ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ বিদায় হজের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ বিদায় হজের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

হজ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। হজের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্ব মানব সভ্যতার মহা-মিলনের নিদর্শন হজের মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়। হজই বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম মানবতার মহামিলনের এক অনন্য ব্যবস্থা যা আল্লাহ জাল্লা শানুহু প্রদত্ত মহাপ্রদত্ত ব্যবস্থা। কাবা কেন্দ্রিক এই ব্যবস্থা সর্বপ্রাচীন। হাজার হাজার বছর আগে হজরত আদম আলায়হিসছালাম ও মা হাওয়া আলায়হাছ্ছালাম জান্নাত থেকে পৃথিবীতে এসে মক্কা উপত্যকায় ঘর সংসার গড়ে তোলেন। হযরত আদম আলায়হিসছালাম জান্নাতে অবস্থানকালে সপ্তম আসমানে ফেরেস্তাদের ইবাদতগাহ দেখেছিলাম যার নাম বায়তুল মামুর। এই বায়তুল মামুর গৃহ প্রতিদিন হাজার হাজার ফেরেস্তাদের দ্বারা তওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করতেও তিনি দেখেছিলেন। পৃথিবীতে এসে মক্কা উপত্যকায় অবস্থানকালে তিনি বায়তুল মামুরের মতো একটি এবাদতগাহ্ নির্মাণের খায়েশ ব্যক্ত করে আল্লাহজাল্লাশানুহুর দরবারে দোয়া করেন। তা আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন এবং হযরত জিব্রাইল আলাইহিসছালামের নেতৃত্বে একদল ফেরেস্তাকে বায়তুল মামুরের মতো একটা গৃহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য প্রেরণ করেন। তারা পৃথিবীতে এসে মক্কা উপত্যকার ঠিক মধ্যস্থলে উর্ধে বায়তুল মামুর বরাবর একটি গৃহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। হযরত আদম আলায়হিসছালাম বিবি হাওয়া আলায়হাসছালামকে সঙ্গে নিয়ে ঐ ভিত্তির ওপরে পাথর গেঁথে গেঁথে মানুষ সমান একটি গৃহ নির্মাণ করেন। যার কোন ছাদ ছিল না। হযরত আদম আলায়হিসছালাম ও স্ত্রী হাওয়া আলায়হাসছালাম সন্তানদের নিয়ে ঐ গৃহ তাওয়াব বা প্রদক্ষিণ করতেন। নূহ আলায়হিসছালামের আমলে মহা প্লাবনে ঐ গৃহ ধসে পড়ে এবং স্তূপাকারে ওখানে পড়ে থাকে। এই গৃহের একটি কোণে হাজরে আছ্ওয়াদ সরিয়ে নিয়ে আবু কোবায়েজ পাহাড়ে সংরক্ষিত করে রাখা হয়। সেই সময় মক্কা যার প্রাচীন নাম বাক্কা বিরান ভূমিতে পরিণত হয়। আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম আলায়হিসছলাম তাঁর ছোট বিবি হযরত হাজেরা আলায়হাসছালামকে সদ্যজাত শিশু হযরত ইসমাইল আলায়হিসছালামসহ এই বিরাণভূমিতে রেখে যান। কয়েক বস্তা খেজুর এবং চামড়ার তৈরির পানি বহনের থলে বা মশকভর্তি পানি রেখে যান। কিছুদিন যেতে না যেতেই খেজুর ও মশকভর্তি পানি নিঃশেষ হয়ে যায়। হযরত হাজেরা ভীষণ খাদ্য ও পানি সঙ্কটে চিন্তায় পড়ে যান। তিনি পার্শ্ববর্তী পাহাড় সাফা ও মারোয়ার মধ্য স্থানে পানির খেঁাঁজে দৌড়াদৌড়ি করেন। হঠাৎ দেখতে পান তাঁর শিশুপুত্র ইসমাইলকে যেখানে বসিয়ে রেখে এসেছেন তাঁর পায়ের কাছে পানি মাটি ফুড়ে উত্থিত হচ্ছে। তিনি দৌড়ে এসে দু’হাত দিয়ে পানি ধরে শিশুপুত্রকে খাওয়ালেন এবং নিজে খেলেন। পানির ফোয়ারা এত বেগে উত্থিত হয়েছে যা ধরে রাখার জন্য আশপাশ থেকে পাথর কুড়িয়ে এনে একটা বাঁধ দিলেন। ফলে সেখানে একটা কূপের সৃষ্টি হলো। অফুরন্ত পানি। এই পানির উৎসের নামকরণ করা হলো জমজম। এই পানির গুণাগুণ অনেক। এতে ক্ষুধা নিবৃত্ত করে। মারাত্মক ব্যধির আরোগ্য দান করে। এই জমজম কূপ কেন্দ্র করেই মক্কা শরীফে জনবসতি গড়ে ওঠে। আল্লাহ্ তায়ালার নির্দেশে হজরত ইব্রাহিম আলায়হিসছালাম ঐ স্তূপাকারে পড়ে থাকা কাবা ঘরের ভিত্তির ওপর কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করেন এবং হজের প্রবর্তন করেন। তখন থেকেই মক্কা এবং আশপাশের লোক জিলহজ মাসে এখানে জড়ো হন। লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক অর্থাৎ হে আল্লাহ্ আপনার দরবারে হাজির। বলতে বলতে কালক্রমে হজ ব্যবস্থায় অনেক শিরক ও কুফর অনুপ্রবেশ করে। কাবা এর আশপাশে ৩৬০টি মূর্তি স্থাপিত হয়। ৬২০ খ্রীঃ রমাদান মাসে প্রিয় নবী (সাঃ) দশ সহস্রাধিক সাহাবা একরকম সঙ্গে গিয়ে মক্কা শরীফে বিজয় পতাকা উড্ডীন করেন। কাবা শরীফ থেকে মূর্তি অপসারিত হয়। ঘোষিত হয় সত্য এসেছে। অসভ্য দূরীভূত হয়েছে। নিশ্চয়ই অসত্য দূর হবারই। (সুরা বনি ইসরাইল; আয়াত ৮১) মক্কা বিজয়ের পরের বছর অর্থাৎ ৬৩১ খ্রীঃ প্রিয় নবী (সাঃ) রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বিরাট বাহিনীসহ তাবুক অভিযানে যান। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনকালে তিনি হজের নির্দেশনা লাভ করেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, সেই সব মানুষের জন্য আল্লাহর উদ্দেশে বায়তুল্লায় হজ করা অবশ্য কর্তব্য যাদের সেখানে যাবার সামর্থ্য আছে। মদীনায় এসে প্রিয় নবী (সাঃ) হযরত আবু বকরের নেতৃত্বে একদল সাহাবিকে হজ করতে মক্কায় প্রেরণ করেন। এ সময় হযরত আলী (রাঃ) প্রিয় নবী (সাঃ)-এর নির্দেশে সুরা তওবা কয়েকখানি আয়াত পাঠ করে শোনান। যাতে বলা হয় কাফের মুশরিকদের মক্কা শরীফে চার মাস থাকবার অনুমতি দেয়া হলো। এই সময়ের মধ্যে যারা ইসলামে দাখিল হবে তারাই কেবল মক্কায় থাকতে পারবে। যারা ইসলাম গ্রহণ করবে না তারা অন্যত্র চলে যাবে অর্থাৎ চিরতরে মক্কা ত্যাগ করতে বাধ্য থাকবে। ৬৩২ খ্রি: জিলহজ মাসে প্রিয় নবী (সা:) এক লাখ ৪০ হাজার সাহাবা একরামকে নিয়ে হজ করতে যান। এটাই তার জীবনের প্রথম ও শেষ হজ। এই হজে তিনি ৯ জিলহজ আরাফাত ময়দানে হজের যে খুতবা দেন সেই খুতবা বিদায় হজের ভাষণ নামে খ্যাত। খুতবার প্রারম্ভে হাম্দ ও সানা পাঠ করে তিনি উপস্থিত জনতার উদ্দেশ করে বলেন, হে মানুষ আজ আমার পায়ের তলায় অন্ধকার যুগের যাবতীয় শিরক, কুফর, কুসংস্কার অন্ধ বিশ্বাস দলিত মথিত হলো। আজকের এই দিনটির মতো, এই মাসটির মতো, এই জনপদের মতো তোমাদের একের ধন সম্পদ মান ইজ্জত জানপ্রাণ রক্ত অপরের নিকট অলংঘনীয় পবিত্র। তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে সাবধান থেকো মনে রেখ আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে তোমরা তাদেরকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছ তোমাদের তাদের ওপর যতটুকু অধিকার, তাদেরও তোমাদের ওপর ততটুকু অধিকার। দাস-দাসীদের ব্যাপারে তোমরা মনে রাখবে তারা তোমাদের ভাই। তোমরা যা খাবে, যা পরবে তাদেরকে তাই খেতে দেবে তাই পরতে দেবে। তিনি বললেন একজন নাক কাঁটা কাফইর ক্রীতদাসও যদি তোমাদের শাসক হয় তাহলেও তাঁকে মানবে। তিনি বললেন, তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি এক পর্যায়ে বললেন, কোন অনারবের ওপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন আরবের ওপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সবাই আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে। শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাক্ওয়া। তিনি বললেন হয়তো তোমাদের সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না, আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি আল্লাহর কেতাব ও তাঁর রসুলের সুন্নাহ। এই দুটোকে যদি তোমরা আঁকড়ে ধর তাহলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। সেই দীর্ঘ ভাষণ শেষে তিনি হাত নেড়ে সবাইকে আলবিদা জানালেন। এর একটু পরেই অহি নাজিল হলো : আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের দীন হিসেবে ইসলামকে সানন্দে অনুমোদন দান করলাম। এখানেই বিদায় হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)
×