ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে শেখ হাসিনা

দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ০৮:০৩, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা

বিশেষ প্রতিনিধি॥ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সামনে নির্বাচন। দলের বিরুদ্ধে গেলে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। যারা নৌকার বিরোধিতা করেছে, তাদের দলে দরকার নাই। প্রধানমন্ত্রীর এই কঠোর অবস্থানের প্রেক্ষিতে দলটিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে, দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। বরগুনা, রাজশাহী এবং ঠাকুরগাঁওয়ে যারা নিজ দলের এমপিদের অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছেন তাদেরকে আজ শুক্রবার শোকজ নোটিস পাঠাবে কেন্দ্র। জবাব সন্তোষজনক না হলে বহিষ্কার করা হতে পারে। একই সঙ্গে যেসব এমপিদের অবাঞ্চিত করা হচ্ছে, তাদেরকেও চিঠি দিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে অনৈক্যের কারণ জানতে চাওয়া হবে। সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হারের পেছনে যারা কাজ করেছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের জরুরী সভায় এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে বলে বৈঠক সূত্র জানায়। বৈঠক সূত্র জানায়, রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অভ্যন্তরীণ বিভেদ ভুলে দলের স্বার্থে আগামী নির্বাচনের আগে সবার ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, নিজেরা দ্ব›েদ্ব জড়ালে অন্যরা সুযোগ পাবে। তাই সবার ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। একই সঙ্গে নির্বাচনী ক্যাম্পেইন জোরেশোরে শুরু করার জন্য দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের প্রতি নির্দেশনা দেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতি মন্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, কেন্দ্রীয় সদস্য মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনসহ অনেক নেতাই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। সূত্র জানায়, বৈঠকে দলীয় কয়েকজন এমপির কঠোর সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, নানা অপকর্মের কারণে অনেক এমপিই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। শিক্ষক এমনকি সুইপার-দফতরি নিয়োগেও টাকা খেয়ে এরা দল ও সরকার বিষয়ে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছেন। এই অবস্থায় আগামী নির্বাচনে বিতর্কিত এমপিদের বদলে নতুন ও সৎ স্বচ্ছ ইমেজের প্রার্থী না দেয়া হলে নেতিবাচক ফলাফল আসতে পারে। জবাবে দু’জন এমপি বলেন, আগামী নির্বাচনে অধিকসংখ্যক প্রার্থী হওয়ায় অনেকেই বর্তমান এমপিদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারসহ ‘বাতাস দেয়ায়’ পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। সবাইকে ঢালাওভাবে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে নিরুতসাহিত করা প্রয়োজন। জবাবে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা বলেন, এমপিদের তো সবার সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার কথা। তারা কেন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। তাদের তো মানুষের কাছে যেতে হবে। এ সময় এমপিদের অবাঞ্চিতকারী নেতাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে জবাব চেয়ে শোকজ করার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, একই সঙ্গে এমপিদের কাছেও চিঠি দিয়ে জানতে হবে কেন তারা সবাইকে নিয়ে কাজ করতে পারছেন না? কেন নেতাকর্মীরা তাদের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছেন? সূত্র জানায়, প্রথমে বক্তৃতায় আবদুর রহমান বরগুনার এমপি ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভুকে এলাকায় অবাঞ্চিত করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এছাড়াও সিলেট সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর হারের কারণ অনুসন্ধানের দাবি জানান। এ সময় কয়েকজন নেতা বলেন, নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদের ভ‚মিকা রহস্যজনক ছিল। তারা বদর উদ্দিন কামরানকে মেয়র হতে দেননি। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা জানান, এমন অভিযোগের সঙ্গে একমত পোষণ করে বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়ে বলেন, দলের বিরোধিতাকারীদের আওয়ামী লীগের দরকার নেই। বৈঠকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আজ শুক্রবার দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের টিম গঠন করে দেবেন। ওই তদন্ত কমিটি দ্রুত সময়ের মধ্যে দলের সভানেত্রীর কাছে প্রতিবেদন দেবেন। একই সঙ্গে যারা বরগুনা, রাজশাহী এবং ঠাকুরগাঁওয়ে দলীয় এমপিকে অবাঞ্চিত করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কেন সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হবে। জবাব সন্তোষ জনক না হলে তাদের বহিষ্কার করা হবে। এমপিরাও কেন এলাকায় সবাইকে নিয়ে কাজ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন সেটাও জানতে চাওয়া হবে। সতর্ক করা হবে তাদেরকেও। সূত্র জানায়, এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিজেদের মধ্যে দলাদলি করে এক গ্রুপ অপর গ্রুপকে অবাঞ্চিতকরণে দলের জন্য শুভ ফল বয়ে আনবে না। যারা দলের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ সময় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যাদের অবাঞ্চিত করা হয়েছে এবং অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছে উভয়ই ঢাকায় তলব করা হবে। বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের নেতা ও এমপিদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আমি সারাদেশে সার্ভে করেছি। আরও করব। যথাসময়েই মনোনয়ন দেয়া হবে। একদিন আগেও নয়, পরেও নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জবাব দিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে সরকারের উন্নয়নগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরার কথা বলা হয়। রাজশাহীর মেয়র বলেন, শুধু নমিনেশন দিলেই হবে না, প্রার্থীর অবশ্যই নিজস্ব ভোট ব্যাংক থাকতে হবে। তার কথার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী একমত পোষণ করে বলেন, বাইরে থেকে সাপোর্ট দিয়ে জয়লাভ করানো সম্ভব নয়। সে কারণে ব্যক্তিরও নিজস্ব ভোট থাকা উচিত। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে আবারও নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার জন্য দেশবাসীকে আহŸান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল বলেই বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়েছে, সেভাবেই এগিয়ে যাবে। এই উন্নয়নের গতিধারা ধরে রাখতে হলে নৌকায় ভোট দিতে হবে। আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় আনতে হবে। আর এই ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা অর্থবহ হবে। এর জন্য দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে হবে। আর এটা একমাত্র আওয়ামী লীগই আনতে পারবে। বৈঠকে সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দলীয় মেয়র প্রার্থীর পরাজয়ের বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে। এজন্য দলের মধ্যকার অনৈক্য ও স্থানীয় একটি অংশের নেতাদের বিরোধিতাকে দায়ী করা হয়। সূত্র জানায়, এ সময় সিলেটের যেসব নেতা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি- তাদের শনাক্ত করে শোকজ করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে সিলেটসহ যেসব জায়গায় দ্ব›দ্ব-কোন্দল রয়েছে সেগুলো দ্রæত নিরসনের তাগিদও দেন তিনি। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সর্বাত্মক নির্বাচনী প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য নেতাদের নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এমপি ও নেতাদের যার যার এলাকায় গিয়ে কাজ করতে হবে। জনগণের কাছে যেতে হবে, তাদের মন জয় করতে হবে। নৌকা মার্কার পক্ষে ভোট চাইতে হবে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাÐ তুলে ধরে তাদের সমর্থন আদায় করতে হবে। আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন বিষয়ে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থীদের অবস্থান নিয়ে দফায় দফায় জনমত জরিপ করা হচ্ছে। তিনি নিজেও জরিপ করেছেন। যাদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বেশি তারাই মনোনয়ন পাবেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় নেতাদেরও যার যার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় যেতে হবে। বর্তমান এমপি ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিষয়ে খোঁজ-খবর আগামী নির্বাচনে কাদের কাদের প্রার্থী করলে ভাল হবে, জয়ী হওয়া যাবে- সেগুলো জানাতে হবে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের পরিচালনায় বৈঠকে দলের সাংগঠনিক ও আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দলের কিছু কৌশলও চ‚ড়ান্ত করা হয়। এছাড়া ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্মদিনসহ বিভিন্ন দিবসে দলের কর্মসূচী চ‚ড়ান্ত করা হয়।
×