ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

সুবিধাবাদী রাজনীতি এবং প্রতিবাদহীন মধ্যবিত্ত

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সুবিধাবাদী রাজনীতি এবং প্রতিবাদহীন মধ্যবিত্ত

দু’হাজার চৌদ্দ-পনেরো সালে টানা নব্বই দিন বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে নিহত এবং বেঁচে থেকেও যাঁরা মৃত্যুর চেয়ে বেশি যন্ত্রণা ভোগ করেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সঙ্গে তুলনা করলে সম্ভবত অতিরঞ্জন হয় না। এ কথা এখন সবাই জানে, এ দেশের শাসকশ্রেণী জনগণের জন্য রাজনীতি করে না; করে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য। হরতাল-অবরোধের নামে তিন মাসে প্রায় দেড় শ’ জন প্রাণ দিলেন কী জন্য? এসব সাধারণ মানুষের সমস্যা সমাধানের কথা কেউ একবারও বলেছে? পনেরো লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থীর শিক্ষা ও মনস্তাত্ত্বি¡ক ক্ষতির কথা ভেবেছিল? বছরের শুরুতে প্রায় তিন মাস ক্লাস বন্ধ থাকার ক্ষতির কথাও ভাবেনি। ভাবেনি নিম্নবিত্ত সেই তিন কলেজ ছাত্রীর কথা; পেট্রোলবোমায় যাদের ভবিষ্যত পুড়ে ছারখার হয়েছে। শরীরে, মুখে পোড়া নিয়ে এ বৈরী সমাজে কি করে তারা নিজেদের টিকিয়ে রাখবে? মৃত্যু, ঝলসানো মুখের করুণ আর্তি এবং শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তাদের টলাতে পারেনি। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো ক্ষমতার টোপ সামনে আসতেই মুহূর্তে মোমের মতো সব গলে গেল। তিন মাসের হত্যা-নির্যাতন বিভীষিকা ইতিহাসের গভীরে তলিয়ে গেল। আন্দোলনের বীভৎসতা শুরু হয়েছিল সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে। চাঁদে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুখ দেখা যাচ্ছে- এ গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করা এবং তা কাজে লাগিয়ে সারাদেশে মৌলবাদীরা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের যে ধারাবাহিক ইতিহাস রচিত হচ্ছে তা আসলে মধ্যবিত্ত শাসক গোষ্ঠীর স্বার্থের হিসাব-নিকাশের ইতিহাস। ব্যাপক সাধারণ মানুষ, যাদের আমরা বলি ‘জনগণ’Ñ এ ইতিহাসে তাদের ভূমিকা বা অংশগ্রহণ কেবল ভোটব্যাংক হিসেবে। কথায় কথায় জনগণের দোহাই দিয়ে যা বলা হয় তা যে নির্ভেজাল ভ-ামি, সচেতন মানুষ মাত্রই তা জানেন। জনগণের নাম ভাঙ্গিয়ে একের পর এক মধ্যশ্রেণীর শাসকরা ক্ষমতায় যান ঠিকই কিন্তু তাদের ভাগ্য বা চেতনার স্তর বাড়াতে কেউ কাজ করেন না। ঔপনিবেশিক শাসকের চেনানো পথেই জাতীয় রাজনীতি হাঁটছে। ইংরেজ রাজত্বের মূল প্রবণতাই ছিল মূল সমস্যা থেকে দেশের মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে রেখে নিজেদের স্বার্থোদ্ধার করা। মধ্যবিত্ত হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দূরত্বকে রেষারেষিতে রূপ দিয়ে একপর্যায়ে বিদ্বেষে পরিণত করে তাই নিয়ে রাজনৈতিক কূটকৌশলের খেলা খেলেছে। পরিবর্তিত রূপ ও প্রকরণে সে ধারা আজও চলছে। ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন দানা বাঁধতে সময় লেগেছিল দু’শ’ বছর। এ দীর্ঘ সময়ে সাধারণ মানুষ নিজ শ্রেণী অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হওয়ার আগেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির খপ্পরে পড়েছিল। মধ্যবিত্ত হিন্দু-মুসলমান রাজনীতিকরা যেভাবে এগোচ্ছিলেন সে পথ আরও মসৃণ করে দিয়েছিল উনিশ শ’ নয় সালের শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন, এতে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে আলাদা নির্বাচকম-লী তৈরি হওয়ায় রাজনীতিকদের মূল মনোযোগ ছিল নিজ সম্প্রদায়ের দিকে। মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদী রাজনীতি এভাবে এগোতে থাকায় জাতীয় আন্দোলনের গতিমুখও ঘুরে গেল। সাধারণ মানুষ তাদের প্রচ- ক্ষমতা নিয়েও তলাতেই থেকে গেলেন। ধনী-গরিবের শ্রেণী-সংঘাত বিকশিত হওয়ার বদলে হিন্দু-মুসলমান প্রসঙ্গ গতিশীল হলো এবং চরমতম অসঙ্গতিপূর্ণভাবে ভারত ভাগ হলো। এই অসঙ্গতিপূর্ণ ভাগাভাগিতে মধ্যবিত্ত রাজনীতিবিদদের সুবিধাবাদিতা বার বার প্রকট হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তা অব্যাহত থেকেছে। এই সুবিধাবাদিতা বা শ্রেণী অবস্থান অনেক রাজনৈতিক অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতাকারী জামায়াত-শিবির রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে। মূলত শ্রেণীস্বার্থের অভিন্ন অবস্থানের কারণে। সাধারণ জনগণ যেখানে ছিলেন সেখানেই রয়ে গেছেন। তাঁরা শুধু ব্যবহৃতই হন। তাঁদের জীবনের পরিবর্তন আসে না। সাড়ে তিন শ’ বছরেরও বেশি আগে রাজা-বাদশাহ-স¤্রাটরা ভারত শাসন করলেও ছোট ছোট গ্রামে বিভক্ত ভারতবর্ষের সমাজ আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। সে সময় তাদের সঠিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করা গেলে উপমহাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটই হয়ত বদলে যেত, তা করা যায়নি। একদিকে সেই অক্ষমতা অন্যদিকে সুবিধাবাদিতা; এ দুয়ের টানাপোড়েনের জের আজও তাই টানছি আমরা। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, সুবিধাবাদী রাজনীতির নীতিহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো দল বা সংগঠনও এখন বিলুপ্তপ্রায়। সত্তর দশক এমনকি আশির দশক বা বলা যায়, গত শতকের শেষ দশক পর্যন্তও মধ্যবিত্তের মধ্যে শিল্প-সংস্কৃতির চর্চার মধ্য দিয়ে যে প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ ছিল তা এখন বহুজাতিক কোম্পানির পণ্যে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার পর সাংস্কৃতিক জগতে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল নাট্য আন্দোলন। সে সময় যারা এর নেতৃত্বে ছিলেন তাদের বেশিরভাগই এখন ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানির বাজার সম্প্রসারণ ও শক্তিশালী করায় নিজেদের প্রতিভা খরচ করছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক সাংস্কৃতিক চর্চা এখন কর্পোরেট স্বার্থের ¯্রােতে ভাসছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আবেগ সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে যতটা বিকশিত হয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপনে। যে আবেগ দেশের স্বাধীনতার পেছনে অন্যতম শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, বহুজাতিক কোম্পানি তাকে বিক্রি করছে মধ্যবিত্তকে তাদের ভোক্তায় পরিণত করতে। তাদের কাছে পণ্য বিক্রির উদ্দেশে তাদের এ চেতনানাশক গিলে মধ্যবিত্ত এখন পুরোপুরি বিবশ। ‘সুশীল সমাজ’ নামে একটি গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছে, কিন্তু তাদের নামের মধ্যেই পরিচয় লুকিয়ে আছে। তারা দুঃশীল নন। গলা ছেড়ে প্রচ- ভঙ্গিতে তাঁরা প্রতিবাদ করবেন না। সভ্যভব্যভাবে দাতাসংস্থা ও কর্পোরেট প্রভুদের ভদ্রতার শর্ত মেনে কথা বলেন বলেই তারা সুশীল। বছরের পর বছর ধরে এদেশে যে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে তাতে জনগণের অবস্থান কোথায়? জনগণের মতামত মানে তো পাঁচ বছর পর পর বুঝে না বুঝে একটি করে ভোট দেয়া। অনেক নেতার পেটোয়া বাহিনীর কল্যাণে ওই কষ্টটুকুও করতে হয় না অনেক সময়; আপনা আপনি ভোট দেয়া হয়ে যায়। আর নির্বাচিত হওয়ার পর জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক বলতে আসলে তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে দ্রুত ধনী হওয়ার সিঁড়ি খোঁজা। অর্থবিত্তের মালিক হয়ে শ্রেণী উত্তরণ ঘটাতেই হয়। কেননা, বাগাড়ম্বর করে মিষ্টিমধুর শব্দে ‘জনগণ জনগণ’ বলে চেঁচিয়ে যতই তাদের স্বার্থ সুরক্ষার কথা বলা হোক, বর্তমান ব্যবস্থায় গণতন্ত্র শুধু ধনিক শ্রেণীর স্বার্থই রক্ষা করে। তাদের বিকাশ ও নিরাপত্তার যাবতীয় ব্যবস্থা পাকাপাকি করে রাখাই এর অন্যতম উদ্দেশ্য।
×