ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুই শ’ কোটি টাকার প্রকল্প সম্পন্ন না করেই হস্তান্তর

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

দুই শ’ কোটি টাকার প্রকল্প সম্পন্ন না করেই হস্তান্তর

এমএ রকিব, কুষ্টিয়া থেকে ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতায় প্রায় ২শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে শিলাইদহে সদ্য নির্মিত ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্র ঠাকুরের কুঠিবাড়ী ও সংলগ্ন এলাকা’ রক্ষা প্রকল্পের বাঁধটি নির্মাণের মাত্র দুই মাসের মাথায় প্রমত্ত পদ্মার তীব্র পানির তোড়ে কিছু অংশ ধসে পড়ায় পুরো প্রকল্পটিই এখন হুমকির মুখে পড়েছে। সোমবার দুপুরের দিকে চোখের পলকে কয়া ইউনিয়নের কালোয়া অংশে এ বাঁধের অন্তত ৫০ মিটার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। খবর পেয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের লোকজন দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে জরুরী ভিত্তিতে বালি ভর্তি জিওব্যাগ ফেলে ভাঙ্গন রোধের প্রচেষ্টা চালায়। তবে এই প্রচেষ্টা কোন কাজে আসবে না এবং বাঁধের ব্যাপক এলাকাজুড়ে নদীতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছে স্থানীয়রা। এদিকে কাজের শুরু থেকেই প্রকল্পটি নিয়ে নানা অভিযোগ ছিল স্থানীয়দের মধ্যে। অভিযোগ করা হয়, ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্যে দিয়ে অসম্পন্ন প্রকল্পকে সম্পন্ন দেখিয়ে কাগজে কলমে প্রকল্পটি পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে নির্মিত ১৩ লাখ ব্লকের মধ্যে ২ লাখ ৫০ হাজার ব্লক এখনও নদী তীরে অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে। অথচ শর্তানুযায়ী মেইনটেনেন্স কাজের জন্য মাত্র ৬ শতাংশ ব্লক রাখার কথা। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, সরকারী উদ্যোগে কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক কুঠিবাড়ী রক্ষায় ‘বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুষ্টিয়া জেলাধীন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ী ও সংলগ্ন এলাকা রক্ষা’ নামের প্রায় ২শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পটির কাজ হাতে নেয়া হয় ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়া ডিভিশনের তত্ত্বাবধায়নে এ প্রকল্পের আওতায় নদীর তীর সংরক্ষণ কাজের মোট ৩ হাজার ৭২০ মিটার বাঁধ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়। এর মধ্যে কুঠিবাড়ী সংলগ্ন এবং পার্শ্ববর্তী পদ্মা নদীর ডান তীরে সুলতানপুর অংশে ২ হাজার ৭২০ মিটার এবং শিলাইদহ অংশে ১ হাজার মিটার সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু দুই অংশের মধ্যবর্তী ১ হাজার ৫শ’ ৩০ মিটার কাজ না হওয়ায় নতুন করে সৃষ্ট নদী ভাঙ্গনে সংরক্ষণ বাঁধ ও কুঠিবাড়ীকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ছিল ৩১ মে ২০১৮। কিন্তু গত ৩০ জুন অসম্পন্ন প্রকল্পকে সম্পন্ন দেখিয়ে কাগজে কলমে দাফতরিক নিয়মে হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে শিলাইদহ কুঠিবাড়ী রক্ষা বাঁধ প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। যদিও এ প্রকল্পের অর্থব্যয়ে তৈরি ১৩ লাখ ব্লকের মধ্যে ২ লাখ ৫০ হাজার ব্লক অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে। যেখানে শর্তানুযায়ী মেইনটেনেন্স কাজের জন্য মাত্র ৬ শতাংশ ব্লক রাখার কথা। কয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াউল ইসলাম স্বপন জানান, সোমবার দুপুরের দিকে কুঠিবাড়ী রক্ষাবাঁধের কয়া ইউনিয়নের কালুয়া অংশে হঠাৎ ভাঙ্গন দেখা দেয় এবং মুহূর্তের মধ্যে এ বাঁধের অন্তত ৫০ মিটার নদীগর্ভে চলে যায়। তিনি বলেন, যেভাবে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে কয়েক দিনের মধ্যে পুরো বাঁধ ভেঙ্গে নদীগর্ভে চলে যাবে। এছাড়া তিনি অভিযোগ করেন, স্থানীয় জনগণের ক্ষতি সাধন, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার, নির্ধারিত পরিকল্পনা ও নক্সাবহির্ভূত কাজ, প্রয়োজনীয় সামগ্রী অব্যবহৃত রাখা, অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্যদিয়ে অসম্পন্ন প্রকল্পকে সম্পন্ন দেখিয়ে তা হস্তান্তর করেছে প্রভাবশালী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনীর অঙ্গ সংগঠন ‘ডিজেল প্লান্ট’ এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিয়ারিং কোং’। তাদের এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের যোগসাজশে প্রায় ২শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পটি এখন হুমকির মুখে পড়েছে। এদিকে ‘বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুষ্টিয়া জেলাধীন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ী ও সংলগ্ন এলাকা রক্ষা’ প্রকল্পের পরিচালক জানান, সোমবার দুপুর ২টার দিকে কুঠিবাড়ী রক্ষা বাঁধের কালোয়া এলাকার কিছু অংশ ভেঙ্গে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার সব কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে পৌঁছে ক্ষতিগ্রস্ত অংশে তাৎক্ষণিক ভাঙ্গন রোধে সেখানে জিওব্যাগ ফেলানো হয়। তা ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নকালে কারিগরি কোন ত্রুটি ছিল কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। তবে স্থানীয়দের আশঙ্কা, ভাঙ্গন রোধে তাৎক্ষণিকভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ড যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা কোন ভাবেই কার্যকরী হবে না এবং যে কোন সময় এই বাঁধের বেশ কিছু এলাকা পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রকল্পে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্ধতন এক কর্মকর্তা বলেন, শিলাইদহ কুঠিবাড়ী রক্ষা বাঁধের কালোয়া এলাকার আগে যে স্থানে বাঁধ ধসে গেছে। সেখানে আন্ডার গ্রাউন্ড আর্থ পরিস্থিতির কারণে ডিজাইনে শাল বুল্লি পুঁতে শ্লপ তৈরির নির্দেশনা ছিল। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেই কাজটি না করার ফলেই এখনে ধসের সৃষ্টি হয়েছে। কুঠিবাড়ীর কাস্টোডিয়ান মুখলেচুর রহমান জানান, বাঙালী জাতির ঐতিহাসিক হেরিটেজ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত শিলাইদহ কুঠিবাড়ী রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তা প্রকৃত অর্থে কুঠিবাড়ী রক্ষার জন্যই করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এখানে কুঠিবাড়ী রক্ষার কোন কাজ হয়নি। নির্মাণ কাজ পুরোপুরি সমাপ্ত না করেই প্রকল্পটি ক্লজ করে দেয়া হয়েছে। অথচ মূল ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাটি কাজের বাইরে রেখে কিভাবে কুঠিবাড়ী রক্ষা সম্ভব হবে? এলাকাবাসী সুলতানপুর গ্রামের আলাউদ্দিন সেখ অভিযোগ করেন, এই কাজের ঠিকাদাররা স্থানীয়দের সঙ্গে চরমভাবে মাস্তানি করে সন্ত্রাসী কায়দায় ঘরবাড়ি ভেঙ্গে কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ না দিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো কাজ করেছে। প্রকল্প শুরুর সময় ঢাকা থেকে বড় বড় অফিসাররা এখানে এসে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, স্থানীয়দের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় রেখে কাজ করার কথা। কিন্তু তারা সেটা করেননি। উপরন্তু সন্ত্রাসী বাহিনী ও পুলিশ দিয়ে স্থায়ী বাসিন্দাদের হয়রানি করেছে। অটো মেশিনে তৈরি যেসব ব্লক দিয়ে নদীর পাড় বেঁধেছে সেগুলো এখন পানির ঢেউয়ে ধুয়ে চলে যাচ্ছে। মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডিজেল প্লান্টের সঙ্গে নির্মাণ কাজ সম্পন্নকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কোংয়ের সহকারী প্রকৌশলী বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়ম-অনিয়ম যা কিছু হয়েছে সবই পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরামর্শেই হয়েছে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান খান জানান, ‘কুষ্টিয়া জেলায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ী সংলগ্ন এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় পদ্মা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ’ প্রকল্পের সুলতানপুর অংশে ২ হাজার ৭২০ মিটার এবং শিলাইদহ অংশে ১ হাজার মিটার সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু দুই অংশের মাঝে ১ হাজার ৫শ’ ৩০ মিটার কাজ না হওয়ার ফলে নতুন করে সৃষ্ট নদী ভাঙ্গণে সংরক্ষণ বাঁধ ও কুঠিবাড়ীকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এমন কথা স্বীকার করেই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হস্তান্তরিত অসমাপ্ত প্রকল্পের কিছু অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরেন এবং সে কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
×