ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ব্রহ্মপুত্র পাড়ে মনোমুগ্ধকর শোভা

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 ব্রহ্মপুত্র পাড়ে মনোমুগ্ধকর শোভা

সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্য পৃথিবীখ্যাত। এদেশের সৌন্দর্যে-মুগ্ধ হয়ে সৌন্দর্যপ্রেমীরা যেমন ঘর ছেড়েছে, তেমনি বিদেশী পর্যটকেরাও ছুটে এসেছে। প্রকৃতির বিচিত্র সৌন্দর্য মানুষের মনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে, যা যুগে যুগে বাংলায় কালজয়ী গীতি-কাব্যসাহিত্য সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে। বাংলার সবুজ-শ্যামল প্রান্তর-বয়ে চলা নদী, ঋতুবৈচিত্র্যের অপূর্ব সমাহার এদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। আর এজন্যই বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম লীলা-নিকেতন। বর্ষা যখন অলস মন্থর, একঘেয়েমি আর বিষণœ বিধুর নিঃসঙ্গতায় রূপান্তরিত হয় ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘ ও রৌদ্রের লুকোচুরি খেলতে খেলতে হালকা চপল ছন্দে শরৎ আসে। এ যেন একটু মেঘ, এক পশলা বৃষ্টি, এক ঝলক হাওয়া আর পরক্ষণেই সোনালি রোদ্দুর। এ সময় বাতাসে এক খুশির সুর বেজে উঠে। কবি জীবনান্দ দাশের ভাষায়-আকাশে সাতটি তারা যখন ফুটে আমি এই ঘাসে বসে থাকি; কামরাঙ্গা-লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো গঙ্গা সাগরে ঢেউয়ে ডুবে গেছে-আনিয়াছে-শান্ত অনুগত বাংলার নীল সন্ধ্যা-কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেনÑ দুই তীরে তার বিরহ ঘটায়ে, সমুদ্র করে দান, অতল প্রেমের অশ্রুজলের গান। বিশ^ব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের যে বিষাক্ত বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে তা আমাদের দেশকে প্রতিনিয়তই দুর্যোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কালো থাবায় প্রকৃতির অনবদ্য ধারাবাহিকতাও বিঘিœত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন একসময় আসবে যখন ঋতু বৈচিত্র্য বলে আর কিছু থাকবে না। প্রকৃতি তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলবে। তার কিছু ইঙ্গিতও আমরা ইতোমধ্যেই পেতে শুরু করেছি। শীতকালে শীতের তীব্রতা কম থাকা, বর্ষায় বৃষ্টি স্বল্পতা, কিংবা অমৌসুমে বৃষ্টিপাত, আবার প্রলম্বিত গ্রীষ্মকাল। অন্যদিকে ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে শরৎ ও হেমন্তকালের পরিধি। আমাদের অনুভবে শরৎ বা হেমন্ত এখন আর আগের মতো প্রাণময় হয়ে ধরা দেয় না। এতদিন প্রকৃতি যে নির্দিষ্ট ছকে হেঁটেছে তার থেকে অনেকটাই সরে এসেছে এখন। বিশেষত বৃক্ষ জগতেও নানামাত্রিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। কবির ভাষায়- এইখানে সূর্যের ততদূর উজ্জ্বলতা নেই। মানুষ অনেক দিন পৃথিবীতে আছে। ‘মানুষের প্রয়াণের পথে অন্ধকার ক্রমেই আলোর মতো হতে চায়’- ওরা বলে, ওরা আজও এই কথা ভাবে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা-/নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই- লুকোচুরি খেলা...। শরতের প্রকৃতি প্রেমের কবি কাজী নজরুলকেও আলোকিত করেছিল। প্রকৃতির মধ্যে মধুকরের কাছে যা কেবলমাত্র রং, কেবলমাত্র গন্ধ, কেবলমাত্র ক্ষুধানিবৃত্তির পথ চেনার উপায়চিহ্নহ্ন, মানুষের হৃদয়ের কাছে তাই সৌন্দর্য, তাই বিনা প্রয়োজনে আনন্দ। মানুষের মনের মধ্যে সে রঙিন কালিতে লেখা প্রেমের চিঠি নিয়ে আসে প্রকৃতি। বাইরে প্রকৃতি যতই ভয়ানক ব্যস্ত, যতই একান্ত কেজো হোক না- কেন আমাদের হৃদয়ের মাঝে তার একটি বিনা কাগজের যাতায়াত আছে। সেখানে তার কামার শালার আগুন আমাদের উৎসবের দীপমালা হয়ে দেখা দেয়; তার কারখানাঘরের কলশব্দ সঙ্গীত হয়ে ধ্বনিত হয়। বাইরে প্রকৃতির কার্যকারণে লোহার শৃঙ্খল ঝুম্ ঝুম্ করে, অন্তরে তার আনন্দের অহেতুকতা সোনার তারে বীনা ধ্বনি বাজিয়ে তোলে। আশ্চর্যের বিষয় একই প্রকৃতির দুই চেহারা, মুক্তির একই রূপ-ধর্ম; শব্দÑগঞ্জের মধ্যে দুই সুর, প্রয়োজনের এবং আনন্দের বাইরের দিকে তার চঞ্চলতা, অন্তরের দিকে তার শান্তি-একই সময়ে একদিকে তার কর্ম, আর-এক দিকে তার ছুটি; বাহিরের দিকে তার তট, অন্তরের দিকে তার সমুদ্র। যে-সব খবরকে কোন ভাষা দিয়ে বলা যায় না প্রকৃতিও তাই একই রকম। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে পারলে বোধকরি মানুষ হয়ে ওঠে অন্য এক মানুষ। জগৎ হয়ে উঠে অন্য এক জগৎ। উদার হয়ে যায় মন। ভেতরে কোন লোভ থাকে না, লালসা বাসা বাঁধে না, থাকে না বিত্ত-বৈভবের মোহ। প্রকৃতি মানুষকে শেখায় উদারতা। সেই উদারতার জাদুর কাঠির খোঁজ দ্বিজেন শর্মা পেয়েছিলেন। সে জাদুর কাঠি তিনি নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখেননি। আগুনের পরশমণির মতো তার সান্নিধ্যে আসা প্রত্যেকেই ছুঁইয়ে দিয়েছেন। প্রকৃতিকে কীভাবে আপন করে নিতে হয় তিনি সেই বীজ বুনে দিয়েছেন আমাদের ভেতর। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিভিন্ন উদ্যানে ঘুরে ঘুরে গাছ চিনিয়েছেন, উদ্যান তৈরি করেছেন, দুষ্প্রাপ্য গাছ রোপণ করেছেন, সংরক্ষণ করেছেন, পরিচর্যা করেছেন। ফুল-গাছ, লতা-পাতা, ঝোপ-জঙ্গল, নদী-পাহাড় নিয়ে সহজ-সরল ভাষার লেখা তিনি পৌঁছে দিয়েছেন মানুষের দোরগোড়ায়। বিজ্ঞানের কঠিন তত্ত্ব ও তথ্যগুলো সাহিত্যের ছন্দ-সুরে করে তুলেছেন প্রাঞ্জল। -শেখ আবদুল আওয়াল গফরগাঁও, ময়মনসিংহ থেকে
×