ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আকাশবীণার কর্মীদের আন্তরিক হওয়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

  আকাশবীণার কর্মীদের আন্তরিক হওয়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ও বিমানের সেবার মান বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘নিরাপত্তার ইস্যুতে যুক্তরাজ্য কার্গো রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। আমরা নিরাপত্তার মান বৃদ্ধি করেছি বলেই- সে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়েছে। এ মান ধরে রাখতে হবে যাতে কোন বদনাম না হয়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বুধবার এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বিমানকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আমি চাই, বিমানের সঙ্গে যারা কর্মরত, প্রত্যেকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবেন। যেন কোন বদনাম না হয়। আমাদের দেশের যেন সুনাম হয়। বিমানের ইতিহাস সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু, বিমান ও বাংলাদেশ একই সূত্রে গাঁথা। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ১৯ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধুর হাতে জন্ম নেয়। বঙ্গবন্ধু নিজে বিমানের প্রতি এতটাই আন্তরিক ছিলেন যে, এর লোগো তৈরি ও চূড়ান্ত করার কাজ তিনি নিজে তদারকি করেন। আমরা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেও অনেক কাজ করি। কিন্তু ২০০৯ সালে ফের সরকার পরিচালনায় এসে দেখি বিমানের নাজুক অবস্থা। এ অবস্থায় প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা নেই। আজ বোয়িংয়ের বিস্ময় এই ড্রিমলাইনার বিমানে যুক্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সরকারের নেয়া পদক্ষেপে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির বিষয়গুলো তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের এই বিমানবহরে যখনই নতুন বিমান এসেছে আমি চেষ্টা করেছি নতুন নতুন সুন্দর সুন্দর নাম দিতে। কারণ আমাদের দেশটাকে তুলে ধরতে হবে। এটা শুধু আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। কারণ এটা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাতায়াত করে। কাজেই বিমানে যারা কাজ করবেন বা বিমানে যারা যাতায়াত করবেন বা বিমানে দেশী-বিদেশী প্যাসেঞ্জার যারা উঠবেন, তাদের জন্য একটা সুন্দর পরিবেশ দরকার। বিমানবালাদের পোশাক-পরিচ্ছদও পরিবর্তন করার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার পর পোশাকের যে ডিজাইন ছিল, ওটাই কিন্তু চলছিল। সেখানে আমরা কিছু পরিবর্তন নিয়ে এসে নতুন রং নতুন নতুন সময়োপযোগী পোশাকের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। বিমান বহরে আগামীতে আরও উড়োজাহাজ যোগ হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আরেকটা ড্রিমলাইনার চলে আসবে নবেম্বর মাসে। ইতোমধ্যে আমাদের নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছে, নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হবে। তখন হয়তো আর আসা সম্ভব হবে না। তবে আমি চাচ্ছি, এটা খুব দ্রুত এসে যাক এবং তার কাজ শুরু করুক। তারও একটা সুন্দর নাম দিয়েছি, এখন আর বলতে চাই না। যখন সময় হবে তখন জেনে নেবেন। এ ছাড়াও কানাডার সঙ্গে চুক্তি করেছি, এতে আমাদের অভ্যন্তরীণ এবং আঞ্চলিক যোগাযোগটা আরও বৃদ্ধি করতে পারব বলেও উল্লেখ করেন। চলতি বছরের হজ ফ্লাইট সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। বলেন, কোন কোন সরকার তো আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। যা হোক, একটা প্রত্যাহার করেছে। কারণ আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টা এখন উন্নত হয়েছে। আমি চাই, বিমানের সঙ্গে যারা কর্মরত প্রত্যেকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবেন। যেন কোন বদনাম না হয়। আমাদের দেশের যেন সুনাম হয়। এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, যখন কোন বিদেশি আসে বা যায় বা আমাদের দেশের যারা প্রবাস থেকে আসে, তারা যেন দ্রুত মাল খালাস করে চলে যেতে পারেন। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুততার সঙ্গে এগুলোর ব্যবস্থা করার আহ্বান জানান। নিরাপত্তার বিষয়টা সব সময় অবশ্যই খুব গুরুত্ব দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কারণ এটা মনে রাখতে হবে যে একটা স্বাধীন দেশ আমাদের, আমরা একটা সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চাই। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে যে সম্মান অর্জন করেছিলাম, সে সম্মানটা হারিয়ে গিয়েছিল ’৭৫’র ১৫ আগস্টের পর থেকে। সেটা আবার আমরা ফিরিয়ে নিয়ে এসে জাতির পিতার যে স্বপ্ন বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা, আমরা সেভাবেই এই দেশকে গড়তে চাই। আর সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি আর আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে যে উন্নয়ন করা যায়, সেটাও আমরা কিন্তু প্রমাণ করেছি। দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আজকে সারাবিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এই অর্জনটা ধরে রেখেই আমাদের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। একটা লক্ষ্য নিয়েই চলতে হয়। একটা দিক-নির্দেশনা থাকতে হয়। সে সঙ্গে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আমরা উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে সেই অমোঘ বাক্য ‘কেউ দাবায়া রাখতে পারবা না’ উচ্চারণ ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইনশা আল্লাহ কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। সেইভাবেই আমরা আমাদের পরিকল্পনাও করে দিচ্ছি। যেন এই বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। বিমানবন্দরের ভিভিআইপি লাউঞ্জে এই অনুষ্ঠানে ড্রিমলাইনারের ‘আকাশবীণা’ নামকরণ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যখনই নতুন বিমান এসেছে, চেষ্টা করেছি তারই একটা নতুন নাম দিতে। ছয়টি বিমান আসার পর প্রথম ড্রিমলাইনারটি গত মাসে এসেছে। বাকি তিনটির একটি নবেম্বরে এবং অবশিষ্ট দুটি আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে আসবে। নবেম্বরে যে ড্রিমলাইনারটি আসছে প্রধানমন্ত্রী সেটির নামও ঠিক করেছেন বলে জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা নতুন বিমান সংযোজন করছি; বিমান যেন ভালভাবে চলতে পারে। যোগাযোগ একটি দেশের জন্য অতন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের আকাশপথ, রেলপথ, সড়কপথ সবগুলো যোগাযোগ ব্যবস্থা যেন উন্নত হয় সেজন্য আমরা বিশেষভাবে কাজ করে যাচ্ছি। ড্রিমলাইনার চালানোর জন্য সিঙ্গাপুর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বিমানের ১৪ জন বৈমানিক। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে প্রকৌশল বিভাগের ১১২ জনকে। এ ছাড়া কেবিন ক্রুদেরও দেয়া হয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণ। আকাশবীণায় আসন সংখ্যা ২৭১টি। এর মধ্যে বিজনেস ক্লাস ২৪টি, ২৪৭টি ইকোনমি ক্লাস। দুই পাশের প্রত্যেক আসনের পাশে রয়েছে বড় আকারের জানালা। একইসঙ্গে জানালার বোতাম টিপে আলো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত উড়োজাহাজ ‘আকাশবীণা’ নিয়ে বিমানের বহরে উড়োজাহাজের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫টি। একটানা ১৬ ঘণ্টা উড়তে সক্ষম বোয়িংয়ের এই উড়োজহাজটি; এটি ঘণ্টায় ৬৫০ মাইল বেগে উড়তে পারে। ড্রিমলাইনারে জ্বালানি খরচ ২০ শতাংশ কম। চারটি ৭৮৭ ড্রিমলাইনারসহ ১০টি উড়োজাহাজ কিনতে ২০০৮ সালে মার্কিন বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের সঙ্গে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে বিমান বাংলাদেশ। এর মধ্যে, বোয়িং-৭৭৭ এর নাম পালকি, অরুণ আলো, আকাশ প্রদীপ, রাঙা প্রভাত, মেঘদূত এবং বোয়িং-৭৩৭ এর নাম ‘ময়ূরপঙ্খী’ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান খান ও মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ মহীবুল হক, বিমান বোর্ডের চেয়ারম্যান ইনামুল বারী এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম মোসাদ্দিক আহমেদ বক্তব্য রাখেন। এতে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্র্নিকাট, তিন বাহিনীর প্রধান, বোয়িং-এর কর্মকর্তা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল নাইম হাসান, সদস্য এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান, বিমান সিবিএ সভাপতি মশিকুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক মনতাছার রহমান, হাব সভাপতি আব্দুস সোবহান ভুইয়া ও মহাসচিব শাহাদত হোসাইন তসলিমসহ বিমানের উর্ধতন কর্মকর্তাগণ। প্রধানমন্ত্রী বেশ আগ্রহসহকারে ড্রিমলাইনার সম্পর্কে বলেন, এর বিজনেস ক্লাসের আসনগুলো ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত সম্পূর্ণ ফ্ল্যাটবেড হওয়ায় যাত্রীরা আরামদায়কভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন। উড়োজাহাজটির প্রতিটি আসনের সামনে প্যানাসনিকের এলইডি এস-মনিটর রয়েছে। মনিটরে বিবিসি, সিএনএনসহ নয়টি টিভি চ্যানেল দেখা যাবে। একইসঙ্গে ইন-ফ্লাইট এন্টারটেইনমেন্ট সিস্টেমে (আইএফই) থাকবে ১০০টির বেশি চলচ্চিত্র। ড্রিমলাইনার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৩ হাজার ফুট ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়ও ওয়াইফাই সুবিধা পাবেন যাত্রীরা। এ ছাড়া মোবাইল ফোনে রোমিং সুবিধা থাকলে আকাশে উড্ডয়নের সময় কল করতে পারবেন যাত্রীরা। এ জন্য ২৫টি স্যাটেলাইটের সঙ্গে করা হয়েছে চুক্তি। এই ড্রিমলাইনারের তৈরি করেছে জেনারেল ইলেকট্রিক (জিই)। বিমানের শব্দ কমাতে ইঞ্জিনের সঙ্গে শেভরন যুক্ত রয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণ হবে ইলেক্ট্রিক ফ্লাইট সিস্টেমে। ভূমি থেকে ৫৬ ফুট উচ্চতার উড়োজাহাজটি কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালে তৈরি ওজনে হাল্কা। উড়োজাহাজটির ককপিটেও রয়েছে নতুনত্ব; এটি একটি পেপারলেস এয়ারক্রাফট, যেখানে থাকছে হেডআপ ডিসপ্লে। এর মাধ্যমে চোখের সামনের প্রয়োজনীয় তথ্য দেখতে পারবেন বৈমানিকরা। সার্বক্ষণিক ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঢাকায় ফ্লাইট অপারেশন রুমের সঙ্গে যুক্ত থাকবে এটি। ফলে উড়োজাহাজের ইঞ্জিন, ককপিট, ফুয়েল, নেভিগেশনসহ সব তথ্য জানতে পারবেন ফ্লাইট অপারেশন বিভাগের কর্মকর্তারা। যেকোন সমস্যা হলে তারা অপারেশন রুম থেকে বৈমানিককে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে পারবেন। এজন্য ঢাকায় বিমানের প্রধান কার্যালয়ে চার কোটি টাকা ব্যয়ে সার্ভার স্থাপন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যেও নিরাপত্তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী একটি কেক কাটেন এবং নতুন এই উড়োজাহাজের ভেতরে ঘুরে দেখেন।
×