ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রমা চৌধুরী ॥ একাত্তরের এক জননীর প্রস্থান

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 রমা চৌধুরী ॥ একাত্তরের এক জননীর প্রস্থান

রমা চৌধুরী। নামটি এখন আর অজানা নয়। একটি জীবনের গল্প এতটা করুণ হতে পারে, তা ভাবাই যায় না। সেরা ঔপন্যাসিকের কল্পনাকে হার মানায়। এমন উপাখ্যান উঠে আসেনি কোন কাব্যে, কোন গল্পে। কোন উপন্যাস এতটা জীবন্ত হয়নি। আর হবেই বা কেমন করে। এটা তো গল্প নয়, বরং নিদারুণ সত্য। রমা চৌধুরীর জীবন এক অর্থে বাংলাদেশের জন্মের প্রসব বেদনা। দেশটা তো আপনা-আপনি স্বাধীন হয়নি। এর পেছনে রয়েছে রমা চৌধুরীর মতো মায়েদের সম্ভ্রম ও সন্তান হারানোর বেদনা। আমরা সকল মাকে জানি না। জেনেছি একজনকে, যিনি এখন সকলের শ্রদ্ধার ‘একাত্তরের জননী।’ সেই ষাটের দশক। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করেছে, এমন ছেলেই বা কজন ছিল। অথচ, একজন নারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতোকোত্তর সম্পন্ন করলেন। তাঁর থাকবার কথা ছিল সমাজের উঁচু স্তরে। শুরুটা করেছিলেন মহত শিক্ষকতা পেশা দিয়ে। প্রাচুর্যের উচ্চাভিলাষ ছিল না। চলছিল সম্মানজনক জীবিকায়। কিন্তু সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধে। সম্ভ্রম হারালেন, বাড়িছাড়া হলেন। অনাহারে অর্ধাহারে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেল আদরের শিশু সন্তান। নিজের স্বজনরাও দূরে সরে গেল। এরপর চলতে হয়েছে মুখ লুকিয়ে। তবে শেষপর্যন্ত প্রমাণ করেছেন তিনিই বাংলাদেশ, তিনিই মুক্তিযুদ্ধ, তিনিই একাত্তরের জননী। তাঁর মুখটি যেন অত্যাচারিত বাংলার মুখ। চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর পোপাদিয়া গ্রামে রমা চৌধুরীর বাড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জনকারী এই নারীর তেমন উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল না। বেছে নেন শিক্ষকতার মতো মহত পেশা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ ছিল তাঁর জীবনে প্রলঙ্করী একটি ঝড়ের মতো। স্বামী চলে যান ভারতে। তিনি থেকে যান ভিটেবাড়িতে। কে জানত শহরের বাইরে সেই পোপাদিয়া গ্রামেও হানা দেবে পাক হানাদার বাহিনী? ১৯৭১ সালের ১৩ মে ছিল রমা চৌধুরীর জীবনে কালো রাত। অমাবশ্যার চেয়েও বেশি অন্ধকার নেমে এসেছিল সেই রাতে। এলাকার স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের সহায়তায় পাক সেনাদের একটি দল তাঁর বাড়িতে ঢুকে পড়ে। মা এবং দুই পুত্রের সামনে ধর্ষিত হন রমা চৌধুরী। হানাদাররা ঘরের মূল্যবান সামগ্রী লুট করে আগুন জ্বালিয়ে দেয় ঘরে। রমা চৌধুরী তাঁর মা এবং সন্তানদের নিয়ে জলে জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেন। সম্ভ্রম তো গেছে, তখন শুধু প্রাণরক্ষার চেষ্টা। কিন্তু সেই চেষ্টাও ছিল চরম প্রতিকূলতায়। যারা ছিল আপনজন, তাদের কাছ থেকেও শুনতে হয়েছে দুয়োবাক্য। স্বামী তাকে গ্রহণ করেনি। সমাজও বৈরী। জীবিকার তাগিদে বের হবেন, সেই মুখও যেন আর নেই। চারপাশ এতটাই বৈরী যে, দোকান পর্যন্ত গিয়ে ছেলেদের জন্য একটুখানি খাবার কিনে আনবেন, সে পরিস্থিতিও ছিল না। অনাহারে অর্ধাহারে, অপুষ্টিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁর ¯েœহের দুই সন্তান। অর্থাভাবে সন্তানদের চিকিৎসাও করাতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত হয় বাঙালী জাতি। কিন্তু রমা চৌধুরী তখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা সন্তানকে নিয়ে সংগ্রামরত। বিজয়ের আগের দিন ১৫ ডিসেম্বর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে পুত্র সাগর। সেই অসুস্থতা থেকে আর ফেরা হয়নি। ২০ ডিসেম্বর মারা যায় ছেলেটি। এর দু’মাস না যেতে মারা যায় আরেক পুত্র টগর। ১৯৯৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে দীপংকর। এমন দুঃখিনী মা এই সমাজে আর ক’জন আছেন। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী সন্তানদের দাহ করার কথা। কিন্তু প্রথা ভাঙলেন রমা চৌধুরী। সন্তানের মুখাগ্নি করতে পারবেন না তিনি। প্রিয় পুত্র ভস্মে পরিণত হবে, তা তিনি চাননি। তিন পুত্রকেই দাফন করান রমা চৌধুরী। এরপর থেকে শুরু হয় তাঁর নগ্নপায়ে পথচলা। রমা চৌধুরী তাঁর জীবনের শেষ প্রায় দুইযুগ হেঁটেছেন খালি পায়ে। যে মাটিতে শুয়ে আছে আদরের তিন সন্তান, সেই মাটির ওপর তিনি জুতাপায়ে চলতে পারবেন না। এতে সন্তানরা কষ্ট পাবে, ব্যথা পাবে। কাঁধে ঝোলা নিয়ে প্রতিদিন মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন। ফেরি করেছেন নিজের লেখা বই। কোনদিন খেয়েছেন, আবার কোনদিন খাননি। বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরীর জীবনে গল্পের মতো একটি চরিত্র আলাউদ্দিন খোকন। বয়সে টগবগে তরুণ। কিন্তু মানবিক মূল্যবোধে অতিশয় কোমল। বেঁচে থাকার তাগিদে রমা চৌধুরী হাতে তুলে নেন কলম। লেখার অসংখ্য উপকরণ তো তাঁর নিজের জীবনেই। লিখতে শুরু করলেন ঘটনাবহুল উপাখ্যান, যার একটিও কল্পিত নয়। কিন্তু এই সমাজে শুধু লিখলেই তো হয় না। এগুলো প্রকাশ করতে হয়। নিজেকেও হতে হয় প্রচারমুখী। বই প্রকাশ করার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনাও কম নয়। খ্যাতি না থাকুক, অন্তত গ্লামার চাই। রমা চৌধুরীর কোনটিই নেই। তিনি গেলেন চট্টগ্রামের একটি প্রেসে। সেখানে পরিচয় হয় আলাউদ্দিন খোকনের সঙ্গে। এই বীরাঙ্গনার জীবনকাহিনী জেনে আবেগাপ্লুত হন খোকন। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, তাঁর পাশে থাকবেন। রমা চৌধুরী পেলেন অকৃত্রিম ভালবাসার এক ভাইকে, যে কিনা অন্য ধর্মাবলম্বী। কিন্তু ধর্মীয় ভিন্নতা তাদের একসঙ্গে থাকার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। প্রথমদিকে রমা চৌধুরী রান্না করে খাইয়েছেন খোকনকে। এরপর প্রায় পনেরটি বছর দিদিকে রান্না করে খাওয়ান এই ছোট ভাই। চট্টগ্রাম মহানগরীর অলিগলি, মন্দির, উপাসনালয় যেখানেই রমা চৌধুরী যান, পাশে থাকেন আলাউদ্দিন খোকন। দিদির হাতটি ধরা ছিল ছোট ভাইয়ের হাতে। শুধু তাই নয়, শেষ বয়সে গোসল করানো, কাপড় ধোয়া, নিজের হাতে খাইয়ে দেয়াসহ সকল দায়িত্বই পালন করে যান খোকন। এরমধ্যে খোকনের নিজের সংসারও হয়েছে। কিন্তু তারপরও একইভাবে সময় দিয়ে গেছেন দিদিকে। কোন অজুহাতে দূরে সরে থাকেননি। আলাউদ্দিন খোকন নিজেও একজন লেখক। রমা চৌধুরীর লেখা ১৮টি বই প্রকাশ করার দায়িত্ব খোকনের। নিজে এবং বিভিন্ন জন থেকে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে বইগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করেছে ছোট ভাই। চট্টগ্রামের রাস্তায় বছরের পর বছর দিদি-ভাই মিলে পায়ে হেঁটে বই ফেরি করার চিত্রটি অতি পরিচিত। আলাউদ্দিন খোকন গত ৩০ আগস্ট তার ফেসবুক ওয়ালে লেখেন, ‘আগামীকাল বাবা-মা দুজনের মৃত্যুবার্ষিকী। আজ আমার আত্মজা তিতলি সোনার জন্মদিন। আমি মুমূর্ষু রমাদিকে নিয়ে উৎকণ্ঠায় বসে আছি মেডিক্যালে। আমার জীবনের এক সঙ্কটময় অবস্থা। মা মারা যায় আমার পাঁচ বছর বয়সে। বাবা তেইশে। মায়ের স্মৃতি ঝাপসা। আমার বাবা আমার সংসার বৈরাগ্যের কষ্ট বুকে নিয়ে দীর্ঘ নয়দিন আমার পথ চেয়ে চট্টগ্রামের এক হাসপাতালে আমার দেখা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মায়ের মতো একজন গুরুর (রমা চৌধুরী) সান্নিধ্যে আজ দুইযুগ পার করলাম। সেও মৃত্যুশয্যায়। মাকে হারানোর শোক অনেকটা ভুলে গেছি আমার কন্যা তিতলিকে পেয়ে। আজ আমার মেয়ের জন্মদিনে পাশে থাকতে পারব কিনা জানি না। তবে সব প্রিয়জনের কাছে আমার সোনা মা আযরাহ দীপান্বিতা তিতলির জন্য আশীর্বাদ ও দোয়া কামনা করছি।’ সরকার যে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি প্রদান করেন তাদেরই অন্যতম রমা চৌধুরী। ৩ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল আইসিইউতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রমা চৌধুরী। জীবনে তিনি কিছুই পাননি। তবে মৃত্যুর পরে পেলেন বীরোচিত সম্মান। ফুলে ফুলে ঢাকা পড়ে তাঁর কফিন। চট্টগ্রাম নগরীর চেরাগী পাহাড় থেকে শহীদ মিনার হয়ে বোয়ালখালীর পোপাদিয়া গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র তাঁর মরদেহ ঘিরে মানুষের ভিড়। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত হলেন পুত্র দীপংকরের পাশে। এটাই ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছা। প্রশ্ন জাগে, তিনি বেশি কিছু চেয়েছিলেন কি? মনে হয় না। কারণ, জীবদ্দশায় দেখা গেছে তিনি কোন অনুগ্রহ ভিক্ষা করেননি। রমা চৌধুরীকে নিয়ে ২০১২ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রথম লেখেন চট্টগ্রামের সাংবাদিক রমেন দাশগুপ্ত। শিরোণাম ছিল ‘একাত্তরে সব হারিয়ে এখন বইয়ের ফেরিওয়ালা।’ এরপর টিভিতে মর্মস্পর্শী এক প্রতিবেদন করেন সাংবাদিক মুন্নী সাহা। তারপর আরও বেশকিছু পত্রিকায়। মর্মস্পর্শী প্রতিবেদনে রমা চৌধুরীর নামটি ব্যাপকভাবে পরিচিতি পায়। কিন্তু তিনি কোন সুযোগ নিতে চাননি। গণভবন থেকে ডাক আসে। রমা চৌধুরী গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেন। সর্বস্ব হারানো জননীর জীবনকথা তাঁর হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। এমন এক বীরাঙ্গনার পাশে প্রধানমন্ত্রী দাঁড়াবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু বৈষয়িক কোন সহযোগিতা গ্রহণে আপত্তি রমা চৌধুরীর। তিনি তাঁর লেখা বইগুলো উপহার দেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নির্দেশনা ছিল এই জননীর চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের। মৃত্যুর আগে মাস দুয়েক তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মুক্তিযোদ্ধা কেবিনে। রমা চৌধুরীর লেখা ১৮টি গ্রন্থের মধ্যে একাত্তরের জননী, ভাব বৈচিত্র্যে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্র সাহিত্যে ভৃত্য, নজরুল প্রতিভার সন্ধানে, যে ছিল মাটির কাছাকাছি, স্বর্গে আমি যাব না, আগুনরাঙা আগুনঝরা অশ্রুভেজা একটি দিন, অপ্রিয় বচন, শহীদের জিজ্ঞাসা, নীল বেদনার খাম, নির্বাচিত প্রবন্ধ এবং ১০০১ দিনের পদ্য অন্যতম। তবে একাত্তর সালে বাড়ি ভস্মীভূত হওয়ায় আরও অনেক পান্ডুলিপি পুড়ে যায়। সন্তানহারা রমা চৌধুরী বিড়াল পুষতেন। দুটি গ্রন্থ তিনি উৎসর্গ করেন তাঁর প্রিয় দুই বিড়ালের নামে। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে হৃদয় নিংড়ানো সীমাহীন কষ্ট। তবে না পাওয়ার বেদনা কিংবা পাওয়ার আকুতি নেই। রমা চৌধুরী নেই। প্রচলিত প্রথায় তাঁর আত্মার সদগতি কামনা করতে বিব্রতবোধ করি। কেননা, তিনি লিখেছেন, ‘স্বর্গে আমি যাব না।’ পড়া যাক সেই কবিতার কটা পঙ্ক্তি- একটুখানি চোখের জল/মুক্তা দানায় টলমল, জুড়ায় হৃদয় জুড়ায় ব্যথা/একটুখানি স্নেহের কথা। একটু আশা ভালোবাসার/স্বর্গে যদি না পাই দিশা দুঃখ রাতের অমানিশা/থাকুক প্রাণে, থাকুক ভাই স্বর্গে যাবার কাজটি নাই।/দুটি আঁখি ছলোছলো বুলায় প্রাণে শান্তি-প্রলেপ/সে-ই তো ভালো, সেই তো ভালো। স্বর্গ যে নয় আঁধার কালো/চোখ ধাঁধানো আলোয় আলো পথহারা আর সব হারাদের/মিলবে না তো সেথায় ঠাঁই। হতভাগা ছন্দহারার/নাই যে আশা স্বর্গে নাই তাই তো সেথায় যাবো না ভাই। জননীর প্রস্থান ঘটেছে। তাঁকে আর কষ্ট করতে হবে না। এ সমাজ তো তাঁকে কিছুই দেয়নি। এখন আর কীই বা দিতে পারে? তবে তাঁর স্বপ্ন ছিল নিজ ভিটিতে পুত্রের নামে একটি অনাথালয় গড়ার। নামকরণও করেছেন ‘দীপংকর স্মৃতি অনাথালয়।’ একটি সাইনবোর্ডও নিজে ঝুলিয়েছেন বাড়িতে। বীরাঙ্গনা সাহিত্যিক রমা চৌধুরীর এই শেষ ইচ্ছাটুকু পূরণ হবে কি? লেখক : সাংবাদিক
×