ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিষণ্ণতা, উদ্বেগ ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ফিজিওথেরাপি

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বিষণ্ণতা, উদ্বেগ ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ফিজিওথেরাপি

আজ ৮ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস। বিশ্ব ফিজিওথেরাপি সংস্থা- ওয়ার্ল্ড কনফেডারেশন ফর ফিজিক্যাল থেরাপির অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবারে প্রতিপাদ্য বিষয়- বিষণ্ণতা, উদ্বেগ ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ফিজিওথেরাপি। মানবজীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এবার বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবসের মূল থিম দাঁড় করানো হয়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০% বাত তথা অস্টিওআরথ্রাইটিস রোগী বিষণ্ণতায় ভোগে, ৩৩% স্ট্রোক রোগী বিষণ্ণতায় ভোগে, ৩৮% বয়স্ক রোগী বিষণ্ণতায় ভোগে। প্রত্যেক মানুষের ব্যথা, শারীরিক অক্ষমতা কিংবা অসারতার ফলে দীর্ঘমেয়াদী বিষণ্ণতা হতে পারে। ফিজিওথেরাপিস্টরা রোগীদের সমস্যা শুনে, বুঝে, প্রোগ্রাম সেট করে প্রেরণা দিয়ে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। একজন রোগী প্রচণ্ড কোমর ব্যথায় ভুগছেন। অনেকে এই ব্যথার জন্য অফিস করতে পারছেন না। ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে একটু ব্যথা কমলেও, ব্যথা বার বার আসছে। কারণ, ব্যথার ওষুধ ব্যথার কারণ কমায় না, ব্যথা সাময়িকভাবে কমায়। ফলে রোগীটি ব্যথার কারণে অফিসে যেতে পারছে না, এক অনিশ্চয়তায় তাঁর দিন কাটছে। এটি দীর্ঘদিন থাকলে তাঁর মাঝে বিষণœতা ও উদ্বেগ তৈরি হবে যার ফলে তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা মারাত্মকভাবে অবনতি হতে পারে। একজন স্ট্রোক রোগী কিংবা একজন স্পোর্টস ম্যানেরও একই সমস্যা হতে পারে। একজন ফিজিওথেরাপিস্টই পারে তাঁর এই সমস্যা নিরসন করে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে অবদান রাখতে। যাই হোক, ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সম্পর্কে আসুন কিছু জেনে নেই। ফিজিওথেরাপি একটি স্বতন্ত্র চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীকে পরীক্ষা করে, রোগ নির্ণয় করে, ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা প্রদান করেন এবং বিভিন্ন ফিজিক্যাল মেথডের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ, প্রতিকার, পুনর্বাসনসহ স্বাস্থ্যসেবার বিশাল অংশজুড়ে চিকিৎসা-পেশাজীবী হিসেবে কাজ করে। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা-পদ্ধতি হলো- ম্যানুয়াল থেরাপি, মাংসপেশির সঞ্চারণ বৃদ্ধি, এ্যাক্টিভ এক্সারসাইজ, ইলেক্টোথেরাপি, ক্রায়োথেরাপি, টেপিং, ড্রাই নিডলিংসহ নানা প্রকার গবেষণালব্ধ চিকিৎসা যার মাধ্যমে ওষুধবিহীনভাবে ব্যথা, অক্ষমতা, পক্ষাঘাত, অথবা সার্জারি ছাড়াই বহু সমস্যার আধুনিক চিকিৎসা করা হয়। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২৫০০ ফিজিওথেরাপিস্ট আছেন যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিওথেরাপিতে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করে দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল, পুনর্বাসন কেন্দ্র, চেম্বার ও অন্য এনজিওতে কাজ করছেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য ১৯৭২ সালে বিদেশি ফিজিওথেরাপিস্টদের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার সূচনা হয়। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭৩ সালে আরআইএইচডি (বর্তমানে নিটোর) ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের অধীনে স্মাতক ডিগ্রী চালু করে (এমবিবিএস ও বিডিএস একই অনুষদের অধিভুক্ত)। বর্তমানে নিটোর (পঙ্গু হাসপাতাল), আইএইচটি, বিএইচপিআই (সিআরপি), গণবিশ্ববিদ্যালয়, সাইক, স্টেট কলেজ অব হেলথ সায়েন্সে পাঁচ বছর ফিজিওথেরাপি কোর্স (চার বছর মেয়াদী গ্র্যাজুয়েশন ও এক বছরের বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপ) চালু রয়েছে। আমরা যদি আমাদের শরীরের বিভিন্ন রোগের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাব, শুধু ওষুধ সব রোগের পরিপূর্ণ সুস্থতা দিতে পারে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওষুধের পাশাপাশি যেমন অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়, তেমনি কিছু রোগে ওষুধের পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে যেসব রোগের উৎস বিভিন্ন মেকানিক্যাল সমস্যা ও বয়সজনিত সমস্যা, সেসব ক্ষেত্রে ওষুধের ভূমিকা তুলনামূলকভাবে কম যেমনÑ বাতের ব্যথা, স্পোর্টস ইনজুরি, হাড়ের ক্ষয়জনিত ব্যথা, সারভাইক্যাল ও লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস, ডিস্ক প্রলেপস, অস্টিও-আরথ্রাইটিস, ফ্রোজেন সোল্ডার বা জয়েন্ট শক্ত হয়ে যাওয়া, প্লাস্টার বা অস্ত্রোপচার পরবর্তী জয়েন্ট স্টিফনেস, স্ট্রোকজনিত প্যারালাইসিস, ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস বা বেলস পালসি, সেরেব্রাল পালসি বা সিপি বাচ্চা ইত্যাদি। এসব রোগ হতে পরিপূর্ণ সুস্থতা লাভের জন্য ওষুধের পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা প্রয়োজন। ফিজিওথেরাপিতে শুধু ব্যাচেলর অথবা পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রীধারীকেই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক বলা যাবে। যিনি কমপক্ষে ফিজিওথেরাপি ব্যাচেলর ডিগ্রী নিয়েছেন। একজন কোয়ালিফাইড ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক রোগীর রোগ নির্ণয়সহকারে চিকিৎসাসেবা দিতে পারবেন। একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক রোগীর রোগ বর্ণনা, ফিজিক্যাল টেস্ট, ফিজিওথেরাপিউটিক স্পেশাল টেস্ট, প্রয়োজন সাপেক্ষে বিভিন্ন রেডিওলজিক্যাল টেস্ট এবং প্যাথলজিক্যাল টেস্টের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় বা ডায়াগনোসিস করে থাকেন। এরপর রোগীর সমস্যানুযায়ী চিকিৎসার পরিকল্পনা অথবা ট্রিটমেন্ট প্লান করেন এবং সেই অনুযায়ী ফিজিওথেরাপি প্রদান করে থাকেন। বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এর মধ্যে অনেকে সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পায় না এবং অপচিকিৎসার শিকার হন। আমাদের দেশে এই চিকিৎসাসেবাটি বিভিন্ন মহলের অপপ্রচার (ব্যায়াম ও স্যাক) ও অপব্যবহারের (কোয়ালিফাইড ফিজিওথেরাপিস্ট ছাড়া অন্য কোন চিকিৎসক কর্তৃক ফিজিওথেরাপি পরামর্শ দেয়া) কারণে সাধারণ মানুষ সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশে স্বতন্ত্র ফিজিওথেরাপি কলেজ নির্মাণ, স্বতন্ত্র কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা ও স্নাতক ডিগ্রীধারী ফিজিওথেরাপিস্টদের পদ সৃষ্টি ও বাস্তবায়ন না করায় এই চিকিৎসাব্যবস্থা বর্তমানে হুমকির মুখে পড়েছে। তাই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ও পরামর্শ নেয়ার জন্য অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের কাছে যাবেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাসপাতালে বা ক্লিনিকে ভর্তি থেকে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিতে হয়। সেক্ষেত্রে রোগী দ্রুত আরোগ্য লাভ করে। তবে আশার ব্যাপার হলো, মানুষ এখন অনেক সচেতন হচ্ছে, তাই তারা ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ও পরামর্শ নেয়ার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের খোঁজ করে তার তত্ত্বাবধায়নে ফিজিওথেরাপি নিতে চান। লেখক : বিএসসি ইন ফিজিওথেরাপি (ঢাবি), এমপিএইচ, এমএসএস (ঢাবি) সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি এ্যাসোসিয়েশন সহকারী সমন্বয়ক, ভিশন ফিজিওথেরাপি সেন্টার [email protected]
×