ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চীনা ‘ইউয়ান’, ভারতীয় ‘রুপী’, তুর্কী ‘লিরা’ সবার দাম কমছে

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

চীনা ‘ইউয়ান’, ভারতীয় ‘রুপী’, তুর্কী ‘লিরা’ সবার দাম কমছে

পাঁচ-সাত দিনের জন্য কলকাতা বেড়াতে গিয়েছিলাম। এতে বিপত্তি হয়েছে দুটো। প্রথমত বিমানের টিকেট-অসম্ভব চড়া দামে তা কিনতে হয়। কারণ একটাই। ঈদের ছুটি। অনেকেই কলকাতা যাচ্ছে। তাই চাহিদা-সরবরাহের নীতিতে টিকেটের দাম কোম্পানিগুলো যাচ্ছেতাই ভাবে বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয় বিপত্তি প্রচ- গরম এখন কলকাতায়। তাও ভাল, কিন্তু গরমের সঙ্গে হিউমিনিটি। হাঁটা-চলার কোন উপায় নেই। এরই মধ্যে ভাল খবর পেলাম ডলার বাজারে। ভারতে এখন ডলারের দাম চড়া। প্রতিদিন তা বাড়ছে। সকালে এক দর তো বিকেলে আর এক দর। দেখলাম ৭০ রুপী, একদিন পরেই ৭০ দশমিক ২০ রুপী। আরেকদিন পরেই ৭১ রুপী। আমি তো অবাক। এটি ঘটছে। ভারতের রুপী বেশ কিছুদিন স্থিতিশীল ছিল। এখন দেখছি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা বলছেন তাদের রুপী অতি মূল্যায়িত। এর মূল্য আরও হ্রাস পাওয়া দরকার। তাহলে রফতানি বাড়বে। এই মুহূর্তে ভারতে রফতানি বাড়ছে কম। কিন্তু আমদানি অনেক বেশি। আমদানি খরচ বাড়ার মূল কারণ তেল। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বাড়ছে। ভারত বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি করে। বড় উৎস ইরান, কিন্তু ইরানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতানৈক্য চলছে। এই সূত্রে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে তাদের সঙ্গে চায়। কিন্তু ভারত এই চাপে নতি স্বীকার করতে রাজি নয়। এই অনিশ্চয়তারও তেলের দামের ওপর চাপা পড়েছে। অধিকন্তু তুরস্কের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল নয়। তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ফাটাফাটি চলছে। এক খ্রীস্টান ধর্মযাজককে তুরস্ক বন্দী করে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র তার মুক্তি চায়। তুরস্ক এতে অস্বীকৃত। এদিকে তুরস্কের মুদ্রা ‘লিরা’র দামও পড়ছে। পড়ছে মানে অস্বাভাবিকভাবে পড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে তুরস্কের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে এমন দেশগুলোর মুদ্রাতে। বলাবাহুল্য, ভারতও এর মধ্যে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে ‘এমাজিং মার্কেটের’। দেশগুলোর মুদ্রার মূল্য নিচের দিকে। ইন্দোনেশিয়ার ‘রুপীয়া’ চীনা ইউয়ান, ফিলিপিন্স পেসো, মালয়েশিয়ার ‘রিঙিট’, সিঙ্গাপুরী ডলার, থাইল্যান্ডের বাথ, রাশিয়ার রুবল, দক্ষিণ আফ্রিকার ‘র‌্যান্ড’, ব্রাজিলের রিয়েল, আর্জেন্টিার পেসো-এসব মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রভাব যেমন ভারতের মুদ্রায় পড়েছে তেমনি পড়েছে বাংলাদেশের টাকাতে। আমাদের টাকার মানও বহুদিন স্থিতিশীল থেকে এখন অবমূল্যায়িত হচ্ছে। খোলা বাজারে ৮৪-৮৫ টাকার ডলার বিক্রি হয়। আমাদের আমদানি খরচ যেমন বেড়েছে, ভারতেরও তাই। আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমবর্ধমান, তাদেরও তাই। তেলের মূল্যের চাপ কমাতে ভারত সরকার পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়াচ্ছে এবং তা ঘনঘন। ফলে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। ভারতীয় অর্থনীতিবিদরা নানা আশঙ্কা করছেন। আমাদের এই অবস্থায় একটু লাভ হওয়ার কথা। ভারতীয় রুপীর যদি দাম হ্রাস পায় তাহলে আমাদের আমদানিকারকদের সুবিধা। ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গভীর। চীনের কাছ থেকে আমরা সবচেয়ে বেশি মাল আমদানি করি। তারপরেই ভারত। ভারতের কাছ থেকে বছরে আমরা সরকারীভাবে কমপক্ষে ষাট-পয়ষট্টি হাজার কোটি টাকার মাল আমদানি করি। চীন থেকে কমপক্ষে এক লাখ কোটি টাকার মাল আনি। এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে চীনা মুদ্রা ‘ইউয়ান’ এবং ভারতীয় মুদ্রা ‘রুপী’র দুটোই অবমূল্যায়িত হচ্ছে। যেমন হচ্ছে আমাদের টাকার। যদি এই অবমূল্যায়ন আমাদের পক্ষে হয় তাহলে একই পরিমাণ ডলার দিয়ে আমরা বেশি পরিমাণ ভারতীয় ও চীনা মাল আমদানি করতে পারব। এছাড়া পর্যটক, ছাত্র এবং রোগীরা ভারতে কিছুটা সুবিধা পাবে। তবে অবশ্যই আমাদের টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ন্ত্রিত থাকতে হবে। এখানে সবারই উদ্দেশ্য হবে রফতানি বৃদ্ধি। আমরা যেমন রফতানি বৃদ্ধিকে মাথায় রাখি মুদ্রার মূল্যের ক্ষেত্রে তেমনি ভারত ও চীন তাই করে। এখন অবশ্য গোল বেঁধেছে অন্যত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় রফতানি বাজার। ভারত, চীন ও বাংলাদেশ সবারই বড় রফতানি বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পুঁজিবাদের নেতা, বাজার অর্থনীতির নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। উভয় দেশই পরস্পরের বিরুদ্ধে মালামাল আমদানিতে আমদানি শুল্ক আরোপ করেছে। এর ফলাফল কী হবে এখনও পরিষ্কার নয়। তবে দেখা যাচ্ছে চীনা অর্থনীতি চাপের মধ্যে আছে। এই প্রথম তাদের মুদ্রার মূল্য হ্রাস পাচ্ছে। শেয়ারবাজার তার ‘মার্কেট ক্যাপিটেলাইজেশন’ যথেষ্ট পরিমাণ হারিয়েছে। বহু বড় বড় কোম্পানি তাদের কারখানা চীন থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। ‘রোড ও বেল্ট’ ইনিশিয়েটিভ-একবার মনে হয়েছিল এটা সবাই গ্রহণ করে নেবে। কিন্তু ইদানীং মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ এবং মালয়েশিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয় ব্যাপারটা তা নয়। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন বলছেন তিনি ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা’ (ডব্লিউটিও) মানেন না। এই সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ করছে। এসব থেকে মনে হয় যুক্তরাষ্ট্র তার বিশ্ব বাণিজ্যিক সম্পর্ক নতুনভাবে রচনা করতে চায়। এটি হলে আমাদেরও ভাবনার বিষয় হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বড় রফতানি বাজার। তারা একটু ‘মোচড়’ দিলেই আমাদের সমূহ ক্ষতি। ভিন্ন অর্থে বলা যায় সারা বিশ্বেই এখন একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে ধাবমান। বর্তমানের ‘মুদ্রামানে ধস’ এর একটা লক্ষণ। চীন, ভারত ও বাংলাদেশসহ এমানিং মার্কেটের অর্থনীতিতে ব্যাংকগুলোও একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। সবাই ‘ব্যাংকলেড’ উন্নয়নের নীতি অনুসরণ করে আজকের জায়গায় এসেছে। এতে মদদ যোগাচ্ছে বাজার অর্থনীতি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে দেখা যাচ্ছে বাজার অর্থনীতির নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এখন এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তাদের কথা বাজার অর্থনীতিতে তাদের ক্ষতি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা চাকরি হারাচ্ছে। ওমান থেকে বড় বড় কোম্পানিগুলো তাদের কারখানা সরিয়ে নিচ্ছে অন্যত্র যেখানে শ্রমের মূল্য কম। ‘ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টিও তাদের চুরি হচ্ছে বলে অভিযোগ। অতএব ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘বাজার নীতির’ নীতি নতুন করে লিখতে চাইছেন। এদিকে বাজার অর্থনীতিতে আমাদের দেশগুলো ভালই করেছে। আমাদের মতো দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে, রফতানি বেড়েছে, মাথাপিছু বেড়েছে, সবচেয়ে বড় কথা লাখ লাখ লোক দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছে। লাখ লাখ লোক এখন একবেলা, দুইবেলা ভাত খেতে পারছে। চীনেও তাই। সেখানে কমপক্ষে ৫০ কোটি লোক দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছে। মধ্যবিত্তের জন্ম হয়েছে। বিরাটসংখ্যক লোক এখন মধ্যবিত্তের কাতারে নাম লিখিয়েছে। এরাই নতুন বাজার। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে অন্যত্র। বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে প্রকটভাবে। সারা বিশ্বের সম্পদ এক শতাংশ লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করছে ব্যাংকগুলো। বৈষম্য এমন একটা পর্যায়ে গেছে যেখানে তা প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। শুধু বৈষম্য নয়, জলবায়ু দূষিত হয়েছে। সমাজ ভেঙ্গে তছনছ হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে নতুন ধনাঢ্য ব্যক্তির জন্ম হয়েছে তারা স্ব-স্ব দেশ ছেড়ে দিচ্ছে। তারা তাদের সম্পদ পাচার করে নিয়ে নিচ্ছে উন্নত দেশে। কখনও কখনও নিচ্ছে কতিপয় দ্বীপ রাষ্ট্রে। সেই অর্থে দেশগুলো হয়ে পড়ছে বিত্তহীন ও মেধাহীন। এটা এক নতুন সমস্যা এরমধ্যে হয়েছে বিপত্তি। ছোট ও মাঝারি শিল্পের হয়েছে বিপদ। বিদেশী মালের প্রতিযোগিতায় তারা টিকতে পারছে না। আমার ধারণা মতে আমরা এই মুহূর্তে একটা ক্রান্তিকালে। সমাজতন্ত্র চলেনি। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো সম্পদ তৈরিতে সাফল্য দেখাতে পারেনি। তারা বণ্টনে সাফল্য দেখিয়েছে। তাই সেই ব্যবস্থা ধসে পড়ে। মনে করা হয়েছিল বাজার অর্থনীতি আমাদের শেষ নিয়তি। কিন্তু এই বিশ-ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতাতেই দেখা যাচ্ছে বাজার অর্থনীতি নতুন সঙ্কটের মুখোমুখি। ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা’ প্রশ্নের মুখোমুখি। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ইত্যাদিও প্রশ্নের মুখোমুখি। এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা চেষ্টা করছি টেকসই উন্নয়নের জন্য। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এখন দেখার বিষয় বিশ্ব কোন্ দিকে যায়। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×