ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

বাংলাদেশের ডিজিটাল জয়যাত্রা

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশের ডিজিটাল জয়যাত্রা

(গতকালের পর) সাধারণ কৃষকদের কাছে কৃষিসম্পর্কিত তথ্যসেবা পৌঁছে দিতে আইসিটি বিভাগের অধীন ন্যাশনাল আইসিটি ইনফ্রা নেটওয়ার্ক ফর বাংলাদেশ গবর্নমেন্ট ফেইস-২ প্রকল্প দেশের প্রায় ১৪ হাজার ফার্মারস ক্লাবের ২৫৪টি উপজেলার ফার্মারস ক্লাবকে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ২৫৪টি এগ্রিকালচার ইনফরমেশন এ্যান্ড কমিউনিকেশন সেন্টার (এআইসিসি) রূপান্তরিত করা হয়েছে। এসব এআইসিসিগুলোতে একটি করে সাউন্ড সিস্টেম, বড় পর্দাসহ মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, স্পাইরাল মেশিন, ল্যাপটপ, দু’বছরের জন্য ইন্টারনেট সুবিধাসহ মডেম, কালার প্রিন্টার, স্ক্যানার, স্মার্টফোন এবং জেনারেটর সরবরাহ করা হয়েছে। ই-কৃষি সেবা বাড়ানো গেলে দেশে কৃষি বিপ্লব ঘটানো সম্ভব বলে উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে কৃষি প্রযুক্তিতে যে নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা ও সৃজনশীলতা তৈরি হয়েছে তার ফলে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় ধানের নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে গবেষকরা সফল হয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রি ইতোমধ্যেই ৩১৬টি এবং বিনা ১৪টি নতুন উচ্চফলনশীল ধানের জাতসহ ২৯৩টি অন্যান্য প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব নিয়ে এসেছে। ডায়াবেটিকবান্ধব ও জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাতের গবেষণায় বিশ্বে প্রথম সফল হয়েছেন বাংলাদেশের গবেষকরা। সরকারের কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে বাস্তবমুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রতি বছরে ৫টি ফসল উৎপাদনের পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে। ধানচাষীর ফলন ও আয় বাড়াতে ‘রাইস ক্রপ ম্যানেজার’ (আরসিএম) নামে একটি এ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির অন্যতম সংযোজনের একটি হচ্ছে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে ফসল কাটা, খোসা থেকে দানা আলাদা করা যায়। এ কারণে বিভিন্ন স্থানে সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনায় কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। বর্তমানে কৃষি কাজের বিভিন্ন পর্যায়ে আধুনিক উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতির বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহার হচ্ছে। এসব প্রযুক্তি সহজলভ্য ও জনপ্রিয় করতে ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। সৌরশক্তি, বায়োফুয়েল ও বিদ্যুতের অন্যান্য বিকল্প শক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মাধ্যমে কৃষকরা বাংলাদেশের গবেষকদের আবিষ্কৃত কৃষিযন্ত্রাদি ব্যবহার করে সফলতা পাচ্ছেন। চাষাবাদে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করে উৎপাদন খরচ কমানো ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ছাদ কৃষি, পানিতে গাছের খাদ্য উপাদান মিশিয়ে এবং পরিবেশের অন্যান্য প্রভাবগুলো নিয়ন্ত্রণ করে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে ফসল উৎপাদন, যে কোন আকারের প্লাস্টিক ট্যাঙ্ক অথবা ড্রামের মধ্যে পানি দিয়ে সেখানে সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে মাটির স্পর্শ ছাড়াই একোয়াপনিক্স পদ্ধতিতে একই সঙ্গে মাছ ও সবজির চাষ করার পদ্ধতি আবিষ্কার বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ধান ও মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তির যে বিপ্লব চলছে, তার ফলে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। জাতীয় কৃষিনীতিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার প্রদান করে জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতি ও জাতীয় ক্ষুদ্রসেচ নীতি বাস্তবায়িত হয়েছে। বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় ভাসমান মাছ চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবনের মাধ্যমে মাছ চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ভাসমান মাছ চাষ পদ্ধতির সৃজনশীল এই চিন্তাধারা জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ ছাড়াও কৃষিতে ন্যানো-প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ন্যানোদ্রব্য সংবলিত সার জমির উর্বরতা বাড়াবে। ন্যানো-কীটনাশক পরিবেশের ক্ষতি না করে এবং উপকারী কীটপতঙ্গকে আঘাত না করে ক্ষতিকর কীট ও ছত্রাককে দূরে রাখবে। ন্যানো-প্রযুক্তির এ সব যুগান্তকারী অবদান আমাদের জীবনযাত্রাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম। দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য কৃষিকে নিরাপদ ও লাভজনক করে তুলতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করবে সরকার। এ বিধান রেখে ইতোমধ্যে জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। হাইটেক পার্ক বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ঢাকা মানে বাংলাদেশ নয়, ঢাকার বাইরের বাংলাদেশই হলো আসল বাংলাদেশ।’ তার আদর্শকে ধারণ করে তারই সুযোগ্য দৌহিত্র প্রধানমন্ত্রী তনয় সজীব ওয়াজেদ জয় ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে গ্রাম ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে গুরুত্ব দিয়ে স্বল্প সময়ে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত প্রযুক্তি সেবা পৌঁছে দিয়েছে, যার সুফল গ্রামের মানুষ ভোগ করছে। হাইটেক পার্ক নির্মাণের মাধ্যমে সরকার প্রযুক্তিতে দক্ষ প্রজন্ম তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, যারা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নপূরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। প্রতিনিয়তই নিত্যনতুন পণ্য ও অধিকতর উন্নত প্রযুক্তির পণ্য বাজারে আসছে। ফলে পুরনো পণ্য-সেবাগুলোর জায়গায় হালনাগাদ পণ্য-সেবা দ্রুত চালু হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় স্মার্টফোনের সক্ষমতা, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, ক্লাউড কম্পিউটিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, রিয়েলটাইম স্পিচ রিকগনিশন, ন্যানো কম্পিউটার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, ন্যানোটেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োটেকনোলজি, ব্লক চেইন, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, শক্তি সঞ্চয় কিংবা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং উইয়ারেবল ডিভাইস ও নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন, সাইবার সিকিউরিটি, স্মার্ট সিটিজ, থ্রিডি প্রিন্টিং ও বায়োমেট্রিকস এসব পণ্য-সেবার বিকাশ ঘটছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে বিশ্বের ৫৭তম স্যাটেলাইট ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে চলতি বছরের ১২ মে শুক্রবার রাত ২টা ১৪ মিনিটে অরল্যান্ডোর কেনেডি স্পেসএক্স সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাঙালীর স্বপ্নযাত্রার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েছিল। বর্তমান সরকারের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশের মহাকাশ জয় সম্ভব হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মহাশূন্যে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’এর নির্মাণ ও সফল উৎক্ষেপণ সম্পন্ন হয়েছিল। স্বপ্নের স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণে জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত এবং আনন্দিত। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচার সেবার পাশাপাশি টেলিমেডিসিন, ই-লার্নিং, ই-এডুকেশন, ডিটিএইচ, ভিস্যাটসহ ৪০ ধরনের সেবা প্রদান, সমগ্র বাংলাদেশের স্থল ও জলসীমায় নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচার নিশ্চিত হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে টেরিস্ট্রিয়াল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে সারাদেশে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখা যাবে। স্যাটেলাইটটিতে মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার রয়েছে। ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য, বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশী কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। স্যাটেলাইটটি পুরোপুরি চালু হলে দেশের ৩৭টি টিভি চ্যানেলের কাছে ফ্রিকোয়েন্সি বিক্রির মাধ্যমে বছরে প্রায় ১২৫ কোটি ডলার আয় হবে। এসব চ্যানেল এখন বিদেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট থেকে ফ্রিকোয়েন্সি কিনে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। ৩১ জুলাই ২০১৮ মঙ্গলবার স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণ উদযাপন ও ঢাকার গাজীপুর এবং রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়াতে সজীব ওয়াজেদ জয় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র নামে দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন উদ্বোধন করা হয়। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও গ্রাউন্ড স্টেশন চালুর মধ্য দিয়ে অবিস্মরণীয় এই অর্জন অনন্তকাল গেঁথে থাকবে বাঙালীর হৃদয়ে। স্যাটেলাইট ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। মহাকাশে লাল সবুজের পতাকা নিয়ে সগৌরবে স্যাটেলাইট উড়ে বেড়াচ্ছে। সমাপ্ত... লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×