ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জোটের আকার বৃদ্ধি হলে আওয়ামী লীগের জন্য লাভ -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

জোটের আকার বৃদ্ধি হলে আওয়ামী লীগের জন্য লাভ  -স্বদেশ রায়

গত কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছোট ছোট কয়েকটি রাজনৈতিক দল মিলে জোট গঠন করছে। বামপন্থী কয়েকটি রাজনৈতিক দল মিলেও একটি জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যে জোটবদ্ধ রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, সেটা তারা বড় দল ও দশ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকার পরেও প্রকাশ করেছে। কোন সাংগঠনিক সভায় নয়, অন্য কোন জোটের সঙ্গে আলোচনার সময়ে নয়, সরাসরি সংবাদ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি মি. ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তাঁর দল বড় দল হলেও তারা আগামী নির্বাচনে ৭০টি আসন ছেড়ে দেবে ছোট দলগুলোর জন্য। মি. ওবায়দুল কাদের সময়ের সঙ্গে তাল রেখে সঠিক তথ্যটি দেশের মানুষের জন্য যেমন তেমনি ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের জন্য জানিয়ে দিয়েছেন। ওবায়দুল কাদের প্রাথমিকভাবে সত্তরটি আসন ছেড়ে দেবার কথা বলেছেন। ধরে নেয়া যায়, এই আসন সংখ্যা আরও কিছু বাড়বে। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি যখন সত্তরের কথা বলেছেন, তখন এ আসন সংখ্যা আশিতে পৌঁছাতে কোন কষ্ট হবে বলে মনে হয় না। এখন দেখা যাক, আওয়ামী লীগ কোন্ সময়ে এই আসন ছাড়ছে? এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা আইআরআই-এর জরিপ মতে দেশের ৬৪ শতাংশ মানুষ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর আস্থাশীল। অন্যদিকে ৬৬ শতাংশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ওপর আস্থাশীল ও ৬৯ শতাংশ মানুষ বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সন্তুষ্ট। অন্যদিকে একই আন্তর্জাতিক সংস্থা ওই জরিপে বলছে, দুর্বল নেতৃত্বের কারণে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বিএনপি কোন প্রতিযোগিতায় আসতে পারবে না। এমন একটি সময়ে আওয়ামী লীগ দেশের ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের জন্য ৩০০ আসনের ৭০টি আসন ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা হয়ত ৮০ তে গিয়ে পৌঁছাতে পারে। বর্তমানের এই শক্তিশালী অবস্থায় থেকে আওয়ামী লীগ সত্তর বা আশিটি আসন ছেড়ে দেবার পক্ষে। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বা রাজনৈতিক কৌশলে এগোতে হলে বিএনপিকে তার জোটের সঙ্গে থাকা ছোট দলগুলোকে কমপক্ষে আওয়ামী লীগের দ্বিগুণ অর্থাৎ ১৬০টি আসন ছাড়তে হবে। তারপরও বিএনপির এই ১৬০ আসন কোন মতেই আওয়ামী লীগের আশি আসনের সমান দামী নয়। কারণ, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপির কাছ থেকে ছোট দল বা ইসলামিক কিছু দল এই ১৬০টি আসন পেলেও তারা এর থেকে যে পাঁচটি আসনে জিতবে, তার কোন গ্যারান্টি নেই। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দেশের পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন তার প্রমাণ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে পাওয়া আশিটি আসনের সত্তর আসনেই জিতে আসার সম্ভাবনা রয়েছে ছোট দল ও ইসলামিক দলগুলোর। তিন শ’ আসনের সত্তর আসনে জিতে আসার অর্থই হলো শরিক দলগুলো অনেক বড় বিরোধী দল হিসেবে বা ক্ষমতার অংশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পারবে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, বিএনপি দুর্বল অবস্থানে আছে, তারা এক শ’ ষাটটি কেন দু’শ’ আসনও ছেড়ে দিতে পারে। তবে আওয়ামী লীগ কেন সত্তর বা আশিটি আসন ছাড়তে যাবে? আর ছোট ছোট দল ও ইসলামিক দলগুলো যেখানে বিএনপিতে বেশি আসন পাবে, সেই আসন ছেড়ে তারা কেন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কম সংখ্যক আসন নেবে? প্রথম কথায় আসা যাক, আওয়ামী লীগ বর্তমানে এই শক্ত অবস্থানে থাকার পরেও কেন সত্তর বা আশিটি সিট ছাড়তে যাবে? শেখ হাসিনার বর্তমান রাজনীতি ও সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি দেশকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান। বিশেষ করে বিমসটেক সম্মেলন থেকে ফিরে এসে তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে ২০২১ সালের মধ্যে যে অন্য উচ্চতায় নেবার কথা বলেছেন, এটা তারই প্রকাশ। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার পরিকল্পনা রয়েছে আগামী পাঁচ বছরে নিরবচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশকে প্রায় উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়া। আর সেক্ষেত্রে তাঁর সব থেকে বড় প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন। কোন দেশের নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়নের জন্য দুটো বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: এক. আইনের শাসন, দুই. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বা এক ধরনের জাতীয় ঐক্য। এই নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন ও জাতীয় ঐক্যের জন্য শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ তাদের দলের স্বার্থ ত্যাগ করে, দেশের স্বার্থে এই আসন ছেড়ে দিয়ে একটি জাতীয় ঐক্য গড়তে চায়। কারণ, এ ধরনের একটি জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এলে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার গ্যারান্টি বেশি পাওয়া যায়। অন্যদিকে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করার জন্য সব সময়ে কাজ করে দুটি শক্তি অর্থাৎ জামায়াত ও বিএনপি। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে এরা স্বাভাবিকভাবেই আরও দুর্বল হয়ে যাবে। যেমন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে। এর ভেতর দিয়ে দেশের রাজনীতিতে সব থেকে বড় সন্ত্রাসী শক্তি জামায়াতে ইসলামী দুর্বল হয়ে গেছে। অন্যদিকে একুশে আগস্ট মামলার রায়, বেগম জিয়ার বিচার ও আগামী নির্বাচনের ভেতর দিয়ে দেশের রাজনীতির অপর সন্ত্রাসী শক্তি বিএনপি আরও দুর্বল হয়ে যাবে। আগামী নির্বাচনের পরে সত্যি অর্থে দেশে একটি বৃহৎ অর্থনীতি দাঁড় করানোর সময় এবং প্রকৃত গুড গভর্নেন্স নিশ্চিত করারও সময়। তাই আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য বিজয়ী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যে দেশের অর্থনীতিকে অনন্য উচ্চতায় নিতে চায় ও প্রকৃত গুড গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠা করতে চায় তার প্রমাণ হিসেবে তারা নির্বাচনের ভেতর দিয়ে ছোট ছোট রাজনৈতিক দল ও সকল সামাজিক শক্তিকে এক করতে চায়। তাদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশ করতে চায়। অন্যদিকে দেশের অধিকাংশ ছোট ছোট রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তি হিসেবে ইসলামিক দলগুলোর জন্যও রয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ বা সমান্তরালে থাকার নৈতিক অবস্থান। কারণ, দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে যারা বিশ্বাস করে এমন ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের জন্য আওয়ামী লীগের জোটে যাওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। কারণ, জামায়াতে ইসলামী প্রত্যক্ষ স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের একটি দল। আর বিএনপিও তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ধীরে ধীরে জামায়াতে ইসলামীর কাছে নিয়ে গেছে। তাছাড়া জামায়াতে ইসলামীকে কোন মতেই ছাড়বে না বিএনপি। তাই জামায়াত-বিএনপি জোট মূলত দেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতাবিরোধী জোট। এই জোটের সঙ্গে স্বাধীনতার সপক্ষ কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে যেমন যাওয়া সম্ভব হবে না, তেমনি তাদের সমান্তরালে থাকাও সম্ভব হবে না। অন্যদিকে বেশি সংখ্যক ইসলামী দল বা সামাজিক শক্তি কেন আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকবে? কারণ, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার রাজনীতি কখনও প্রকৃত ইসলামের বৈরী নয়, বরং সম্মান করে। এই সামাজিক শক্তিকে গুরুত্ব দিয়েই বঙ্গবন্ধু তাঁর সারাজীবনের রাজনীতি করেছেন। শেখ হাসিনাও করেন। দু’জনেই প্রমাণ করেছেন, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে এর কোন বিরোধ নেই। বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ এর নির্বাচনের (এই নির্বাচনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি) আগে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেছিলেন, কোরান ও সুন্নাহর পরিপন্থী কোন আইন তিনি কখনও প্রণয়ন করবেন না। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা কেউই কোরান ও সুন্নাহর পরিপন্থী কোন আইন প্রণয়ন করেননি। এই সত্য প্রকৃত ইসলামিক রাজনৈতিক দল বা সামাজিক শক্তিগুলো নিশ্চয়ই উপলব্ধি করে। অন্যদিকে তারা সকলেই স্বীকার করে বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের স্রষ্টা। তাই এ ইসলামিক সামাজিক শক্তিগুলোকে স্বাধীনতার চেতনার বাইরে ফেলে দেবার কোন যুক্তি নেই। সে হঠকারী রাজনীতি কখনই শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ করে না। অন্যদিকে এই ইসলামিক শক্তিগুলো বিএনপির মতো নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মিথ্যা বিতর্ক করে না যে, বঙ্গবন্ধু নয় জিয়াই স্বাধীনতা এনেছে। এ কারণেই দেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে এই ইসলামিক সামাজিক শক্তি, দল ও জোটগুলোকে আওয়ামী লীগ তার বলয়ে নেবে বলে মনে করা যেতে পারে। আর আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে যদি এ ধরনের রাজনৈতিক মেরুকরণ হয় তাহলে নির্বাচনের আগেই নিশ্চিত বলা যাবে এই শক্তি শুধু ক্ষমতায় আসছে না, তারা আগামীতে অর্থনৈতিকভাবে একটি অনেক উন্নত বাংলাদেশ উপহার দেবে। অন্যদিকে এই উন্নত বাংলাদেশের স্বার্থে, দেশের মানুষ ও আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবে, অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পরে পৃথিবীতে এ সত্য প্রমাণিত হয়েছে বিপ্লব নয়, বিবর্তনের ভেতর দিয়েই গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগুতে হবে। কোন কোন সেক্টরে বিপ্লব হবে, তবে সেটা কেবল সামগ্রিক বিবর্তনের ঢেউকে শক্তিশালী করবে। সামগ্রিক সমাজ এগোয় বিবর্তনের পথে। সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এই বিবর্তনকেই সঠিক পথে ধরে রাখতে হয়। [email protected]
×