ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কৌশলে অর্থপাচার ॥ পণ্য আমদানির নামে আসছে বালির বস্তা পাথর ছাই

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

কৌশলে অর্থপাচার ॥ পণ্য আমদানির নামে আসছে বালির বস্তা পাথর ছাই

রহিম শেখ ॥ ঋণপত্র খোলা হয়েছিল কাগজ আমদানির। একটি চীনা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বন্দরে চালানটি পাঠায়ও। বন্দরে আসার পর চীনের প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার ডলার পরিশোধও করা হয়। তবে কাভার্ডভ্যান নিয়ে নিজেদের আমদানি পণ্যের চালানটি খালাস করতে গিয়ে হতবাক আমদানিকারকের প্রতিনিধিরা। চীনের রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানটি কাগজ পাঠানোর কথা বলে কন্টেনারে পাঠিয়ে দিয়েছে ৪১০ বস্তা বালিমাটি। সম্প্রতি বন্দর চত্বরে কন্টেনারটি খুলে এক পাতা কাগজও পাননি কাস্টমস কর্মকর্তারা। শত চেষ্টা করেও পণ্য আমদানির নামে বালিমাটি পাথর ছাই আনা বন্ধ হচ্ছে না। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খোলা হলেও তা আসেনি। এ সবের বদলে কন্টেনারে এসেছে ছাই, ইট, বালি, পাথর ও সিমেন্টের ব্লক। কখনও ফেব্রিক্সের বদলে এসেছে দামী ওষুধ। আবার কখনও শূন্য কন্টেনার। পণ্য আমদানিতে বড় অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চলছে রীতিমতো নয়ছয়। হচ্ছে অর্থ পাচার। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এলসি খোলা থেকে শুরু করে শিপিং এজেন্ট, বন্দর, কাস্টমস, সিএ্যান্ডএফ এজেন্টসহ কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা এসব অপকর্ম করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৮৮৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। সেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৩৪৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র খোলা হয় ৬৪৭ কোটি ৩৪ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৫৩০ কোটি ৮১ লাখ ডলার। সে হিসাবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র খোলার হার বেড়েছে ২১ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এ সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ পণ্যটির এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছিল প্রায় ৩৮ শতাংশ। তবে যে পরিমাণে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে, সে অনুযায়ী শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেনি। ফলে বিদেশে অর্থ পাচারের মতো ঘটনা ঘটছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এছাড়া শিল্পের কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য ইত্যাদি আমদানির ক্ষেত্রে ঘোষণাবহির্ভূত অন্য মালামাল আমদানি করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়েই ফাঁকি দেয়া হচ্ছে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব। মিথ্যা ঘোষণায় আনা পণ্যসামগ্রী কারসাজির কারণে শুল্ক ফাঁকিতে পড়ছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। সংশ্লিষ্টদের মতে, স্ক্যানিংয়ের স্বল্পতা, ডাটা সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিকভাবে শেয়ারিং পদ্ধতি মজবুত না হওয়ায় এ ঘটনা ঘটছে। আমদানি ছাড়া রফতানি চালানের ক্ষেত্রেও ডকুমেন্ট জালিয়াতি ও মিথ্যা ঘোষণার অপকৌশল ধরা পড়েছে শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের হাতে। ফলে একের পর এক পণ্যের চালান আটক হলেও কমছে না শুল্ক ফাঁকির ঘটনা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মোঃ শহিদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, রাজস্ব উন্নয়নের অক্সিজেন। ব্যবসায়ী নামধারী কিছু অসৎ ব্যক্তি আর্থিক অনিয়ম করে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে, দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করছে। এনবিআর এসব প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেই থেমে থাকছে না। শাস্তির আওতায় আনতেও কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সূত্রে জানা গেছে, মূলধনী যন্ত্রপাতি বা শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতেও অহরহ উচ্চ শুল্কের পণ্য আসছে। এছাড়া মুদ্রা পাচারের জন্য নির্দিষ্ট আমদানি পণ্যের বদলে আসছে ইট, বালি বা পাথর। গত বছর মিথ্য তথ্য দিয়ে পণ্য আমদানির ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। এতে বিপুল অর্থ পাচার এবং শুল্ক ফাঁকি দিয়েছেন অসৎ ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্র জানায়, সম্প্রতি আটক চালানটির আমদানিকারক ঢাকার বনানীর প্রগ্রেস ইমপেক্স লিমিটেড। রফতানিকারক চীনের দালিয়ান রিশাংবো কমার্শিয়াল লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। গত ২১ জুন এই কাগজ আমদানির জন্য ব্র্যাক ব্যাংকের একটি শাখায় ১৫ হাজার ৪৪০ ডলার মূল্যের ঋণপত্র খোলে প্রগ্রেস ইমপেক্স লিমিটেড। পণ্য আমদানি চালানটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছার পর ব্যাংকিং চ্যানেলে চীনের প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার ডলার পাঠানো হয়। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান চালানটি খালাসের জন্য কাস্টমস হাউসে শুল্ক-কর বাবদ প্রায় ৭ লাখ ৮৮ হাজার টাকা পরিশোধ করে। এরপর গত ২৮ আগস্ট কাভার্ডভ্যান নিয়ে চালানটি খালাসের জন্য আমদানিকারকের প্রতিনিধি বন্দরে যান। কাস্টমস কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কন্টেনারটি খুলে হতবাক সবাই। কাগজের পরিবর্তে বস্তা খুলে বালি পাওয়া যায়। একটি, দুটি নয়, ৪১০ বস্তা বালিমাটি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, খোলার আগে কন্টেনারের দরজায় লাগানো সিল অক্ষত পাওয়া যায়। অর্থাৎ চীন থেকেই বালির বস্তা পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনার আগেও একাধিকবার আমদানি পণ্যের চালানে বালির বস্তা পাওয়া যায়। চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি চীন থেকে প্লাস্টিক দানার চার কন্টেনারের একটি চালানে বালির বস্তা পাওয়া যায়। এক বস্তা প্লাস্টিক দানাও পাওয়া যায়নি। অথচ চালানটি খালাসের আগেই ৭০ হাজার ৩৮০ ডলার চীনের রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠানো হয়েছিল। ২০১২ সালের অক্টোবরে কস্টিক সোডা আমদানির একটি চালানে ৯০০ বস্তা বালি পাওয়া যায়। আমদানিকারক চট্টগ্রাম রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের প্রতিষ্ঠান ইয়াং ওয়ান গ্রুপ সে সময় জানায়, চীনের রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে কস্টিক সোডা না পাঠিয়ে বালি পাঠিয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার ড. একেএম নুরুজ্জামান বলেন, এটা অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু এ পর্যন্ত একটি ঘটনায়ও প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। সবই তদন্ত চলছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, আমদানি চালানের মিথ্যা ঘোষণায় আসা এ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পণ্য শনাক্ত করা কঠিন। কারণ এখনও আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায় ঘাটতি আছে। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বন্দরে এসব পণ্য সঠিকভাবে পরীক্ষার জন্য ২০ থেকে ২৫ স্ক্যানার প্রয়োজন হলেও পুরনো কয়েকটি স্ক্যানার দিয়ে কাজ করতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাস্টমসের এক কর্মকর্তা জানান, তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে সাধারণত কায়িক পরীক্ষা চালানো হয় না। আমদানিকারকদের দেয়া হয় চালান দ্রুত ছাড়ের সুবিধা। এসব কাঁচামালে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানি হয় বলে এগুলোর ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত আমদানি ছাড়াও অন্যান্য বাড়তি সুবিধা দেয়া হয়। তাই বাড়তি শুল্কযুক্ত পণ্য বা আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের কায়িক পরীক্ষা এড়ানোর জন্যই পোশাকশিল্পের কাঁচামাল আমদানির মিথ্যা ঘোষণা দেয় কিছু প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া শুল্ক ফাঁকি দিতেও এ ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছেন তারা। চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে নিষিদ্ধ পণ্য আটকের ঘটনায় বর্তমানে উচ্চতর আদালতে মামলার সংখ্যা ৭ হাজার ২৯৭। এর সঙ্গে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ৯২৫ কোটি টাকা। এছাড়া গত এক বছরে জেটি পরীক্ষণে ৬২৪ মামলা করার ফলে অতিরিক্ত ৩৩ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। এছাড়া আনস্টাফিং ডিভিশন থেকে মামলা হয়েছে ৪০। কয়েকটি মামলার নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, পোশাকশিল্পের কাঁচামাল ঘোষণায় আমদানিতে রাজস্ব ফাঁকি দিতে চার ধরনের মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন আমদানিকারকরা। এগুলো হলো আমদানি পণ্যের পরিচিতি তালিকা (এইচএস কোড) পরিবর্তন, ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য আমদানি, সিপিসি (কাস্টমস প্রসিডিউর কোড) পরিবর্তন ও নথি জালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে এইচএস কোড পরিবর্তন বা ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য আমদানির ঘটনায়। এ বিষয়ে বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই দেশে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে অস্বাভাবিক তথ্য মিলছে। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট এলসির মালামাল বন্দর থেকে খালাসের সময় কন্টেনারে প্রকৃতপক্ষে কী আনা হয়েছে সেটি ফিজিক্যালি দেখার দায়িত্ব কাস্টমস কর্তৃপক্ষের। ফলে মাল খালাসের সময় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বিল অব এন্ট্রির পরিসংখ্যান থেকেও কিছু তথ্য মিলতে পারে। এছাড়া উদ্যোক্তারা যে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি খুলেছেন, সেগুলো দেশে এনে তা কারখানায় স্থাপন করা হয়েছে কিনা, তা সরেজমিন তদন্ত করা উচিত বলে ওই কর্মকর্তা মনে করেন। এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমদানির চিত্র ফুলানো-ফাপানো। প্রকৃতপক্ষে এর বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার দাবি রাখে। অনেক আমদানি পণ্যে কাস্টমস ডিউটি থাকে না। এরপরও সেসব পণ্যের আমদানি অতি মূল্যায়িত দেখানো হচ্ছে। যেখানে দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার একটা অংশ বাইরে পাচারের সমূহ ধারণা দিচ্ছে। এগুলো আমাদের জোরালো মনিটরিংয়ে রাখা দরকার। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে পণ্য আমদানির দেনা শোধে সৃষ্ট ফোর্সড লোনের (গ্রাহকের নামে বাধ্যতামূলক ঋণ সৃষ্টি করে আমদানির দেনা শোধ করা) নামে প্রতারণার ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। অসাধু কিছু আমদানিকারক ঋণপত্র বা এলসি খুলে পণ্য আমদানি করছেন। দেনা শোধের শর্তে পণ্যও বিক্রি করছেন। কিন্তু মেয়াদ শেষ হলেও টাকা পরিশোধ করছেন না। ফলে ব্যাংক বাধ্য হয়ে গ্রাহকের নামে ফোর্সড লোন বা বাধ্যতামূলক ঋণ সৃষ্টি করে বিদেশী ব্যাংকের দেনা শোধ করছে। ব্যাংকের এসব ঋণ গ্রাহক শোধ না করায় খেলাপি হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। বন্দরে স্ক্যানিংয়ের স্বল্পতা ॥ বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে অত্যাধুনিক স্ক্যানার ব্যবহার করা হয়। এ মাধ্যমে কন্টেনারের মধ্যে থাকা পণ্যের স্বচ্ছ ইমেজ পাওয়া যায়। অত্যাধুনিক স্ক্যানার না থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার কন্টেনারের মধ্যে কোন অবৈধ ও ক্ষতিকর পদার্থ থাকলে তা খুঁজে বের করা খুবই কঠিন। তাছাড়া প্রতিদিন শিল্পের কাঁচামাল, দুধসহ পাউডার জাতীয় বিভিন্ন পণ্য, রাসায়নিক, ভোজ্যতেলসহ তরল রাসায়নিক চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খালাস হচ্ছে। কোন কোন পণ্য সরাসরি কন্টেনারসহ আমদানিকারকের শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা ইয়ার্ডে চলে যায়। শিল্পপণ্য আমদানি বা খোলা যন্ত্রপাতিও স্ক্যানিং করা হয় না। আনস্টাফিং পণ্যও স্ক্যানিংয়ের বাইরে থাকে। বর্তমানে কিছু রফতানি পণ্য এবং অর্ধেক আমদানি পণ্য স্ক্যানিং হচ্ছে। স্ক্যানিং মেশিনের অভাব খুবই প্রকট।
×