ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দোতারার জাদুকর, উপমহাদেশের প্রখ্যাত গীতিকার সুরকার কানাই লাল শীল স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ০৮:৩৮, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

দোতারার জাদুকর, উপমহাদেশের প্রখ্যাত গীতিকার সুরকার কানাই লাল শীল স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাজু আহমেদ ॥ উপমহাদেশীয় সংস্কৃতি অঙ্গনে অন্যতম একটি নাম কানাই লাল শীল। দোতারার জাদুকর খ্যাত এই শিল্পী অসংখ্য গানের গীতিকার ও সুরকার হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। আগামীকাল ৫ সেপ্টেম্বর তার প্রয়াণ দিবস। ১৯৭৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি পরলোক গমন করেন। প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে এই মহানশিল্পীর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি। ‘তোমার ও লাগিয়ারে’, ‘বহুদিনের পিরিত গো বন্ধু, ‘শোন গো রূপসী কন্যা গো’, ‘মাঝি বাইয়া যাও রে’ ‘আমায় এতো রাতে কেন ডাক দিলি’, ‘প্রাণ সখিরে ওই শোন কদম্ব তলায় বংশি বাজায় কে’, ‘অসময় বাঁশি বাজায় কে রে’ শিরোনামের কালজয়ী গানের গীতিকার ও সুরকার, উপমহাদেশের প্রখ্যাত দোতারা বাদক কানাই লাল শীল। অসংখ্য গান রচনার পাশাপাশি ও সুরকার বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছেন। মৃত্যুর ৪২ বছর পেড়িয়ে গেলেও তার রচিত এবং সুরারোপিত গান এখনও মানুষের মুখে মুখে। বাংলাদেশের কৃতি সন্তান কানাই লাল শীলের জন্ম ১৩০৫ বঙ্গাব্দে, ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানার শাকরাইল ইউনিয়নের লস্করপুর (কৈড়াইল) গ্রামে। তাঁর পিতার নাম আনন্দ চন্দ্র শীল, মাতা সৌদা মিনি শীল, স্ত্রী কিশোরী বালা শীল। বর্ণাঢ্য সঙ্গীত ক্যারিয়ারের এই গুণী মানুষটির সঙ্গীত প্রতিভা আজও অনন্য। কানাই লাল শীল রচিত ও সুরারোপিত গান যারা রেকর্ড করেছেন তাদের মধ্যে আব্বাস উদ্দিন আহামেদ, শচীন দেব বর্মণ, আবদুল হালিম চৌধুরী, কুমুদিনী সাহা, অনন্ত বালা বৈষ্ণবী, ফেরদৌসী রহমান, আবদুল আলীম, বেদার উদ্দিন আহামেদ, ফরিদা ইয়াসমিন, মোস্তফা জামান আব্বাসী, নীনা হামিদ, সরদার আলাউদ্দিন, কানন বালা সরকার, এম এ খালেক প্রমুখ। কানাই লাল শীল প্রসঙ্গে বলা হয়ে থাকে কবি জসীম উদ্দিনের মতো কবি প্রতিভা, আব্বাসউদ্দিনের মতো অলৌকিক কণ্ঠস্বরের অধিকারী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো কবি ব্যক্তিত্ব। এককালে দোতারাধারী কালো কিশোর কানাই লাল শীলকে নিয়ে কাড়াকাড়ি হয়েছিল। পিতা আনন্দ চন্দ্র শীল ছিলেন নৃত্যগীতে উৎসাহী এক বিশালদেহী পুরুষ। সম্ভবত সঙ্গীতের ধারা পিতার ধমনী থেকেই কানাই লালের দেহে সঞ্চারিত হয়। কিন্তু মাত্র আড়াই বছর বয়সে পিতৃহারা হন। পিতৃহারা দুরন্ত বালক কানাই লালকে লালন পালন করেন তার পিসিমা। মাত্র আট বছর বয়সে নগরকান্দা খ্যাতনামা বেহালা বাদক শ্রী বসন্ত কুমার শীলের কাছে তার প্রথম বেহালার হাতে খড়ি। বসন্ত শীল কানাইয়ের বেহালার উপর ওজন করা হস্ত চালনা দেখে সহজেই বুঝে নিয়েছিলেন, এই হাত বহু হৃদয়কে স্পর্শ করবে এবং লোক সঙ্গীতের অতল সমুদ্র থেকে মুক্তা আহরণ করবে। তিন বছর গুরু বসন্ত শীল ছাত্রকে উজাড় করে ঢেলে দেন প্রাথমিক শিক্ষা। যদিও বেহালার পূর্ণপাঠ সময় এবং ব্যক্তিগত ব্যস্ততার জন্যে তিনি তার পুত্রসম ছাত্রকে দিতে পারেননি। তবুও সঙ্গীতের প্রতি কানাইয়ের মানসিক ভিত্তিভূমিকে কর্ষণ করে যে কোন বীজ বপনের উপযোগী করে দেন। মাত্র এগারো বছর বয়সে কানাই লাল বসন্ত শীলের গুরু মতি লাল ধূপির কাছে বেহালার পূর্ণপাঠ নিতে শুরু করেন। শুরু হয় তাঁর বেহালার দক্ষতা বিকাশের কাল। এই সময়ে তার মানসিক আনন্দের কথা তিনি এভাবে ব্যক্ত করেছিলেন, ‘ছোট বেলায় খেলার কথা আমার মনে পড়ে না, মনে পড়ে শুধু বেহালার কথা, যা আমি বাজাতাম গুরুর পায়ের কাছে বসে। কি জানি একেই মানুষ বলে কিনা তপস্যা’। এরপর এসে গেল শিল্পীর কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণ। বাংলাদেশের আট দশজন শিল্পীর মতো পেটের ধান্দায় পথে বের হওয়ার পালা। প্রথম একটা যাত্রার দলে যোগ দিয়ে বেহালার ছড় টানতে লাগলেন কিন্তু আর্থিক কারণেই এককভাবে একটা দলে লেগে থাকা তরুণ বাদকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া কানাইয়ের মন ছিল বৈচিত্র্যপ্রয়াসী সত্যিকারের লোকশিল্পী। তিনি যাত্রাদল ছাড়াও গাজীর গান ও কীর্তনীয়া দলে যোগ দিয়ে সারা ভাঁটি অঞ্চল সফর করে বেড়ান। তার পেশাগত দক্ষতায় দল কর্তারা সকলেই তাকে আপন করে নিয়ে ছিলেন। যদিও কানাই লাল ছিলেন প্রকৃতিগত ভাবে জন্ম যাযাবর। বাংলার লোকসঙ্গীতের উদার উপত্যকার এক সত্যিকারের জিপসী রাজা। এই বিচরণ ও উদার ভ্রমণ কানাই লালের জীবনকে অনেক অপরিহার্য অভিজ্ঞতাকে পূর্ণ করে দেয়। তার সজাতিকে অত্যন্ত অন্তর দিয়ে উপলদ্ধি করেন। এই জিপসী জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন ‘এত দারিদ্র্য রোগ শোক ও রুদ্র প্রকৃতির মধ্যে এমন গভীর ভালবাসা বুঝলাম আমি সঙ্গীতের বিপুলজাতির প্রতিনিধিত্ব করে আসছি’। এই সময় কানাই লালের জীবনে আধ্যাত্মিক আলোর ঝলক লাগে। তিনি গিয়ে ছিলেন বিক্রমপুরের কাছে বাইমাহাটি ফকির বাড়িতে, দরবেশ দাগু শাহের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। সেখান থেকে দেশের বাড়ি ফরিদপুরে গিয়ে তিনি দোতারা বাদক তারা চাঁন সরকারের কাছে তামিল নেন। এমন এক ছাত্রকে পেয়ে তৎকালীন শ্রেষ্ঠ দোতারা বাদক কানাই লালকে তামিল দিতে রাজি হন। এখানকার শিক্ষা শেষ হলে কানাই লাল দোতারা শিল্পী হয়ে এক কৃষ্ণ লীলা দলে যোগ দিয়ে ফরিদপুরে রাধিকা মোহন সাহার বাড়িতে অনুষ্ঠান করতে এলে কবি জসীম উদ্দিনের সঙ্গে পরিচয় হয়। এই পরিচয়ের পরে বাংলাদেশের বৃহত্তর সঙ্গীত সমাজের সঙ্গে কানাই লালের আদান প্রদানের দরজা খুলে যায়। কানাই লালের দোতারা বাদন শুনে কবি জসীম উদ্দিন এতটাই মুগ্ধ হন যে শিল্পীকে কয়েকদিন পরে তিনি কলকাতায় নিয়ে যান। কলকাতায় কবি জসীম উদ্দিনের সূত্রে কানাই লালের আব্বস উদ্দিনের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সুযোগ হয়। আব্বাস উদ্দিন ছিলেন তৎকালীন বাংলা গায়ক সমাজের বিশেষ করে লোক গীতির ক্ষেত্রে একাধিপতি। সর্ব মহলে ছিল সুর সাধকের অবাধ গতি। আব্বাস উদ্দিনের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর কানাই লালের অন্য একটি গুণের স্ফুরণ ঘটে। তিনি আব্বাস উদ্দিনে অনুপ্রেরণায় অনেক পল্লিগীতি রচনা ও সংগ্রহ করেন। আব্বাস উদ্দিন তাকে নানাভাবে কলকাতায় হিন্দু সমাজ ও গ্রামোফোন কোম্পানি গুলোর সঙ্গে ব্যাপক পরিচয় করিয়ে দেন। গায়ক আব্বাস উদ্দিন সম্পর্কে কানাই লালের মন্তব্য হলো ‘এত বড় উদার মনের মানুষ বাংলাদেশের কোন মায়েরা জন্ম দিতে পারবেন কিনা কে জানে’। এই সময়ে আরও একটি ঘটনা কানাই লালের জীবনে নতুন অধ্যায়ের সংযোজন করে। মেগা ফোন কোম্পানিতে কমলার ঝরিয়ার সাতে দোতারা বাজাছিলেন। কোম্পানিতে উপস্থিত ওস্তাদ এনায়েত খাঁ কানাই লালের দোতারা বাদন শুনে এমন মুগ্ধ হোন যে তাঁকে তার ছাত্র করার প্রস্তাব দেন। ফলে বেশ কিছু কালের জন্য তার দোতারায় শাস্ত্রীয় রীতিতে তালিম নেয়ার সুযোগ হয়। এদিকে হিজ মার্টাস ভয়েজ গ্রামোফোন কোম্পানিতে কাজ করার সময় কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বাদনে খুশি হয়ে প্রায় পাঁচ বছরের জন্য কানাই লালকে তার কাছে নিয়ে যান নিজ গানে দোতারার সহযোগিতা করার জন্য। তখন থেকে তিনি অল-ইন্ডিয়া রেড়িওর কলকাতা কেন্দ্রের নিয়মিত দোতারা শিল্পী হিসেবে কাজ করতে থাকেন। দেশব্যপী খ্যাতির মালা পরে মাত্র ২৩ বছর বয়সে কানাই লাল ফরিদপুর জেলার মুন্সিরচর গ্রামের জলধর শীলের কন্যা কিশোরী বালা শীলকে বিয়ে করেন। তার তিন পুত্র ও চার কন্যা। পুত্রদের মধ্যে কুমুদকান্ত, আশুতোষ ও অবিনাশ। তিনজনই দোতরায় প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। তাঁর দোতারার ছাত্রদের মধ্যে চৈতন্য বিশ্বাস, চাঁন মিয়া, দুলাল চন্দ্রশীল ও বিজয় কুমার দাস। কানাই লাল শীল রচিত ও সুরারোপিত গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘তোমার ও লাগিয়ারে, সদাই প্রাণ আমার কান্দে বন্ধুরে’, ‘আমি বন্ধুর প্রেম আগুনে পোড়া’, ‘বহুদিনের পিরিত গো বন্ধু,’ ‘কেগো নিরলে বসিয়া,’ ‘শোন গো রূপসী কন্যা গো, কার লাগিয়া গাঁথ ফুলের মালা,’ ‘আমার গলার হার, খুলে নে ওগো ললিতে’, ‘মাঝি বাইয়া যাও রে,’ ‘আমায় এতো রাতে কেন ডাক দিলি,’ ‘সে যেনো কি করলো রে আমায়,’ ‘ওই না রূপে নয়ন দিয়ে আমার’, ‘কোন বা রঙ্গে বাইন্দাছো ঘরখানা’, ‘এ বেশ তোমার কে সাজাইছে’, ‘বন্ধুর প্রেমে শৈল পসিলো গো’, ‘সরল প্রাণে দাগা দিয়া কোথায় গেল লুকাইয়া’, ‘আমার নিঠুর বন্ধু লাইগা রে’, ‘কেন জানি আজ বন্ধু’, ‘প্রাণ সখিরে ওই শোন কদম্ব তলায় বংশি বাজায় কে, ‘ওরে তুই আমারে করলি পাগল’, ‘ও ঢেউ খেলেরে, ঝিলমিল সাইওরে ও ঢেউ খেলে, ‘অসময় বাঁশি বাজায় কেরে’ প্রভৃতি। দেশের প্রখ্যাত এবং গুণী দোতারা শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার কানাই লাল শীলের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
×