ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কর্মে নৈপুন্যে যজ্ঞে

প্রকাশিত: ০৭:১০, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

কর্মে নৈপুন্যে যজ্ঞে

যে কোন ধরনের শিল্পকলা প্রদর্শনীর আয়োজনে একটি দেশের জাতীয় রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্রমবিবর্তন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন শিল্পীদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান ও নানা ধরনের শিল্পকলা চর্চায় সমসাময়িক ধারা ও রীতিনীতি সম্বন্ধে একটা ধারণা তো পাওয়া যায়ই। এ প্রসঙ্গে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিবার্ষিকী এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৮১ সাল থেকে দ্বিবার্ষিকী চারুশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তখন ধারণা করা হয়েছিল শুধুমাত্র এশিয়া মহাদেশের শিল্পীরা প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করবেন। কিন্তু প্রথম প্রদর্শনীর পর থেকে এই প্রদর্শনীতে অন্যান্য মহাদেশের শিল্পীদের শিল্পকর্মও ব্যাপক কলেবরে প্রদর্শিত হতে শুরু করে। স্বভাবত কারণেই এই প্রদর্শনী শিল্পগুণ বিচারে সবদিক থেকেই অনন্য মাত্রা পেয়েছে। যে কোন ধরনের শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে শিল্পকর্ম যাচাই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। প্রদর্শনীর পরিসর যত বড় হয় এই প্রক্রিয়া ততই জটিল ও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে এবং আয়োজকদের দায়িত্বটাও অনেক গুণ বেড়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞজনদের ধারণা যেসব শিল্পকর্ম শুধু চোখে পড়ে না মনোযোগ দিয়ে দেখার আগ্রহ তৈরি করে যেসব শিল্পকর্মই প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়ার দাবি রাখে। এরপর শিল্পকর্ম বাছাইয়ে এর গুণগত উৎকর্ষ প্রচলিত তত্ত্ব ও ধারণার আওতায় পড়ে কিনা এবং বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্মের সমাবেশে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে কিনা সেটিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ১৮তম এই আয়োজনে আয়োজক দেশসহ ৬৮টি দেশের মোট ৪৬৫ জন শিল্পী এবং তাঁদের ৫৮৩টি শিল্পকর্ম নিয়ে শুরু হয় এই প্রদর্শনী। বিদেশী শিল্পীদের মধ্যে ২২৩ জন প্রতিযোগিতায় তাদের শিল্পকর্ম জমা দিয়েছেন, ২৯ জন বিদেশী শিল্পী বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নিচ্ছেন। এছাড়ও ১৪ জন পারফর্মেন্স আর্টিস্ট তাদের নৈপুর্ণ প্রদর্শন করেছেন। অপরদিকে বাংলাদেশী অংশগ্রহণকারী ১৯৯ জন শিল্পীর মধ্যে ১০৭ জন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন। ১৩ জন মাস্টার পেইন্টারের শিল্পকর্ম রয়েছে। বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নিয়েছেন ৬৩ জন শিল্পী এবং ১৬ জন দেশীয় পারফর্মেন্স আর্টিস্ট তাদের স্ব-স্ব পারফর্মেন্স ইতোমধ্যেই প্রদর্শন করেছেন। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে প্রদর্শনীতে শিল্পকর্ম প্রদর্শনে বড় ধরনের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এ সময় তৈলচিত্র জল রং ড্রইং ভাস্কর্য ছাড়াও প্রদর্শনীতে ইনস্টলেশন, মিশ্রমাধ্যম ও ফটোগ্রাফিসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম স্থান পেতে থাকে। একদম হালে এসে পারফর্মেন্স আট র্যে শিল্পকর্মে নতুন মাত্রা যোগ করেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দ্বিবার্ষিক চারুশিল্প প্রদর্শনীতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। প্রদর্শনীতে বাংলাদেশী শিল্পীদের কাজই সবচেয়ে বেশি স্থান পেয়েছে। সঙ্গত কারণে বাংলাদেশী শিল্পচর্চার ধারা সম্পর্কে এক সম্যক ধারণা পেতে যে কারোর পক্ষেই মোটামুটি সহজ। এখানে ঐতিহ্য এবং উপনিবেশিক শিল্পধারার সংমিশ্রণের পাশাপাশি সমসাময়িক বিশ্বের সকল শিল্পভাবনাকে এখানকার জীবন ও পরিবেশের মাধ্যমে শিল্পীরা সুনিপুণভাবে উপস্থাপন করেছেন। শিল্পীরা তাদের কাজের বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকগত সব মাধ্যম ও ধারারই ব্যবহার করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। এক্ষেত্রে বিষয়বস্তু বাদে আঙ্গিক ও পদ্ধতিতে সকল শিল্পকর্মই আন্তর্জাতিক মানদ- স্পর্শ করেছে বলা যায়। বাংলাদেশী প্রতিযোগিদের এক্রেলিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি কাজ দেখা যায়। তেলরং জলরং ছাপচিত্র ডিজিটাল আর্ট ভাস্কর্যও চোখে পড়ার মতো। প্রদর্শনীতে এবার দ্বিতীয় বারের মতো পারফর্মেন্স আর্ট স্থান পেয়েছে। মুকাভিনয়ের মাধ্যমে অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে একটা দৃশ্যকল্প তৈরি করা হয় বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে। সাংকেতিক শব্দ বা আবহসঙ্গীত ব্যবহার করে ভিডিও চিত্রের মাধ্যমেও দেখিয়েছেন এই শিল্পকে। বাংলাদেশী শিল্পীদের তেলরং জলরং ড্রইং ছাপচিত্র ভাস্কর্যে যত কাজ উপস্থাপিত হয়েছে তার বর্ণনা এখানে দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। আগেই বলা হয়েছে এক্রেলিক মাধ্যমের কাজ প্রদর্শনীতে বেশি প্রদর্শিত হয়েছে। তার মধ্যে এই ভূখ-ে প্রাচীন শিল্পকর্ম পাথরের ভাস্কর্যকে বিষয়বস্তু করে ক্যানভাসে এক্সলিকে পেইন্টিং করেছেন আশরাফুল ইসলাম। ‘বুদ্ধ-১’ শিরোনামের এই শিল্পকর্মে শিল্পী পাথরের স্থিতিস্থাপকতা ফুটিয়ে তুলেছেন যথেষ্ট মুন্সিয়ানার সঙ্গে। কাজল দেবনাথের ‘এভুলেশন’ নামক ইনস্টেলেশনে মানব দেহের মৃত্যু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জীবের যে সম্পর্ক তা তুলে এনেছেন। শিল্পী জয়ন্ত সরকার জন তাঁর ‘খাদ্য বিপরীত’ নামক চিত্রমালায় সমগ্র পৃথিবীর কোমলমতি শিশুদের ওপর নির্যাতন সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘অবিনাশি গান’ শীর্ষক ভাস্কর্যে শিল্পী আরমান হোসেন অনিক বিশ্বকবি রবীঠাকুরের যে অবয়ব ফুটিয়ে তুলেছেন তা অনবদ্য। দীর্ঘ অনুভূমিক সারফেসে ছাপচিত্রী আবুল হোসেন ঢালী তমাল তাঁর ‘কাক’ শীর্ষক ছাপচিত্রে বাংলাদেশের অতি পরিচিত পাখি কাকের যে আলো আধারীর আবহ তৈরি করেছেন তাতে যথেষ্ট মননশীলতার ছাপ রয়েছে। মোহাম্মদ মোজাহিদুর রহমানের ‘হয়েন উই বিকাম মেডিসিন’ নামক ইনস্টলেশন আর্টে আমাদের আধুনিক জীবনযাপনে ওষুধের যে প্রভাব তার তাঁর শিল্পকর্ম অবলোকন করে যে কেউ অনুধাবন করতে পারবে সহজেই। ‘লাইফ ইন অ্যা ফ্রাইং প্যান’ এর শিল্পী মেহেদী হাসান বলেন, আমরা যারা ব্যস্তময় দিনকে সামনে নিয়ে ঘুম থেকে জাগি, তাদের জন্য গরম কড়াই এ ভাজতে থাকা ডিম-পেয়াজ এর গন্ধ, ফুটন্ত তেলের হিসহিস শব্দ, সাথে হলদে কুসুমের সাথে মরিচের লাল-সবুজ রঙ মিশিয়েই তো সকালের শুরু। উচ্চবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত, ব্রেকাফাষ্ট টেবিল কিংবা পাড়ার হোটেলে - সকালের নাস্তায় ডিম যেন আমাদের কাছে অপরিহার্য। ডিম খাওয়ায় যেন নেই কোন ভেদাভেদ। তবে, ডিম খাওয়ার রকমফেরে চেনা যায় মানুষের সামাজিক ব্যবধান। কারো পোচের মধ্যিখানে জ্বলজ্বল করতে থাকে হলদে কুসুম, কেউ বা খায় পরোটা দিয়ে পেয়াজ মরিচের মামলেট, কেউ বা মাশরুমস, চিলি অ্যান্ড গার্লিক এর সাথে অমলে ড্যু ফ্রমাঁজ - সকালের শুরুতেই যেন বুঝিয়ে দেয়া হয় সমাজ কে কোন উচ্চতায়। ডিমের নানা চেহারায় মানুষের নানা পার্থক্যের কথা উঠে এসেছে তার শিল্পকর্মে। প্রতিবারের মতো জুড়িবোর্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এবারে প্রদর্শনীতেও তিনটি গ্রান্ড প্রাইজ এবং ছয়টি সম্মানজনক পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। এবার জুড়িবোর্ডের প্রধান ছিলেন ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। ১৮তম এই আসরে বাংলাদেশের পাঁচজন এবং ইন্ডিয়া, চীন থাইল্যান্ড এবং ফিলিস্তিনের একজন করে শিল্পীকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের দু’জন ও ইন্ডিয়ার একজনকে গ্রান্ড প্রাইজ এবং বাংলাদেশের তিনজন থাইল্যান্ড, চীন এবং ফিলিস্তিনের একজন করে শিল্পীকে তাঁদের শিল্পকর্মের জন্য সম্মানসূচক পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশের সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে আতিয়া ইসলাম এনি, তার ‘নান শেল ব্লো দ্যা শিরেন বিফোর ডিসট্রকশন’ শীর্ষক চিত্র কর্মের জন্য গ্রান্ডপ্রাইজ অর্জন করেছেন। তিনি আলাদা আলাদা তিনটি ক্যানভাসে এক্রেলিক মাধ্যমে একটি চিত্র রচনা করেছেন। চিত্রের বিষয়বস্তুতে সমসাময়িক বৈশ্যিক পরিস্থিতি স্থান পেয়েছে। সালমা জাকিয়া বৃষ্টি বাংলাদেশের আর একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পী। প্রদর্শনীতে তাঁর ‘দ্য সুপার হিউম্যান সিড্রম’ শীর্ষক ভিডিও ইনস্টেলেশন গ্রান্ড প্রাইজ অর্জনের কৃতিত্ব দেখিছে। শিল্পী তার শিল্পের বর্ণনায় বলেছেন অসতর্ক হৈচৈ আতঙ্কজনক সংমিশ্রণে নিমজ্জিত করে ক্রমাগত নিরন্তর ছুটে চলে একটি বালক। বাস্তব দৃষ্টিতে বিচার করলে পরিস্থিতিটি বাস্তব এবং হাজার হাজার শিশু প্রতিদিন এ অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়। একে আমরা বলি এসপি। এসপিতে ভুক্ত শিশুদের উপজিব্য করে তার এই শিল্প। শিল্প সৃষ্টিতে শিল্পী তাঁর সমসাময়িক চেতনাকে আধুনিকতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন বলার অপেক্ষা রাখে না। আর একজন গ্রান্ডপ্রাইজ প্রাপ্ত শিল্পী ভারতের কান্দন জি, এক্রেলিক মাধ্যমে আঁকা চিত্রকর্ম ‘সমকালীন সমাজ’ এ বৈশ্বিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে হিং¯্র ষাঁড়ের সামনে একজন মানুষ প্রতিরোধের ভঙ্গিতে দ-ায়মান। চারদিকে ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে আছে আনুষঙ্গিক বস্তু। চিত্রটি অবলোকন করে যে কেউ সহজেই অনুমান করতে পারবে আমাদের জীবনের ক্রমাগত জটিলতার সাম্যক রূপ। এছাড়া সম্মানসূচক পুরস্কারের মধ্যে বাংলাদেশের ফখরুল ইসলাম মজুমদার তার ‘ওডিসি-৩’ শীর্ষক ছাপচিত্রের জন্য, বাংলাদেশের নাজমুন নাহার কেয়া তাঁর ‘দ্য ভাইব’ শীষক মিশ্র মাধ্যমে করা শিল্পকর্মের জন্য, ফিলিস্তিনের মনতাহের জাওয়াব্রেহের তাঁর ‘ইলেভেন-১২, ১৪, ১৫’ শীর্ষক ডিজিটাল আর্ট পারফমেন্সের জন্য, চীনা চিত্রশিল্পী উইজুন তার ‘আয়রন কুকার’ নামক তৈলচিত্রের জন্য, থাইল্যান্ডের চিত্রকর ত্রিরাত শ্রীরাবিন কলি কলমে করা ‘বিল্ডিং’ শীর্ষক শিল্পকর্মের জন্য এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী একসময় উন্নত দেশগুলোতেই গ-িবদ্ধ ছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এসে সেই গ-ি ভেঙে পড়ে। পুঁজিবাদী দেশের শিল্পে একচেটিয়া আধিপত্য কমতে থাকে। তার ধারাবাহিকতায় এই প্রদর্শনী আজ প্রায় অর্ধশতকে পা দিয়েছে। প্রথম দিক থেকেই পরিচিত বলয়ের বাইরের শিল্পীদের আকর্ষণ করেছে। প্রতিবারই বিপুলসংখ্যক বিদেশী শিল্পীদের শিল্পকর্ম উল্লেখযোগ্য হারে এখানে প্রদর্শিত হয়। বিদেশীদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার শিল্পীদেও শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। গত ১৫০ বছরে দেশটি রূপান্তরিত হয়েছে একটি বহু সংস্কৃতিক দেশে। তাদের কাজে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ খুঁজে পাওয়া যায়। শিল্পী পিটার সিমিতিসের ‘শক অব দ্য নিউ’ এবং জুডিট ইভা বোজার্থ এর ‘এওই’ ইনস্টলেশন আর্টে সেই ধারাবাহিকতারই প্রতিফলন ঘটেছে। বিভিন্ন লোকজ শিল্পধারার সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধনে আর্জেন্টিনার শিল্পধারা সমৃদ্ধ হয়েছে। শিল্পী বোজারিও গার্সিয়া ডেল রিও দিয়াজের ‘ডেন্সিং ইন দ্য ডার্ক’ শীর্ষক শিল্পে পেপারের ওপর ড্রইং করে শিল্পভাস ফুটিয়ে তুলেছেন। ভুটানের ঐতিহ্যবাহী শিল্পধারায় নাম ‘জরিং চুসুম। যেখানে বৌদ্ধ ধর্মের নানা অনুষঙ্গ প্রতিফলিত হয়। ঐতিহ্যবাহী এই ধারার বাইরেও সেখানে আধুনিক শিল্পধারা একটা আলাদা মাত্রা তৈরি করেছে শিল্পী পেসাং দিমার ক্যানভাসে এক্রেলিক এবং শিল্পী পিমা শেরিংয়ের ট্রেসিং পেপারের ওপর ড্রইং সেই স্বাক্ষরতাই বহন করে। প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া কানাডিয়ানদের কাজ শুরুর দিকে দেশীয় শিল্পীদের হাত ধরে যাত্রা করলেও আস্তে আস্তে অভিবাসী শিল্পীদের দ্বারা তাদের শিল্প আধুনিকতায় নতুন মাত্রা পায়Ñ এবারের প্রদর্শনীইতে সে দেশের স্বল্প সংখ্যক চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে। প্রদর্শনীতে বাইরের দেশের শিল্পকর্মের মধ্যে চীনই বেশি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের দেশের এসব শিল্পকর্মে গত তিন চার দশকের ঐতিহ্যবাহী কাজ এবং সমসামরিক কাজের প্রতিফলন সহজভাবেই দৃষ্টিগোচর হয় এখানে শিল্পী উই উইশান এর ভাস্কর্য, জিয়াং ইয়াং-এর ‘আনসার্টেন আইডেনটিটি’ ইয়ান পিংয়ের ‘টেনডার হার্ড’ উল্লেখযোগ্য। মিসরের শিল্পকলায় তাদের প্রথাগত রং ও রেখা লোকগাঁথা, জীবনাচরণ প্রভৃতি খুব স্পষ্টভাবেই প্রতিফলিত হয়। প্রতিকাশ্রয়ী কাহিনীর সুনিপুণ উপস্থাপন সহজেই অন্য শিল্পকর্ম থেকে আলাদা করে দেয়। হাসান আবদেল ফাত্তাহ এবং মোস্তফা মোহাম্মদ আমিনের শিল্পকর্মে তা স্পষ্ট হয়েছে। জনসংখ্যার নিরিখে পোলেন্ডের পরিসর একেবারেই ছোট হলেও তাদের শিল্পকর্ম দেখে কেউ সেটা সহজেই অনুমান করতে পারবে না। প্রদর্শনীতে পিটর মিকোলাজের ‘মাই হেড’ নামক অনবদ্য শিল্প উপস্থাপিত হয়েছে। চিত্রশিল্পে ফ্রান্স একসময় কেন্দ্রভূমি ছিল। অনেক শিল্প আন্দোলনের সূত্রপাত এখানে। বিংশ শতাব্দীতে এখানে আধুনিক শিল্পকলায় সূত্রপাত হয়। ফ্রান্সের শিল্পীরা সারা পৃথিবীর ঘটনাপ্রবাহ ও বিষয় সম্পর্কে এখন সচেতন তাদের কাজেও সেটা প্রতিলক্ষিত হয়। প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত শিল্পকর্মের তার ব্যত্যয় ঘটেনি। ভারতীর শিল্পের ইতিহাস বহু পুরনো। তাদের নিজস্ব শিল্পধারায় যুগে যুগ সমৃদ্ধ হয়েছে তাদের শিল্প। সমসাময়িক কালে পাশ্চাত্য শিল্পধারা ও নিজস্ব ঐতিহ্য রীতি তাদের শিল্পে নতুন এক শিল্পপ্রবাহ তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। প্রদর্শনীতে দশরথ দাসের ‘মাই ড্রিম’ শীর্ষক এচিং পেইনিং এক্ষেত্রে প্রাণিধানযোগ্য। এছাড়া কৌশিক হালদারের ‘তুমি, আমি’ সিবানী শর্মার ‘হাইড এ্যান্ড সেক-২’ ভাস্কর্য ইতিহাস ঐতিহ্য ও সমসাময়িকতাকে সুন্দরভাবে ধারণ করেছে। ইরানের সমসাময়িক শিল্পকলা এখনও সেখানে বিতর্ক ও সমালোচনা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তবুও তারা শিল্পচর্চা আন্তর্জাতিক মানদ- স্পর্শ করতে সক্ষমতা অর্জন করেছেনÑ সে দেশের বেশ কয়েকজন শিল্পীর কাজের মধ্যে আলিরেজা, জমশেদ ইরানের কুশান অঞ্চলকে উপজীব্য করে ফটোগ্রাফি করেছেন যার কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। তুরস্কের একটা প্রাচীন শিল্পরীতি ছিল। অষ্টাদশ শতক থেকে দেশটি তার নিজস্ব শিল্পধারা হারাতে থাকে। এ সময় পাশ্চাত্য রীতির ব্যাপক সংমিশ্রণে নতুন এক শিল্পধারায় অবতারণা হয় সেখানে। শিল্পী ইনজিন ইজেনের ‘মাই গ্লুটোনাস মেথ মাউথ-১’ নামক স্ক্রিন প্রিন্টে শিল্পী তাঁর নিজস্ব শিল্পভাষা ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। পাশ্চাত্য শিল্পকেন্দ্রের আর এক উল্লেখযোগ্য স্থান যুক্তরাজ্য। তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের পাশাপাশি শিল্পের সফল ধারা তাদের কাজে কোন না কোনভাবে এসেছে। আয়োজনে বিভিন্ন শিল্পীর কাজের মধ্যে ডেভিট ভইলিয়াম কিফোর্ডের পকেট স্কাল্পচার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সব শেষে একথা বলা জরুরী যে এত বড় কলেবরে আয়োজিত একটি প্রদর্শনীর প্রচার প্রচারণার সঙ্কীর্ণতার দরুণ এর উজ্জ্বলতা যতটা প্রকাশ পাবার কথা তা পায়নি এবং গণ-মানুষের কাছে পৌঁছায়নি এর গ্রহণযোগ্যতা। তারপরও বলা যায় দ্বিবার্ষিক এশিয়া চারুশিল্প প্রদর্শনী সফল। এই প্রদর্শনী পাশ্চাত্যের একক শিল্প আধিপত্যকে ভেঙে দিয়ে বিশ্ব শিল্পধারাকে একটা নিরপেক্ষ স্থানে নিয়ে যাবে এটাই সবার বিশ্বাস।
×