ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কবুতর পালনে সফল শহিদুল

জ্যাকবিন বোখারা টামলার রেড চেকার- খামার গড়ে স্বাবলম্বী

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

জ্যাকবিন বোখারা টামলার রেড চেকার- খামার গড়ে স্বাবলম্বী

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ শুরু করেছিলেন একজোড়া দিয়ে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে নানা প্রজাতির দামী শতেক জোড়া কবুতর। শুধু কি তাই? পাশাপাশি ফেন্সি মুরগির খামার ও পাখির দোকান, এখন তৈরি করবেন পরিবারের থাকার জন্য বসতঘর। এসবই হয়েছে কবুতর বিক্রির আয়ে। এ স্বপ্নবাজ খামারি বরিশালের গৌরনদী পৌর এলাকার দক্ষিণ পালরদী গ্রামের শহিদুল ইসলাম (৩২)। তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছেন আরও অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে, যারা তার কাছ থেকে কবুতর নিয়ে খামার গড়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। স্বপ্নের শুরু ২০১২ সালে। চার হাজার টাকায় একজোড়া জ্যাকবিন কবুতর কেনেন শহিদুল। ছেলের আগ্রহ দেখে বাবা এসকেন্দার আলী সরদার নিজের গোয়ালঘরটি ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। দিনে দিনে কবুতরের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তবে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে রানীক্ষেত রোগে অনেক কবুতর মারা যায়। লোকসানের মুখে পড়ে। ওই সময় রোগব্যাধি প্রতিকারে কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। তার পরও হাল ছাড়েনি শহিদুল। এক সময় ফরিদপুর, মাদারীপুর, খুলনা ও রাজধানীর কাপ্তানবাজার থেকে সংগ্রহ করা কবুতরের দোকানিদের কাছ থেকে পরামর্শ আর নিজস্ব পদ্ধতি মিলিয়ে চিকিৎসা করতে থাকেন। লোকসানের ধকল কাটিয়ে ওঠার পর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। শহিদুল বলেন, তার খামারে হল্যান্ডের জ্যাকবিন, পাকিস্তানী বোখারা, ভারতের ইয়োলো পোটার, আমেরিকান স্যাটেল ফিল্ড ব্যাক, উজবেকিস্তানের টামলার মিলিয়ে ২০ প্রজাতির কবুতর রয়েছে। প্রকারভেদে এর মূল্য ১৫ হাজার থেকে লাখ টাকার কাছাকাছি। এছাড়া রেড চেকার, সবজি চেকার, মাক্সি চেকার প্রজাতির কবুতর রয়েছে। যার বিক্রিমূল্য শুরু হয়েছে দুই থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে বছর দু’য়েক হলো কবুতরের দাম কমে গেছে। বৈধ পথে কবুতর আমদানি-রফতানি বন্ধ থাকায় চোরাইপথে এর কারবার চলছে। এজন্য দাম প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। তিনি জানান, খামারিদের কাছে অনেক দামী কবুতর রয়েছে। রফতানি করতে পারলে উপযুক্ত দাম পাওয়া যেত। তার খামারের কবুতর এখন বরগুনা, ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর খামারিদের কাছে বিক্রি করেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের পর গোপালগঞ্জের কবুতরের রেসিংক্লাব গড়ে উঠেছে। বরিশালে এখনও এ ক্লাব নেই বলে রেস করে বাড়তি টাকা আয়ের পথ তৈরি হয়নি। কবুতরের রেস নিয়ে শহিদুলের বেশ আগ্রহ। সংগ্রহ করা পত্রিকার কাটিং থেকে দেখিয়ে শহিদুল বলেন, বিশ্বের দ্রুতগতির উসাইন বোল্ট কবুতরটি বাংলাদেশী মুদ্রায় তিন কোটি ১২ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তার খামারে থাকা রেস কবুতর নিয়ে রীতিমত কসরত করেন শহিদুল। এখানে রেসিং ক্লাব গড়ে উঠলেই প্রতিযোগিতায় নামার ইচ্ছা শহিদুলের। এক সময়ের মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ করা শহিদুল কবুতর চাষে লাভের মুখ দেখায় আগের পেশা বদল করেছেন। বছর দু’য়েক আগেও প্রতিমাসে কবুতর বিক্রি করে লাখ টাকার ওপর আয় করেছেন। বর্তমানে যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এই টাকায় গৌরনদী পৌর শহরের বাসস্ট্যান্ডে একটি পাখির দোকান, একটি বিরানি হাউস, একটি রেস্টুরেন্ট গড়েছেন। শহিদুল হিসাব কষে দেখান কবুতরের খাবারে (ধান, গম, ভুট্টা, ইন্ড, বজরা, কুসুম ফুলের বীজ, চীনা) মাসে সর্বোচ্চ দেড় শ’ টাকা আর ওষুধ ১০ টাকা মিলিয়ে গড়ে ১৬০ টাকা খরচ হয়। সেখানে একজোড়া কবুতরের বাচ্চা বিক্রি হয় এক থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত। শহিদুলের শতেক জোড়া কবুতর থেকে মাসে গড়ে ৩০ জোড়া বাচ্চা আসে। সফল কবুতর খামারি শহিদুল এখন কবুতরের পাশাপাশি ফাইটার, আচিল, সিল্কি, বেল্ডার্স, পলিস ক্যাম্প ও ভারতের কেদারনাথ নামক শৌখিন মুরগির খামার গড়েছেন। স্থানীয় গৃহবধূ কাকন দাস জানান, শহিদুলের কাছ থেকে তিনি একজোড়া শৌখিন কবুতর কিনেছেন। এখন তার আটজোড়া কবুতর। স্কুলছাত্র মোঃ সিফাত এখান থেকে কবুতর কিনে নিজের হাত খরচা নিজেই চালাতে পারেন। এভাবেই প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি শহিদুলের কাছ থেকে কবুতর নিয়ে খামার গড়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। কবুতর পালন লাভজনক হওয়ায় বিষয়টির প্রতি জোর দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন জেলা ভারপ্রাপ্ত প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ নুরুল আলম। তিনি জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের জরিপ অনুযায়ী জেলায় এক লাখ ৬০ হাজার ৩৭০টি কবুতর রয়েছে। আর সরকার ভর্তুকি দিয়ে মাত্র ১০টাকা মূল্যে ১০০টি কবুতরের জন্য রানীক্ষেত রোগের প্রতিষেধক টিকা দিচ্ছে। ডাঃ নুরুল আলম আরও বলেন, কবুতরের জন্য দুই মাস পর পর কৃমির ওষুধ আর বাচ্চার বয়স সাতদিন হলে প্রথমবার চোখের ফোটা, এরপর তিনমাস পর পর রানের মাংসে রানীক্ষেতের ভ্যাকসিন দেয়া উচিত। এই প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বলেন, এলাকার বেকার যুবকদের কবুতর চাষে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে কবুতরের খামার করে গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভব।
×