ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপির পাঁচ দফা কি কূটনীতিকরা পূরণ করবেন?

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 বিএনপির পাঁচ দফা কি কূটনীতিকরা পূরণ করবেন?

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সরকার বা জনগণের কাছে নয়, বিদেশীদের কাছে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পাঁচ দফা শর্ত দিয়েছে বিএনপি। দলটির এই পাঁচটি শর্ত পূরণ করতে হলে শুধু সংবিধান সংশোধন নয়, জনপ্রতিনিধিত্ব আইন এবং ফৌজদারি আইনও পরিবর্তন করতে হবে। আর এটি হলে বিএনপিকে বিদেশীদের কাছে নয়, সরকারের কাছে যেতে হবে। সরকার না মানলে জনগণের কাছে গিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে তা আদায় করতে হবে। জনসমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়ে বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দিয়ে বিএনপির এমন অসাংবিধানিক প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, জনগণের কাছে না গিয়ে বিএনপি কী বিদেশীদের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চান কিনা। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি শর্তগুলো নাকচ করে দিয়ে বলেছে, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে বিএনপি এখন প্রায় প্রতিদিনই বিদেশীদের কাছে নালিশ করতে করতে ‘নালিশ পার্টি’তে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনেই বিএনপি একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে বানচাল করতেই নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে লিপ্ত। আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ীই হবে, সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধানের বাইরে কোন দাবি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার কারামুক্তিতে সরকারের কোন কিছু করণীয় নেই। সরকার ইচ্ছে করলেই তাকে মুক্তি দিতে পারবে না। দন্ডিত কোন আসামিকে মুক্তি পেতে হলে আদালতের মাধ্যমে কিংবা রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমেই সম্ভব। এ ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। মঙ্গলবার গুলশানের বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে তারা বৈঠক করে। বৈঠকে বিদেশী কূটনীতিকরা বিএনপির কাছে জানতে চান তারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা। জবাবে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি শর্তারোপ করা হয়। শর্তগুলো-কারাবন্দী খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্বাচনের পরিবেশ, দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন। বিএনপি নেতারা বলেছেন, এসব শর্ত পূরণ হলে তারা নির্বাচনে যাবে। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির এই পাঁচটি দাবিই সংবিধান, আরপিও এবং ফৌজদারি আইন পরিপন্থী। প্রথমত, খালেদা জিয়াকে মুক্তি পেতে হলে আদালতের মাধ্যমেই পেতে হবে। অথবা রাষ্ট্রপতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে সম্ভব। দ্বিতীয়ত, দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হলে বর্তমান সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কেননা, সংবিধানে দলনিরপেক্ষ সরকার বলে কোন বিধান নেই। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন কিংবা সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে হলে সকল রাজনৈতিক দলের সমঝোতা ছাড়াও এক্ষেত্রে বিদ্যমান জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে সংশোধন আনতে হবে। আর এসব শর্ত পূরণ করতে হলে সংবিধান, ফৌজদারি কার্যবিধি এবং আরপিও সংশোধন করতে হবে। আর এই তিনটি সংশোধনীর ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাতে। ক্ষমতাসীন দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও সরকারের সকল শীর্ষ নীতিনির্ধারক নেতাই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে তারা কোন সংলাপ করবেন না, সংবিধানের বাইরেও যাবেন না। সংবিধান অনুযায়ী সঠিক সময়ে নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতির কাজও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তারা। সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়কণ্ঠেই বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে তিনি বিএনপির সঙ্গে কোন সংলাপ করবেন না। নির্বাচনে আসা বা না আসা যে কোন দলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তাই বিএনপি চাইলে নির্বাচনে আসবে, কিন্তু সরকার কিংবা দলের পক্ষ থেকে তাদের কোন দাওয়াত দেয়া হবে না। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও বলছেন, জনগণের কাছে যাওয়ার মুখ বা ক্ষমতা নেই বলেই বিএনপি এখন প্রতিদিন বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে। বিএনপি মনে করছে, দেশের জনগণ নয়, বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিদেশীরাই তাদের ক্ষমতায় বসাবে। কিন্তু বাংলাদেশ যে এখন আগের অবস্থানে নেই, বাংলাদেশ যে এখন পরনির্ভরশীল নয়, আত্মনির্ভরশীল; সেটা হয়ত বিএনপি ভুলে গেছে। আর কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই যে দলনিরপেক্ষ সরকার বলে কিছু নেই, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়- সেটা ওই বৈঠকে থাকা বিদেশী কূটনীতিকরাও জানেন। শুধু নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং নির্বাচন সামনে রেখে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই বিএনপি বিদেশীদের বিভ্রান্ত করতে নানা শর্ত দিচ্ছে। তবে এসব ষড়যন্ত্র করে কোন লাভ হবে না, বর্তমান সংবিধানের বিধান মেনেই বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে। নির্বাচনে না এসে অন্যকিছু করার চেষ্টা করলে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবেই তাদের মোকাবেলা করবে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক জনকণ্ঠকে বলেন, বিএনপির এসব শর্ত সম্পূর্ণ সংবিধান পরিপন্থী, অবাস্তব, অবান্তর এবং চক্রান্তমূলক। কোন গণতান্ত্রিক দেশেই দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হয় না, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশী কূটনীতিকরা তা ভাল করেই অবগত। নির্বাচনকালীন সরকার শুধু রুটিন কাজ করে, নির্বাচনসহ সবকিছু পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন। এটাও তারা ভাল করেই জানেন। তিনি বলেন, বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে তো বর্তমান সরকার রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার করেনি। করলে ২০১৪ ও ১৫ সালে আন্দোলনের নামে ভয়াল অগ্নিসন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও, পুড়িয়ে প্রায় শতাধিক নিরীহ মানুষকে হত্যার সময়ই করতে পারত। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়েরকৃত এতিমের টাকা দুর্নীতি মামলায় দীর্ঘ ১০ বছর ধরে আদালতে চলার পর রায়ে দন্ডিত হয়ে তিনি কারাগারে রয়েছেন। এখন কারাগার থেকে মুক্তি পেতে হলে আদালতের মাধ্যমেই পেতে হবে। তাই বিএনপিকে বলব- অযথা সময় নষ্ট না করে নির্বাচনে আসুন, নইলে সাফ বলে দিন আসব না। তবে নির্বাচনে না এসে অতীতের মতো সন্ত্রাসের পথে গেলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীই তা মোকাবেলা করবে। আর আন্দোলন আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবেই মোকা-বেলা করবে। সূত্র জানায়, বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে কারাগারে আদালত স্থাপন করে খালেদা জিয়ার মামলা পরিচালনায় গেজেট প্রকাশে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করে শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে এটা করেছে। বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও কারাগারে আদালত স্থাপনকে সংবিধান পরিপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করে। এর জবাব দিতে বুধবার প্রেস ব্রিফিংকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, জেলের মধ্যে বিচার করা যাবে না এমনটা সংবিধানের কোথাও লেখা নেই। কারাগারের মধ্যে আদালত বসিয়ে বিচার করার প্রক্রিয়া তো চালু করেছেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। কর্নেল তাহেরকে জেলে কোর্ট বসিয়ে ফাঁসি দিয়েছিলেন। এটা কি বিএনপি ভুলে গেছে? তিনি বলেন, সংবিধানের কোথাও লেখা নেই যে জেলের মধ্যে বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ আদালতের ব্যবস্থা করা যাবে না। শারীরিক কারণে খালেদা জিয়াকে হাজিরার সুবিধা করে দেয়ার জন্যই এই বিশেষ আদালতের ব্যবস্থা।
×