ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গড়াই নদীর তীব্র ভাঙ্গন

শেখ রাসেল সেতুর সংরক্ষণ বাঁধ হুমকির মুখে

প্রকাশিত: ০৭:১৬, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

শেখ রাসেল সেতুর সংরক্ষণ বাঁধ হুমকির মুখে

নিজস্ব সংবাদদাতা, কুষ্টিয়া, ৩ সেপ্টেম্বর ॥ পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কুষ্টিয়ায় গড়াই নদীর তীব্র ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। পানির প্রবল তোড়ে কুষ্টিয়া শহরের সঙ্গে হরিপুরের সংযোগ স্থাপনকারী ‘শেখ রাসেল সেতু’র সংরক্ষণ বাঁধ এবং হরিপুর অংশে এই ভাঙ্গনে এলজিইডি’র তত্ত্বাবধানে সদ্য নির্মিত কুষ্টিয়া-হরিপুর শেখ রাসেল সেতু এখন হুমকির মুখে পড়েছে। ভাঙ্গন রোধে প্রয়োজনীয় কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও এলজিইডির মধ্যে চলছে রশি টানাটানি। সম্প্রতি শেখ রাসেল সেতুর হরিপুর অংশের পশ্চিম পাশে অন্তত ১শ মিটার নদীর তীর সংরক্ষণ বাঁধ ভেঙ্গে শেখ রাসেল সেতুর প্রটেকশন বাঁধে ঢুকে পড়ে। এতে সেতু সংরক্ষণে নির্মিত সিসি ওয়ার্ক বাঁধের প্রায় ৩০ মিটার নদীতে তলিয়ে গেছে। এদিকে ভাঙ্গন রোধে প্রয়োজনীয় কোন ব্যবস্থা না নিয়ে সরকারী দুই প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের মধ্যে চলেছে ঠেলাঠেলি। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর কর্তৃপক্ষ বলছেন, সেতুটি ঝুঁকিতে পড়লেও আমাদের আর কিছু করার নেই। নদী ভাঙ্গনের বিষয়টি এখন দেখার দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের। আর পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারা বলছেন, ব্রিজের প্রটেকটিভ এরিয়ায় ভাঙ্গন হলে সেটা দেখবেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ। শুধু সেতুর সংরক্ষণ বাঁধ নয়, ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে গড়াই নদীর বাম তীর সংরক্ষণ বাঁধেও। নদীর হরিপুর অংশে সংরক্ষণ বাঁধ ভেঙ্গে কয়েক কিলোমিটার বালুর চর ইতোমধ্যেই বিলীন হয়ে গেছে। সূত্র মতে, ২০১৬ সালে গড়াই নদীর ওপর নির্মিত কুষ্টিয়া-হরিপুর শেখ রাসেল সেতুর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণের টেন্ডার আহ্বান করা হয়। ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুর দুই পাড়ে সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণের কার্যাদেশ পান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মীর আক্তার গ্রুপ’। সংরক্ষণ বাঁধের কুষ্টিয়া অংশে রয়েছে ১৯০ মিটার এবং হরিপুর অংশে ২৫০ মিটার। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে সংরক্ষণ কাজ সম্পন্ন করে এটি এলজিইডির কাছে হস্তান্তর করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। নির্মাণের মাত্র এক বছরের মাথায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সংরক্ষণ বাঁধে ভাঙ্গন দেখা দেয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কুষ্টিয়া স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর কর্তৃপক্ষ বলছে, এখন নদী ভাঙ্গনের মুখে সেতুটি ঝুঁকিতে পড়লেও আমাদের আর কিছু করার নেই। কারণ সেতুর নির্মাণ প্রকল্প সম্পন্ন হয়ে গেছে। নদী ভাঙ্গনের বিষয়টি এখন দেখার দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের। অপরদিকে কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, সেতুর প্রটেকটিভ এরিয়ায় ভাঙ্গন হলে সেটা দেখবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ। তবে প্রটেকটিভ এরিয়ার বাইরে হলে সেটা দেখব আমরা। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ১নং হাটশ হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম সম্পা মাহমুদ বলেন, আগে থেকেই নদীর ওই স্থানটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বিষয়টি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার কর্মকর্তাদের অবগত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা কোন প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ না করায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে গড়াই নদী খননের মাটি ও বালু সংরক্ষণে নদীর দুই তীরে ফ্লো-ডিভাইডার ও গাইড বাঁধ নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হয়নি। ফলে নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গড়াইয়ের হরিপুর অংশে খনন করে উত্তোলিত বালুর চরে দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। রবিবার দুপুরের মধ্যেই গড়াই নদীর বাম তীরে কয়েক কিলোমিটার বালুর চর ভেঙ্গে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। সূত্রে জানায়, গড়াই নদীর হরিপুর অংশে তীর সংরক্ষণে ২০১৪ সালে চার গ্রুপে টেন্ডার আহ্বান করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এর মধ্যে ঘটনাস্থল ৮৪৫ মিটার বাঁধ নির্মাণে প্রকল্পের ব্যয় করা হয় প্রায় আড়াই কোটি টাকা। দরপত্রের চার গ্রুপের কার্যাদেশেই কত মিটার কাজ করতে হবে। কত টাকা ব্যয়, কি কি দিয়ে এবং কিভাবে নদীর তীর সংরক্ষণ করতে হবে। তার সবকিছুই স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল। কিন্তু টেন্ডারের ওই কার্যাদেশে কোন শর্তই পূরণ না করে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে সে সময় মোটা অংকের টাকা হরিলুট করেছে বলে স্থানীয়রা দাবি করেন। রাঙ্গুনিয়ায় একাধিক গ্রাম নিজস্ব সংবাদদাতা রাঙ্গুনিয়া থেকে জানান, চলতি বর্ষা মৌসুমে রাঙ্গুনিয়ার তীরবর্তী এলাকায় তীব্র ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত শিলক ও ইছামতি নদীর দুপাড়ে ইতোমধ্যে অনেক জমি বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে রাঙ্গুনিয়ায় একাধিক গ্রাম। নদী ভাঙ্গনের ভয়াবহতা যে কোন সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত বলে স্থানীয় ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। জানা যায়, কোদালার রাইখালী, কোদালা বাজার, শিলকের ডংখাল, ব্যূহচক্র বাজার, ফকিরা ঘাট, নয়া রাস্তার মাথা, সরফভাটর মরাখালের মুখ, কানুরখীল, ভূমিরখীল, মৌলানা গ্রাম, পাইট্টালীরমুখ, চন্দ্রঘোনার মিশন ঘাট, দোভাষী বাজার, আমতলী, শ্যামাপাড়া, ফকিরপাড়া, খন্দকারপাড়া, মিনারপাড়া, কদমতলী, মরিয়ম নগরের কাটাখালী, মরম পাড়া, ফরাশ পাড়া, কুমার পাড়া, রশিদিয়া পাড়া, ইছামতি, পারুয়ার ঘাটচেক, ইছাখালী, পোমরার গোডাউনঘাট, গোচরা বাজার। সবচেয়ে বেশি ভাঙ্গন কবলিত বেতাগীর মাতব্বর বাড়ি, চিরিয়া, মৌলভী সাহেবের ঘাট, চান্দরবাড়ি, বারুইপাড়া, বড়ুয়াপাড়া, কুলালপাড়া, কাটাখালী। বেতাগী মীরাপাড়া থেকে বড়ুয়াপাড়া পর্যন্ত প্রায় দুশতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হতে চলেছে। ইছামতি নদীর তীব্র ভাঙ্গনে রাজা নগর ইউনিয়নের বগাবিলী উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলাচলের একমাত্র সড়কটি নদী ভাঙ্গনে বিলীন হওয়ার পথে। ভাঙ্গন প্রতিরোধ করা না গেলে সড়ক ধসে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটি নদীতে তলিয়ে যাবে বলে স্কুলের শিক্ষকরা জানান। কর্ণফুলী নদী ভাঙ্গনে চন্দ্রঘোনা বন শুল্ক ও পরীক্ষণ ফাঁড়ির বন অফিসটি নদীতে চলে যাচ্ছে। জরুরীভাবে ভাঙ্গনরোধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে পুরো সরকারী বন অফিসটি বিলীন হবে। কোদালা সেন পাড়ার অশোক কুমার শীল বলেন, একমাত্র শশ্মানহোলা ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। ধোপাঘাট, সাতঘর পাড়া, শীলপাড়া, তালুকদার বাড়ি, সেনবাড়ি, বলবাড়ি, ব্রাহ্মণবাড়ি, মুসলিমবাড়ি ও পূর্ব পাড়ার ৫শ পরিবার নদী ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। ইসলামপুর ইউনিয়নের কৃষক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, পানির ¯্রােতে ইছামতি নদীর একাধিক স্থানে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে শত শত বাড়িঘর ও ২০/২৫ একর জমি বিলীন হয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরে ১৫টি স্থানে ইছামতি নদী তলদেশে উচ্চ সম্পন্ন ড্রেজার মেশিন বসিয়ে লাখ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করে পাচার করা হয়েছে। অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের ফলে নদী ভাঙ্গন বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিনি জানান। রাঙ্গুনিয়া উপজেলা প্রশাসন বালু পাচার বন্ধে নদীতে একাধিকবার অভিযান চালিয়ে ড্রেজার মেশিন জব্দ করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন। অভিযানের কয়েক দিন পর্যন্ত বালু পাচার বন্ধ রাখা হলেও পরবর্তীতে আবার চালু করা হয়। রাজানগর ইউনিয়নের মুছা সওদাগর জানান, নদীভাঙ্গন রোধে সরকার গত সাড়ে ৯ বছরে শত কোটি টাকার উপরে সিসি ব্লক ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। নদী থেকে কতিপয় শাসকদলের পরিচয় দানকারী গুটি কয়েক ব্যক্তি বেপরোয়া বালু উত্তোলনের কারণে সরকারের মহতি উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে।
×