ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গ্রামীণ সড়ক মেরামতে ব্যাপক অনিয়ম

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

গ্রামীণ সড়ক মেরামতে ব্যাপক অনিয়ম

সাজেদুর রহমান শিলু, দিনাজপুর ॥ দিনাজপুরে বন্যার এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এখনও ঠিকভাবে মেরামত হয়নি গ্রামীণ জনপদের রাস্তাঘাট, সেতু ও কালভার্ট। যেটুকু কাজ হয়েছে সেটিতেও রয়েছে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ। মাটির বদলে বালু দেয়া হয়েছে। যার ফলে মেরামতের কার্যক্রম শেষ না হতেই, আবারও ধসে যেতে শুরু করেছে রাস্তাঘাট। অথচ জোড়াতালির এই মেরামত কার্যক্রমেই খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় ৯১ কোটি টাকা। অনিয়মের এমন চিত্র থাকলেও এসব ব্যাপারে কোন অভিযোগ নেই বলে জানিয়েছেন এলজিইডির কর্মকর্তা। দিনাজপুর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ১৩টি উপজেলার মোট রাস্তাঘাটের পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে আড়াই হাজার কিলোমিটার পাকা। আর সেতু ও কালভার্ট রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩ শ’ টি। এর মধ্যে গত বছরের আগস্টে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২০৪ কিলোমিটার পাকা সড়ক ও ৯২টি সেতু-কালভার্ট। ইতোমধ্যেই ৯১ কোটি টাকার কাজ হয়েছে এসব মেরামতে। যার মধ্যে মেনটেনেন্স খাত থেকে কাজ হয়েছে ৫০ কোটি টাকার আর চলমান রয়েছে রুলার কানেকটিভিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (আরসিআইপি) থেকে ৪১ কোটি টাকার। তবে এই পরিমাণ অর্থের কাজ হলেও দৃশ্যমান চিত্র উল্টো। মেরামতের যে ছিটেফোঁটা লেগেছে তাতে করে মানুষের দুর্ভোগ কমেনি এতটুকুও। সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন দেখা গেছে, বন্যার সময় যেসব স্থানের সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা নামকাওয়াস্তে মেরামত করা হয়েছে। যার মধ্যে কিছু আবার ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ব্রিজ-কালভার্টগুলো মেরামতের কথা বলা হলেও দৃশ্যমান চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখনও মানুষজনকে চলাচল করতে হচ্ছে দুর্ভোগকে সঙ্গে নিয়ে। বন্যার সময় দিনাজপুর সদর উপজেলার জামতলী-নশিপুর সড়কের খালপাড়া নামক এলাকায় কালভার্টের সংযোগস্থলের উভয়পাশের মাটি প্রবল ¯্রােতে ভেসে যায়। চলাচলের জন্য প্রথমে স্থানীয়রা বাঁশের সাঁকো দেয়। পরে বালুমাটি দিয়ে কোন রকমে মেরামত করা হলেও বর্ষার পানির চাপে কয়েকদিন আগে আবারও ভেঙ্গেছে সংযোগস্থল। যাতে করে আবারও পুরাতন দুর্ভোগ ফিরে এসেছে ওসব মানুষের কাছে। শুধু ওই রাস্তাটিই নয়, গত বছরের বন্যায় বাঁশেরহাট থেকে কর্ণাই যাওয়ার রাস্তাটির একটি স্থানে ভেঙ্গে যায় ও একটি কালভার্ট পানির প্রবল ¯্রােতে ভেঙ্গে যায়। কিছুদিন পূর্বে জোড়াতালি দিয়ে রাস্তাটি কোনরকমে মেরামত করে পিস দিয়ে কার্পেটিং করা হয়েছে। কিন্তু বর্ষার পানিতে ওই রাস্তাটিও ধসে যেতে শুরু করেছে। রাস্তাটির দু’পার্শ্বে রড-সিমেন্টের ঢালাই দিয়ে সাপোর্ট দেয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। যাতে করে বর্ষার পানি জমলেই রাস্তাটি আবারও ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন এলাকাবাসী। আবুল কাসেম নামে একজন জানান, বন্যার সময় এই রাস্তাটির কালভার্টের সংযোগস্থলে ভেঙ্গে যায়। পরে বালু দিয়ে মেরামত করা হলেও এখন সেই বালুতেই দেবে যাচ্ছে ভ্যানের চাকা। ভারি যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। যাতে করে তাদের দুর্ভোগ পিছু ছাড়ছে না। এলাকার আবুল জানান, অনেকদিন দুর্ভোগ পোহানোর পর রাস্তাটি মেরামত করা হয়েছে। কিন্তু মেরামতে মাটির বদলে দেয়া হয়েছে বালু। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রাস্তাটি দেবে যেতে শুরু করেছে। বেশি পরিমাণ বৃষ্টি হলে পানির চাপে রাস্তাটি আবারও ভেঙ্গে যাবে এটা নিশ্চিত। আর এটি হলে তাদের পুরাতন দুর্ভোগ আবারও চলে আসবে। এলাকার মোখলেসুর রহমান জানান, রাস্তা নির্মাণের সময় রড-সিমেন্টের শক্ত সাপোর্ট দেখার কথা বলা হয়েছিল। যাতে করে এলাকার লোকজনের যাতায়াতে ভবিষ্যতে কোন ধরনের সমস্যা না হয়। কিন্তু রাস্তা নির্মাণের সময় এই সাপোর্ট দেয়া হয়নি। ইতোমধ্যেই রাস্তা দেবে যেতে শুরু করেছে, বেশ কিছু কোনায় ধস দেখা যাচ্ছে। এতে করে রাস্তাটি বেশিদিন টিকবে না। রাস্তা নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে বলে জানান তিনি। শুধু রাস্তাঘাট মেরামতই নয়, বন্যায় যেসব সেতু ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেসবেরও মেরামত করা হয়নি। যাতে করে এক বছর ধরে দুর্ভোগকে সঙ্গে নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে জনসাধারণকে। সেতু মেরামত না হওয়ায় জমির ওপর দিয়ে নির্মাণ করা অস্থায়ী রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে তাদেরকে। আর বর্ষায় এই অস্থায়ী রাস্তাও চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। যাতে করে পথচারীদের পাশাপাশি বিপাকের মধ্যে রয়েছেন এলাকার কৃষক ও শিক্ষার্থীরা। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য ঠিকভাবে বাজারজাত করতে পারছেন না। আর সময়মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। কৃষক দেবেন্দ্র নাথ রায় জানান, তাদের উৎপাদিত সবজি, ধান বাজারজাত করার জন্য ভ্যানে করে এই রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সেতুটি মেরামত না করায় অস্থায়ী রাস্তা ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু ভারি এসব কৃষিপণ্য নিয়ে যেতে যেমন রাস্তার প্রয়োজন সেই তুলনায় এই অস্থায়ী রাস্তা না হওয়ায় দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয় তাদেরকে। তাছাড়া রাস্তাটি অতি চিকন হওয়ায় ভ্যান চলাচলের প্রায় অনুপযোগী বলে জানান তিনি। কর্নাই আদর্শ দাখিল মাদ্রাসার সহসুপার মোজাম্মেল হক জানান, সেতুটি মেরামত না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা সময়মতো প্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না। যাতে করে তাদের ভবিষ্যতের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। অতিশীঘ্রই বিষয়টিতে নজর দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি। দিনাজপুর সদর উপজেলার চেহেলগাজী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রায়হান শরিফ অভিযোগ করে জানান, জনবহুল রাস্তাটি মেরামত করা হয়েছে দায়সারাভাবে। মাটির বদলে বালু দিয়েই নির্মাণ করা হয়েছে রাস্তা। যাতে করে অচিরেই ভেঙ্গে যাবে রাস্তাটি। তাছাড়া ভেঙ্গে যাওয়া সেতুটিও মেরামত করা হয়নি। অথচ এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার লোকজন যাওয়া-আসা করে। তাই বিষয়টি খতিয়ে দেখে রাস্তাসহ সেতু ও কালভার্ট মেরামতের উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান তিনি। চোখের সামনে এমন অনিয়মের পরেও কোন অভিযোগ পাননি বলে জানিয়েছেন দিনাজপুর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী খলিলুর রহমান। যেসব কাজ হয়েছে সেসবের কোন ত্রুটি নেই। কোন কাজে অনিয়ম হয়েছে এমন নির্দিষ্ট করে বললে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এখনও এলাকার লোকজন কোন অভিযোগ দেয়নি।
×