ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহান বিশ্বাস

অভিমত ॥ বক্স কালভার্ট কালচার...

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

অভিমত ॥ বক্স কালভার্ট কালচার...

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে বক্স কালভার্ট সড়কগুলো ভেঙে খাল উন্মুক্ত করে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ, এসব খালে ময়লা-আবর্জনা জমে পানি আটকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বক্স কালভার্ট সড়কগুলো ভেঙে উন্মুক্ত রেখে ওপর দিয়ে ফ্লাইওভার (উড়ালসেতু) করে দেয়া যায় কিনা, সে বিষয়েও তিনি সংশ্লিষ্টদের ভাবার কথা বলেন। উড়ালসেতু করার সময় সেতুর খুঁটির জন্য পানিপ্রবাহে বাধা হতে পারে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দেন খালের দুই পাড়ে খুঁটি বসিয়ে সেতু নির্মাণের। এছাড়া বিদ্যমান খালগুলোর অবৈধ দখলরোধ, ভরাট হয়ে যাওয়া খালগুলোর খনন এবং পরিকল্পিতভাবে ড্রেনেজ ব্যবস্থা করে পানিপ্রবাহ বাড়াতে পারলে জলাবদ্ধতার অনেকটাই নিরসন হতে পারে বলে মত দেন প্রধানমন্ত্রী। তবে, নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে বিভিন্ন সমস্যার মুখে পড়তে পারেন নগরবাসী। এতে রাস্তায় যান চলাচল ব্যাহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হতে পারে যানজট, ভাঙতে হবে কালভার্টের ওপর তৈরি হওয়া বাসাবাড়ি ও দোকানপাট। এতে কালভার্টের আশপাশের জমির মালিকানা নিয়ে তৈরি হতে পারে আইনি জটিলতাও। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে পরীবাগ খাল ভরাটের মাধ্যমে ঢাকায় ‘বক্স কালভার্ট’ নির্মাণের যে কালচার তৈরি হয়েছিল পরবর্তী সময় তার ধারাবাহিকতা বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায় ঢাকাবাসীর জন্য। এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্রের মোড়কে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতায় অধিষ্ঠ হয়। গঠিত ওই সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ঢাকা-৬ আসন (বর্তমানে-৯) থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মির্জা আব্বাস। খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন এবং ঢাকার সাবেক প্রভাবশালী মেয়র হওয়ায় পূর্তমন্ত্রী হয়েও প্রায় পূর্ণমন্ত্রীর মতোই মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম পরিচালনা করতেন তিনি। ’৯১ সালে সরকার গঠনের পর ৮০’র দশকে শুরু হওয়া বক্স কালভার্ট কালচারকে তিনি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেন। ধারণা করা হয় এতে দুটি লাভ হয় তার। এক. বক্স কালভার্ট নির্মাণের নামে উন্মুক্ত খালের আশপাশের জায়গা ভরাট করে প্লট হিসেবে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন, ২. বিক্রিযোগ্য প্লটগুলো ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দলীয় মতাদর্শের লোকের কাছে হস্তান্তর করে নিজস্ব ভোট ব্যাংক তৈরি করা। ১৯৯১ সালে বিএনপির গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী এবং ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোটের পূর্ণ মন্ত্রী থাকাকালীন খিলগাঁওয়ের ভেতর দিয়ে বহমান ঢাকা ওয়াসার সুন্দর খালটিকে বাক্সবন্দী কালভার্টে রূপ দিয়ে এর পাশের জায়গাগুলো ব্যক্তি মালিকানায় বিক্রি করে দেন তিনি। এখন আর কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই এখানে। এলাকাটি দেখলে মনেই হবে না যে এখানে কোন এক সময় সুন্দর একটি খাল ছিল। বিশাল ইমারতের আড়ালে চাঁদ স্থায়ীভাবে ঢাকা পড়েছে। নিঃশ্বাস নেয়ার মতো অবশিষ্ট জায়গাটুকুও নেই। নির্মিত বক্স কালভার্টের ওপর রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে যে বাজার গড়ে উঠেছিল সেটি দখলে রাখতে গিয়েও কম হানাহানি, রক্তপাত ঘটেনি। হত্যাকা- পর্যন্ত ঘটেছে। কয়েক বছর আগে একটি জাতীয় দৈনিকে এ সংক্রান্ত প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ ‘রাজধানীর খিলগাঁও ফ্লাইওভার সংলগ্ন স্থান থেকে জোড়পুকুর মাঠ হয়ে তিলপাপাড়ার ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে ঢাকা ওয়াসার খাল। সরকারী এ খালটি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ভরাট করে সেখানে বানানো হয়েছে মার্কেট। মির্জা আব্বাস তখন ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ওই খালের ওপর ফার্নিচারের ৩০-৪০টি দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দেয়া হয়েছে। খালটি ভরাট করে ফেলায় এখন সামান্য বৃষ্টি হলেই পানিবন্দী হয়ে পড়ে পুরো এলাকার বাসিন্দা। ঢাকা ওয়াসার খাতায় এখনও অস্তিত্ব রয়েছে খিলগাঁও-তিলপাপাড়া এলাকার খালটির। কিন্তু বাস্তবে খালের চিহ্নও নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পানি নিষ্কাশনের একমাত্র এ খালটি দখল হয়ে যাওয়ায় এখন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। স্বার্থান্বেষী ও মুনাফালোভীদের জন্য খিলগাঁও, তিলপাপাড়া, গোড়ান ও সিপাইবাগ এলাকার লাখ লাখ মানুষ স্থায়ী ভোগান্তিতে পড়েছে।’ (কালের কণ্ঠ, ১৪ এপ্রিল, ২০১৫) রাজধানী ঢাকায় ১৫ কিলোমিটারের মতো বক্স কালভার্ট রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাসেল স্কয়ার থেকে গ্রিন রোড হয়ে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল, হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজা থেকে সোনারগাঁও হোটেল, পান্থপথ থেকে পরীবাগ, ইব্রাহিমপুর বাজার থেকে মিরপুর বাউনিয়া খাল, সেগুনবাগিচা থেকে আরামবাগ হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, খিলগাঁও থেকে তিলপাপাড়া পর্যন্ত কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যরে বক্স কালভার্ট। ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কালভার্টগুলো কমবেশি ভরাট হয়ে যাওয়ায় একদিকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে ভেতরে বিষাক্ত গ্যাস জমে বিপজ্জনক পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে। ২০০১ সালে ঢাকার অধিকাংশ খাল ভরাট করে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ময়লা-আবর্জনা জমে সেগুলো ভরাট হয়ে যায়। ফলে ঠিকমতো বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় ৮ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট সড়ক রয়েছে। যার বেশিরভাগই পুরান ঢাকায়। আর বড় অংশটি ধোলাইখালের ওপর নির্মিত। এক সময়ের ধোলাই নদীর ওই অংশটি এখন দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, সেখানে এক সময় খাল বা নদী ছিল। সবচেয়ে বেশি খাল আছে ঢাকা ওয়াসার। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতার পেছনে অনেক কারণ থাকলেও মূল কারণ বাছবিচারহীনভাবে বক্স কালভার্ট নির্মাণ। এই প্রকল্প রাজধানীবাসীর জন্য সর্বনাশ ডেকে এনেছে। তবে সার্বিক প্রেক্ষাপটে, রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নির্মিত দীর্ঘ বক্স কালভার্ট তুলে খালের আঙ্গিকে ফিরিয়ে আনাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, বক্স কালভার্টগুলোর নকশাতেই ত্রুটি আছে। গোলাকার না করে আয়তাকারভাবে বক্স তৈরি করায় ময়লা খুব দ্রুত জমার সুযোগ পায় এগুলোর ভেতরে। সুয়ারেজ লাইন আলাদা না থাকায় বক্স কালভার্টের ভেতরে জমছে কঠিন বর্জ্য, তৈরি হচ্ছে বিষাক্ত গ্যাস। এসব কালভার্ট পরিষ্কার করতে গিয়ে শ্রমিকদের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। ২০১৬ সালের ১৫ জুন একনেকের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ঢাকার খালগুলো থেকে বক্স কালভার্ট তুলে দিয়ে উন্মুক্ত করে দেয়ার। খালের আঙ্গিকে ফিরিয়ে আনার জন্য ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনকে নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। রাজধানীর তিনটি খাল ধ্বংস করে তৈরি ১৩ কিলোমিটার বক্স কালভার্টের কার্যকারিতা অনেকাংশে হারিয়ে উল্টো বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। নির্মিত কালভার্টগুলো কমবেশি ভরাট হয়ে যাওয়ায় একদিকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় জলাবদ্ধতা ও ভেতরে বিষাক্ত গ্যাস জমে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করায় এসব কালভার্টে ৫ থেকে ৮ ফুট কঠিন বর্জ্য জমে গেছে। এতে বন্ধ হতে চলেছে বর্জ্য নিঃসরণের পথ। কালভার্টের ভেতরে জমছে বিষাক্ত গ্যাস। এই গ্যাস বিস্ফোরিত হয়ে বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে বলে ঢাকা ওয়াসা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। বিষাক্ত গ্যাসের সংস্পর্শে এসে ইতোমধ্যে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপে বিশ্বের ১৪০টি রাষ্ট্রের মধ্যে ঢাকা শহর বসবাসের দিক থেকে ১৩৯তম স্থান পেয়েছে। ঢাকার আগে আছে শুধু যুদ্ধরত বিধ্বস্ত সিরিয়ার দামেস্ক শহর। এ চিত্র মোটেও আমাদের জন্য সুখকর নয়। ঢাকার বিপজ্জনক বক্স কালভার্টগুলোর কারণে যে বিপর্যয়কর পরিবেশ আমাদের জন্য সৃষ্টি হয়েছে- তা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার। ভবিষ্যতের সুন্দর নগরী গড়তে বক্স কালভার্ট ভেঙে উন্মুক্ত করার কাজে সাময়িক ভোগান্তি হলেও ঢাকাবাসী তা নিশ্চয়ই মেনে নেবেন। লেখক : সাংবাদিক
×