ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

খালেদার জন্য কোন স্পেস রইল না ॥ এবার শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

খালেদার জন্য কোন স্পেস রইল না ॥ এবার শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালী জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে এক এবং অদ্বিতীয়, তেমনি তাঁরই সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের তুলনাও তিনি নিজেই। এই দম্পতিরই কন্যা শেখ হাসিনা, যিনি এরই মধ্যে সমসাময়িক বিশ্বে সবাইকে হাজার মাইল পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছেন এক স্বপ্নীল মহাসড়ক ধরে। তাইতো তার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে ‘শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান’ ঘোষণার। নিজ দেশের দিকে তাকালে বলতে হয় এই ঘোষণার পর খালেদা জিয়া বা তার দল বিএনপির এবং তাদের অশুভ সহচরদের জন্যে রাজনীতি করার আর কোন স্পেসই রইল না। মানুষ রাজনীতি করে দলীয় নেতা হবেন, এমপি হবেন, মন্ত্রী হবেন, একদিন প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি হবেন, কেউ কেউ কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক হবেন- এর বেশি চিন্তা করার ক্ষমতা কারও নেই। কিন্তু বাঙালী জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে একজন রাজনৈতিক কর্মীর জন্ম হয়েছিল যিনি আর দশজনের মতো এমপি-মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি-ধনাঢ্য রাজনৈতিক নেতা এ সব কিছুকেই ছাপিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন একটি জাতি ও জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং সমস্ত দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে তিনি সার্থকভাবে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করেছেন। এই মানুষটির নাম শেখ মুজিবুর রহমান। যাঁকে ভালবেসে ছেলেবেলায় ডাকা হতো খোকা। তারপর কলকাতায় অধ্যয়নকালে ছাত্রনেতা-যুবনেতা, ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের প্রাক্কালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এলএলবিতে প্রিলিমিনারিতে ভর্তি এবং ৪র্থ শ্রেণী কর্মচারী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় গ্রেফতার ও মুচলেকা না দেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার; ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ এবং ৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর ‘মুজিব ভাই’ ‘শেখের বেটা’; ৬ দফা দেবার পর বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা; আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির পর ‘বঙ্গবন্ধু’; ৭০-এর নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, স্বাধীনতা ঘোষণা এবং দুনিয়া কাঁপানো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালী জাতির পিতা এবং স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বা বাঙালীর জাতিরাষ্ট্রের পিতা, তৃতীয় বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নেতা হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী, ইয়াসির আরাফাত, ক্যাস্ট্রো, বুমেদিন, সুকর্নো, আলেন্দে, নেলসন ম্যান্ডেলার কাতরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ১৩ বছর পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। যেখানে পার্টির কাজে গেছেন সেখান থেকেই গ্রেফতার হয়েছেন। তাঁর অনুপস্থিতি তাঁর সহধর্মিনী দলীয় নেতা-কর্মীদের তাঁর অভার বুঝতে দেননি। শ্বশুর ও পিতার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমির ধান-চাল ও অন্যান্য ফসল থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে দল চালিয়েছেন, প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে বঙ্গবন্ধু ক্যান্টনমেন্টে বন্দী ছিলেন। এ সময় আইয়ুব খান বৈঠকের প্রস্তাব দেন, রাজি হলে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হবে। দলের অনেক নেতাই তাতে রাজি ছিলেন; কিন্তু বেগম মুজিব বললেন, শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, শেখ মুজিবসহ মামলার সব অভিযুক্তকে মুক্তি দিতে হবে। তাহলেই কেবল শেখ মুজিব আইয়ুবের সঙ্গে বৈঠকের জন্য পাকিস্তান যেতে পারেন, অন্যথায় কোনভাবেই যেতে পারবেন না। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আগে কি বলবেন না বলবেন এই নিয়ে দলীয় নেতা, অন্য দলের নেতা, ছাত্র-যুব সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। অনেকে অনেক পরামর্শ দিয়েছেন, বিশেষ করে ছাত্রনেতারা। কিন্তু বেগম মুজিব বলেছেন, ‘তুমি সারাজীবন রাজনীতি করছ, তুমি বাংলার মানুষকে চেন-জান, বাংলাদেশকে জান, তোমার মন যা বলবে তাই তুমি বলে দেবে, কারও পরামর্শ শোনার দরকার নেই।’ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন যা আজ বিগত আড়াই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক ভাষণ তথা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই মহীয়সী নারী হলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী আমাদের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা যাঁর মাতা-পিতা কিংবা যিনি তাঁদের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন, তিনি কি ছোটখাটো চিন্তা করেন? না করতে পারেন? যাঁর ধমনীতে বঙ্গমাতা ও বঙ্গবন্ধুর রক্ত বইছে তাঁর চিন্তা, তাঁর স্বপ্ন, তাঁর কর্মপরিকল্পনা, তাঁর দৃষ্টি সকলকে যোজন যোজন পেছনে ফেলে আকাশ স্পর্শ করবে সেটাইতে স্বাভাবিক। তিনি কি কি করেছেন এবং করে চলেছেন তার তালিকা দিয়ে প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। শুধু বলব তিনি মানুষের মর্যাদা দেন- ‘শোনহে মানুষ ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই’ - চন্ডীদাস। ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই/নহে কিছু মহীয়ান’- কাজী নজরুল ইসলাম। কবিগণ লিখে গেছেন আর তার মর্যাদা দিয়েছেন পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর কন্যা শেখ হাসিনা। আজ মহাসমুদ্রের তলদেশ থেকে মহাকাশের কক্ষপথে বাংলাদেশের অধিপত্য। আমরা যারা ষাটের দশকের ৬+১১ দফা গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত প্রজন্ম দেখে গেলাম বাংলাদেশের কোন নাগরিক না খেয়ে থাকেন না, নাঙ্গা পায়ে হাঁটেন না, শিশু-কিশোররা দলবেঁধে ইউনিফরম পরে স্কুলে যাচ্ছে, মঙ্গা দুর্ভিক্ষ শব্দাবলী এখন ডিকশোনারিতে ঢুকে গেছে, যাপিত জীবনে নেই। এরচেয়ে শুকরিয়া আর কি হতে পারে। এ অঞ্চলে আমাদের অবস্থান আজ হয় সবার ওপরে নয়তো পাশাপাশি। সবই হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সৎ, দক্ষ, মেধাবী, দূরদর্শী নেতৃত্বে। একটা ছোট উদাহরণ দিতে চাই- পাকিস্তানের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ক্রিকেটার ইমরান খান তার সভাসদদের এক বৈঠকে বলেছিলেন তিনি পাকিস্তানকে সুইজারল্যান্ড বানাবেন। একজন সভাসদ তখন বলেন, ‘সুইজারল্যান্ড বানাবেন ভাল কথা, তার আগে চেষ্টা করুন বাংলাদেশের মতো হওয়া যায় কি-না। বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিকভাবে যে অবস্থানে উঠে এসেছে ততখানি ওঠা যায় কি-না। অবশ্য বাংলাদেশের সমপর্যায়ে উঠতেও কমপক্ষে ১০ বছর লাগবে।’ শত বছরে (পুরো ২০২১ সাল) ডেল্টা প্ল্যানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ২০২১ সালের শেষ দিনটি পর্যন্ত এমন মহাপরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে যা দ্বারা ভবিষ্যতে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবে বা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে, তাদের আর পেছনে তাকাবার প্রয়োজন পড়বে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে নেদারল্যা-সের সহযোগিতায় এই শতবর্ষী ডেল্টা মহাপরিকল্পনা করা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়িত করার কাজ শুরু হলে প্রথম পর্যায়ে ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ১ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। মঙ্গলবার গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডেল্টা প্ল্যানের ঘোষণা দিয়ে বলেন, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এমন এক ব্যবস্থা রেখে যাব যাতে তাদের আর পেছনে তাকাতে হবে না, তেমনি ভবিষ্যতের জন্যও দুশ্চিন্তা করতে হবে না। এর আগে শেখ হাসিনা ভিশন ২০-২১ ঘোষণা করেছিলেন এবং একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া ‘স্বল্পোন্নত দেশ’-এর অবস্থান থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশ’ তথা মধ্যম আয়ের দেশ গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়ে কাজ শুরু করেন এবং এরই মধ্যে সফল হয়েছেন। বাংলাদেশ আজ ‘উন্নয়নশীল দেশ’-এর কাতারে। বিগত নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের স্লোগান ছিল ‘দিন বদলের সনদ’-এর বাস্তবায়ন। মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে জানতে চান- ‘আপনারা কি বিশ্বাস করেন দিন বদল হয়েছে? আমি আপনাদের মতামত জানতে চাই।’ সাংবাদিকরা আনন্দের সঙ্গে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দেন। বলেন, অবশ্যই দিন বদল হয়েছে, এই বাস্তবতা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। যদ্দুর জানা যায়, শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান (ব-দ্বীপ পরিকল্পনা) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এরই মধ্যে অনেক কাজ হয়েছে। অর্থাৎ ২০১৮-৩০ সাল এই সময়ে মোট ৮৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে, যাতে মোট ব্যয় হবে তিন লাখ কোটি টাকা। সরকারী, বেসরকারী, পাবলিক-প্রাইভেট পাটর্নারশিপ (ঢ়ঢ়ঢ়) এবং বিশ্ব জলবায়ু তহবিল থেকে এই অর্থের যোগান দেয়া হবে। তাছাড়া ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে গড়ে তোলা হবে ‘ডেল্টা নলেজ ব্যাংক’। নেদারল্যান্ডস এই মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। একটা তহবিলও গঠন করা হবে। দেশের পানিসম্পদ নিয়ে ১০০ বছর মেয়াদী একটি পরিকল্পনার খসড়া তৈরিতে নেদারল্যান্ডস সহযোগিতা দিয়েছে। পরিকল্পনা গ্রহণে নেদারল্যান্ডস এরই মধ্যে ৪৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। প্রথমেই বলেছি, শেখ হাসিনা আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে দেশকে এমন এক পর্যায়ে উন্নীত করেছেন যে, তার প্রতিপক্ষের জন্যে রাজনীতি করার কোন স্পেস রাখেননি। বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়ার জন্যে রাজনীতি করা রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অবশ্য খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে ইতিবাচক কিছু নেই। কখনই ছিল না। তার রাজনীতিতে সবটাই নেতিবাচক, অর্থাৎ কেবল আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিরোধিতা। দেশ ও দেশের মানুষের দিকে তাকাবার সময় কোথায় তার? তাছাড়া শেখ হাসিনা যেভাবে বাংলার মানুষকে চেনেন, জানেন, বাংলাদেশের কোন্ অঞ্চলের ভূমি কেমন, কোন্ অঞ্চলে কোন্ ফসল বেশি ফলে, এসব তিনি এত ভাল করে জানেন যে, যা দেশকে আজকের পর্যায়ে আনতে সাহায্য করেছে। পক্ষান্তরে খালেদা জিয়া তার জন্মস্থান ফেনীও ভাল করে চেনেন কিনা সন্দেহ। তাই তো তার কাছে জাতির প্রত্যাশাও নেই। পরন্তু তার প্রয়াত স্বামী জিয়া যে লিগাছি রেখে গেছেন তাও তার জন্যে কাল হয়েছে। বিশিষ্ট সাংবাদিক কলামিস্ট, কবি জাফর ওয়াজেদ লিখেছেন- জিয়ার money is no problem ঘুছাতে ছেলেকে হাওয়া ভবন বানাতে দিয়ে এবং ও will make difficult politics for the polician করতে গিয়ে মানি প্রবলেমে কারাভোগ করছেন এবং তার নিজের জন্যেই পলিটিক্স ডিফিকাল্ট হয়ে পড়েছে। ঢাকা ॥ ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ লেখক : সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ও সিনেট সদস্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×