ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কারুপণ্য মেলা শিল্পকলায়

গ্রামীণ ঐতিহ্যের পসরা হস্ত ও কারুশিল্পের নিদর্শন

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

গ্রামীণ ঐতিহ্যের পসরা হস্ত ও কারুশিল্পের নিদর্শন

মোরসালিন মিজান ॥ গ্রামের ছবিটা আর আগের মতো নেই। এখন শহুরে হওয়ার প্রতিযোগিতা। টিকতে না পেরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে লোক ঐতিহ্য। এ অবস্থায় নিজেদের দায় থেকেই হয়তো কিছু চর্চা বাঁচিয়ে রাখার, এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন ঢাকার মানুষ। শহর ঢাকায় গ্রামীণ সংস্কৃতির উপস্থাপনা তাই মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। এই যেমন বর্তমানে শিল্পকলা একাডেমিতে চলছে কারুপণ্য মেলা। ছোট পরিসর আয়োজন হলেও বাংলাদেশের হস্ত এবং কারুশিল্প সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। না, এ আয়োজনের বেলায় ঢাকার দর্শনার্থীদের কথা তেমন ভাবা হয়নি। মূল চাওয়াটি- এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী উপলক্ষে আসা বিদেশী অতিথিরা ঘুরে দেখবেন। বাংলাদেশের তৃণমূলের সংস্কৃতি ও কারুভাবনা সম্পর্কে জানার সুযোগ পাবেন তারা। মূল আয়োজনটি জাতীয় চিত্রশালার নিচতলায়। উপরে গ্যালারিতে দেশ-বিদেশের শিল্পীদের চিত্রকর্ম ভাস্কর্যসহ ইত্যাদি। আর নিচে খোলা জায়গায় কারুপণ্য মেলা। জায়গাটি খুব বেশি দৃশ্যমান নয়। তবে একটু খেয়াল করলে চোখে পড়ে। এখানে বাংলাদেশের সূচিশিল্প, কাঁসা-পিতল শিল্প, মৃৎশিল্পের নিদর্শন। আছে ঐতিহ্যবাহী জামদানি। সিলেটের শীতল পাটি, রংপুরের শতরঞ্জি আছে। কৌতূহলী চোখে অনেকে দেখছেন। কিনছেনও। মেলার একটি স্টলে শুধুই নকশিকাঁথা। সুই সুতোর সূ² কাজ। যতেœর সঙ্গে কাজ করেছেন সোনারগাঁওয়ের শিল্পী হোসনে আরা। দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। নিজেই একটি কাঁথার ভাঁজ খুলে দেখান। সেখানে ফুল পাখি লতা পাতার ফর্ম। চমৎকার ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মাঝবয়সী সূচিশিল্পী জানান, একেবারে শৈশব থেকেই নকশিকাঁথার কাজ করছেন তিনি। মা দাদি নানিরা করতেন। তাদের কাছ থেকেই শেখা। ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন বলেও জানান তিনি। বিদেশী অতিথিরাও আগ্রহ নিয়ে দেখছেন তার নকশিকাঁথা। কেউ কেউ আবার নকশিকাঁথা স্টিচ ব্যবহার করে নতুন নতুন পণ্য তৈরি করছেন। ‘যথাশিল্প’ নামের একটি স্টলে দারুণ সব নোটবুক। কাপড় দিয়ে মোড়ানো প্রচ্ছদে সুতোর কাজ। কাঁথা থেকে নেয়া নকশা। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। নকশিকাঁথার পাশাপাশি একটি স্টলে পাওয়া যাচ্ছে তাঁতের শাড়ি। দামে কম। তবে দেশী সুতি কাপড়ের অন্যরকম আবেদন। কেমন যেন মায়া লেগে আছে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাকও আগ্রহ নিয়ে দেখছেন দর্শনার্থীরা। মেলার একটি স্টলে বসে হাতপাখার কাজ করছিলেন সুচিত্রা সূত্রধর ও লতারানী। সম্পর্কের দিক থেকে দু’জন শাশুড়ি ও বউমা। মিলে মিশে পাখার কাজ করছিলেন। দেখে মনে হয়, বাড়ির আঙিনা। তাদের সুই সুতোর কাজে দৃষ্টিনন্দন রঙিন পাখা দারুণভাবে আকর্ষণ করছিল দর্শনার্থীদের। হাতে তৈরি পাখায় ফুল তুলতে তুলতে সুচিত্রা সূত্রধর বললেন, কোনটির নাম ‘পদ্ম পাঙ্খা, কোনটি পাঁচ ফুইল্যা, কোনটির নাম আবার শত ফুইল্যা।’ লতা রানী ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘যেই পাখায় একশ ফুল থাকে সেটির নাম শত ফুইল্যা। আর যেইটাতে ফুল পাঁচটা, সেইটা পাঁচ ফুইল্যা! মেলায় আছে মসলিনের উত্তরাধিকার জামদানি। সোনারগাঁও থেকে আসা কারিগর আবুল খায়ের নিজেদের তৈরি জামদানি দিয়ে স্টল সাজিয়েছেন। ওপর থেকে নিচের দিকে ছেড়ে দেয়া শাড়িতে নানা রকমের কাজ। আদি নকশা। যিনি কিনবেন না, তারও কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করবে। যুবক বয়সী কারিগরটি বললেন, একটি শাড়ি তৈরিতে এক মাসের মতো সময় লেগে যায়। একজন নয়, দুইজন একসঙ্গে কাজ করি। সে অনুযায়ী মূল পাই না। এর পরও পৈত্রিক পেশা ছাড়তে মন চায় না। মেলায় ৫ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা দামের জামদানি আছে বলে জানান তিনি। কাঁসা ও পিতল শিল্পের অবস্থা আরও করুণ। ব্যবহার অনেক কমে গেছে। একসময় যা নিত্য ব্যবহার্য ছিল, মেলার স্টলে তা শোপিস হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। সান্ধ্য প্রদীপ, সুরমাদানী, পুজোর সামগ্রী মোটামুটি চলে। বাকিগুলো এখন ঘর সাজানোর হয়ে গেছে। কিছু নিদর্শন পুরনো আভিজাত্যকে এমনভাবে তুলে ধরছে যে, শৌখিন মানুষ মাত্রই সংগ্রহ করবেন। দুটি বাটির গায়ে মোটিফের ডিটেইল দেখে চোখ আটকে যায়। কী যে সুন্দর! দামও তেমন, প্রতিটি ৮ হাজার টাকা। বহুকাল আগে ব্যবহার হতো এমন একটি মেকাপবক্সও মেয়েরা মুগ্ধ চোখে দেখছিলেন। কাঁসা পিতলের এগুলো বিকল্প ব্যবহার। স্টলের দায়িত্বে থাকা নাজমুল হাসান দুঃখ করে বললেন, বিকল্প ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে তো শিল্প বাঁচে না। এই তরুণ জানান, এটি তার বাবার পেশা। কিন্তু ইচ্ছা সত্তে¡ও তিনি নিজে গ্রহণ করতে পারেননি। তার আরেক ভাই আছেন। তিনিও অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। এ অবস্থায় বাবা মানিক সরকর যতদিন বাঁচবেন ততদিনই কাজ অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি। একাধিক স্টলে মৃৎশিল্পের পসরা। একটি স্টলে রাজশাহীর টেপাপুতুল। নরম মাটি টিপে গড়া পুতুল ট্র্যাডিশনাল চেহারা নিয়ে হাজির হয়েছে। টেপা পুতুল নিয়ে মেলায় অংশ নিয়েছেন সুবোধ কুমার পাল ও তার স্ত্রী বিজলী রানী। সুবোধ আশার বাণী শোনালেন। বললেন, তার ছেলে মেয়েরাও পুতুল তৈরির কাজ করছে। মেলায় আছে শখের হাঁড়িও। ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়িতে রং করছিলেন বিখ্যাত শিল্পী সুশান্ত কুমার পাল। তার দুই ছেলেও এ কাজে আছেন বলে জানান তিনি। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করা শীতলপাটি নিয়ে মেলায় অংশ নিয়েছেন গীতেশ চন্দ্র। খুব ভাল একটি শীতলপাটির দাম ১০ হাজার টাকা বলে জানান তিনি। রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি নিয়ে এসেছেন মোঃ আনোয়ার। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্যের চমৎকার প্রদর্শনী। কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রদর্শনী ঘুরে দেখছেন বিদেশীরা। তাদের একজন প্রিচ আর সান। আমেরিকা থেকে আগত পারফর্মেন্স আর্টের শিল্পী নিজের পছন্দ মতো নানা সামগ্রী ক্রয় করেন। কেমন লাগছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, অসাধারণ অনেক কিছুই এখানে দেখতে পেলাম। কিনে নিয়ে যাচ্ছি। বন্ধুদের উপহার দেব। থাইল্যান্ডের আরেক শিল্পী ত্রিরাত শ্রীবুরিন বলেন, বাংলাদেশের গ্রামে এত ভাল ভাল কাজ হয়, ভাবিনি আগে। শহর দেখার পাশাপাশি এমন লোক কলা দেখতে পেরে সমৃদ্ধ হয়েছেন বলে জানান তিনি। মেলা চলবে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
×