ছাদ থেকে খসে পড়ছে পলেস্তরা, কোনটির পলেস্তরা খসে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে রড। শিক্ষার্থীরা জানালেন, ছাদের অবস্থা এত খারাপ যে, তারা সিলিং ফ্যান লাগাতেও সাহস পাচ্ছেন না, বিছানার ওপর পলিথিন বিছিয়ে রাখেন তারা, কোনোমতে ঝুঁকির মধ্যে দিন যাচ্ছে তাদের। ছাদে সিলিং ফ্যান লাগানো যাচ্ছে না- ফ্যান চলতে শুরু করলে ছাদ থেকে পলেস্তরা খসে খসে পড়ে। গরমে অতিষ্ঠ হলেও তারা ফ্যান লাগানোর ঝুঁকি নিচ্ছেন না তারা। তাদের অভিযোগ, হল কর্তৃপক্ষ সংস্কারের কাজ করবেন বলে অনেক আগেই আশ্বাস দিলেও কাজ শুরু হয়নি। কর্তৃপক্ষকে জানানো পর কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল এবং হল প্রোভেস্ট এসে দেখেও গেছেন। তারপরও কোন কাজ হলো না। শিক্ষার্থীরা জানান, হলের যেসব কক্ষের এ ধরনের সমস্যা রয়েছে তাদের কলেজের উপাধক্ষ্যের কাছে আবেদন করতে বলা হয়। চারতলার শিক্ষার্থীরা আবেদন করলে কর্তৃপক্ষ জানায়, আটটি কক্ষ মেরামত করে দেয়া হবে। তবে রাফিনের কক্ষটি সেই তালিকায় নেই। রাফিন বলেন, কেন আমাদের কক্ষটিকে তাদের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে না- সেই প্রশ্ন করার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা নিজেরাও অবাক হয়েছি কেন এই রুম তাদের নোটিসে এল না। কিন্তু কিছু করার নেই, কেবল দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা আতঙ্কে থাকি, কখন কী হয়ে যায়। হল কর্তৃপক্ষের দেয়া নোটিসে ৩২২, ৩২৮, ৩২৯, ৩৩০, ৩৩১,৩৩৩, ৩৩৪ এবং ৩৩৫ এই আটটি কক্ষ মেরামতের কথা বলা হয়েছে। কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ খান আবুল কালাম আজাদ স্বাক্ষরিত নোটিসটিতে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ডাঃ ফজলে রাব্বি ছাত্রাবাসের মেন বিল্ডিংয়ের নিম্নলিখিত রুমগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় হোস্টেল সংস্কার ও সুরক্ষা কমিটি কর্তৃক উক্ত রুমগুলোকে বসবাসের অযোগ্য ঘোষণা করেন। সে মোতাবেক ওই রুমগুলো সিলগালা করে ছাত্রদের অন্য রুমে স্থানান্তর পূর্বক সংশ্লিষ্টদের অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হইল। শিক্ষার্থীরা বলছেন, রুমগুলো সিলগালা করে দেয়ার কথা বলা হলেও সেখানে এখনও শিক্ষার্থীরা থাকছেন। এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষ উদাসীন। গত ১৩ আগস্ট এই নোটিস দেয়া হলেও এখনও মেরামত কাজ শুরু হয়নি। কয়েকজন শিক্ষার্থী জানালেন, আগামী নবেম্বরেই তাদের ফাইনাল পরীক্ষা। ওই সময় যদি সংস্কার কাজ শুরু হয়, আমাদের পরীক্ষায় সমস্যা হবে। তাই এর আগেই যদি এসব কাজ করা যেত, তাহলে আমাদের জন্য অনেক ভাল হতো। ফজলে রাব্বি হলের চতুর্থ তলায় থাকা একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, বৃষ্টির দিনে ছাদে পানি জমে ওয়াল খসে পড়ে, আর শীতের দিনে প্লাস্টার খসে পড়ে। তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, চলতি বর্ষা মৌসুমে এই অসুবিধা চরম আকার ধারণ করে অথচ কারও কোন বিকার নেই। শিক্ষার্থীরা বলছেন, যে কোন সময় বড় ধরনের একটি দুর্ঘটনার আশঙ্কায় রয়েছেন তারা। তারা বলেন, কর্তৃপক্ষ সংস্কারের কথা বলছেন, কিন্তু তারা আসলে কী করবেন সেটা আমাদের কাছে পরিষ্কার না। হয়ত খসে পড়া জায়গাগুলোতে আবার প্লাস্টার করে দেবেন। কিন্তু হলের যা অবস্থা, জায়গায় জায়গায় নোনা ধরে গেছে, দেয়াল খসে ভেতরের রড বেরিয়ে এসেছে, সেই প্লাস্টার ক’দিন থাকবে! দরকার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান। নয় তো আরেকটি জগন্নাথ হলের ট্র্যাজেডির মতো ঘটনার সাক্ষী হবে বাংলাদেশ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, দেয়ালগুলো রিপেয়ার অনেক বছর হয়নি, কিছু কিছু রুমের আসলেই করুণ অবস্থা। চারতলার আটটি রুম ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন হয়ে গেছে, কাজ শুরু হয়ে যাবে। অধ্যাপক ডাঃ খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, দুই মাস আগে সুরক্ষা ও সংস্কার কমিটি করেছি, সেখানে সব জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকসহ সংশ্লিষ্টরা রয়েছেন। তারা মিলে সমাধান করার জন্য কাজ করছেন। আমরা এ বিষয়ে জানি এবং কাজ করছি।
×