ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মনজুরুল আহসান বুলবুল

আত্মমর্যাদার অনন্য দৃষ্টান্ত ফকিরহাট

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আত্মমর্যাদার অনন্য দৃষ্টান্ত ফকিরহাট

কয়েক মাস আগে দক্ষিণবঙ্গ থেকে ফেরার পথে, বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলায় যাত্রাবিরতিতে চোখ আটকে যায় একটি ঘোষণায়। ফকিরহাট উপজেলায় স্বাগত জানিয়ে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের স্বাগত তোরণে বলা হচ্ছে : ‘ভিক্ষুকমুক্ত উপজেলা ফকিরহাট’। বৈপরিত্যটি দৃষ্টি কাড়ে সবার। দ্রুতই ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেই : উপজেলার নাম ফকিরহাট, কিন্তু ভিক্ষুকমুক্ত। মজা করার জন্যই দেয়া। কিন্তু প্রতিক্রিয়া নানাবিধ। কেউ মজাটা না ধরতে পেরে ক্ষেপলেন, কেউ জ্ঞান দিলেন ‘ফকির’ আর ‘ভিক্ষুক’ সমার্থক নয়। সেদিন আর কোন প্রতিক্রিয়া দেখাইনি। আজ শুধু প্রতিক্রিয়া দেখাতেই নয়, ফকিরহাটবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতেই এই রচনা। ফকিরহাটবাসীকে মাথানত করে সম্মাননা জানাতেও এই রচনা। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ফকিরহাটের যে খবরটি দেশের জন্য অনন্য গৌরবের দৃষ্টান্ত হলো সে জন্য ফকিরহাটবাসীকে অভিনন্দনও জানাতেই এই নিবন্ধ। পত্রিকায় খবরটি পড়ছি। গর্বে, অহঙ্কারে বুক ফুলে উঠছে। বাগেরহাট থেকে আমার প্রিয় সাংবাদিক বাবুল সরদার যে খবরটি পাঠিয়েছেন ‘জনকণ্ঠ’ তার শিরোনাম করেছে ‘চাহিদা নেই, ফেরত গেল ৮ ইউনিয়নের ১১ হাজার ভিজিএফ কার্ড’। ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, প্রথম পাতায় খবরটি প্রকাশিত। পাতাজুড়ে অনেক খবরের ভিড়ে খবরটি অনেকের দৃষ্টি এড়াতেই পারে কিন্তু আমি নিশ্চিত খবরটির ভেতরে যিনি যাবেন একজন বাংলাদেশী হিসেবে তিনি নড়েচড়ে উঠবেন। মাত্র কয়েকদিন আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির যে চিত্র তুলে ধরেছে তাতে স্পষ্টতই দেখা গেছেÑ সরকার বা রাষ্ট্র যাদের মাথায় সুযোগ সুবিধার সবকিছু ঢেলে দিয়েছে তারা যেন ‘আরও চাই, আরও চাই’ থেকে নিজেদের সরাতেই পারছে না। বাবুল সরদারের রিপোর্ট তথ্য দিচ্ছে : তাদের গালে প্রচ- চপেটাঘাত করেছে ফকিরহাটের ১০ হাজার ৭১৯ জন হতদরিদ্র মানুষ। ঈদ-উল আজহা উপলক্ষে ফকিরহাট উপজেলার হতদরিদ্র ২৯ হাজার ২২০ জনের জন্য সরকারীভাবে পাঠানো হয়েছিল ৫৮৪ টন চাল। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন বলছে এই চাল নেয়ার জন্য ১০ হাজার ৭১৯ জন হতদরিদ্রকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় চেয়ারম্যান বলছেন, তৃণমূলে মানুষের সচ্ছলতা বাড়ছে। ফলে দুস্থদের খাতে বরাদ্দ চাল নেয়ার মানুষ কমছে। প্রশাসন আরও জানাচ্ছে, মাথাপিছু ২০ কেজি হিসেবে বরাদ্দ ধরে ২৯ হাজার ২১টি কার্ডের জন্য ৫৮৪.৪০ টন পাঠানো হলেও ফকিরহাট উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লিখিতভাবে জানান, তাদের ইউনিয়নে হতদরিদ্র না থাকায় তারা এই চাল বিতরণ করতে পারছে না। ফলে প্রায় ১১ হাজার কার্ডের চাল ফেরত পাঠানো হলো। ৮টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লিখিতভাবে বলছেন, বরাদ্দকৃত কার্ডের সমপরিমাণ হতদরিদ্র না থাকায় বেতাগা থেকে ১৮৫১, লখপুর থেকে ২৩২৯, পিলুজংগ থেকে ৫০০টি, ফকিরহাট সদর থেকে ২৩১৮, বাহিরদিয়া-মানসা থেকে ১০৫৭, নলদা মৌভোগ থেকে ১০০০টি, শুভদিয় থেকে ৫শ’সহ গোটা উপজেলা থেকে ১০ হাজার ৭১৯টি কার্ড ফেরত পাঠানো হয়েছে। যে বাংলাদেশের চিত্র দেখে অভ্যস্ত আমরা এই খবরে সেই ধারণা ধাক্কা খেল। প্রথম ধাক্কাÑ একটি নয়, দুটি নয় বাংলাদেশের একটি উপজেলার আটটি ইউনিয়ন পাওয়া গেল যেখানে সরকারী সহায়তার চাল নেয়ার মতো দুস্থ মানুষ নেই। দ্বিতীয় ধাক্কাÑ দুস্থ মানুষ নেই তো কি হয়েছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি আর স্থানীয় প্রশাসন জোট বেঁধে হাত-পায়ের টিপ দিয়ে এই ১১ হাজার কার্ডের সমুদয় চাল তো পুরোটাই গায়েব করে দিতে পারতেন, তাও হয়নি। এই চিত্র থেকে প্রথম যে প্রশ্নÑ ফকিরহাটের ৮ উপজেলার সব হতদরিদ্র মানুষ কি এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন? সবাই কি ধনী হয়ে গেছেন? জবাব, নিশ্চয়ই না। নির্মোহভাবে বলতে হবে দেশের অর্থনীতি নিশ্চয়ই এমন একটি সুযোগ তৈরি করেছে, যেখানে হতদরিদ্র মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার এমন বিকল্প ব্যবস্থা করতে পেরেছেন, যেখানে তাদের আর দুস্থজনের খয়রাতি সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। আর ওই যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার কথা বললাম, তারাও কেন সহজে লুটপাটের জায়গা থেকে সরে এলেন তার জবাব হচ্ছেÑ তৃণমূল রাজনীতি বা প্রশাসনে একটি গুণগত পরিবর্তন এসেছে বা দুর্নীতির জন্য দল বা প্রশাসন থেকে এমন বার্তা পৌঁছাচ্ছে, যেখানে গোটা পরিস্থিতি বদলে দেয়ার ইঙ্গিত আছে। কিন্তু দুটি পর্যায়েই একটি সাধারণ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি পড়ছে, তা হচ্ছে ‘মর্যাদা’র। একজন হতহরিদ্র মানুষের যে আত্মসম্মানবোধ আছে আমরা ‘পরিষ্কার কাপড় পরনেওয়ালারা’ মাঝে মধ্যেই ভুলে যাই। জাতির জনকের সেই ভাষণের কথা স্মরণ করি যেখানে তিনি বলেছিলেন... আপনি চাকরি করেন আপনার মায়না দেয় ওই গরিব কৃষক, আপনার মায়না দেয় ওই শ্রমিক, আপনার সংসার চলে অই টাকায়, আমি গাড়ি চড়ি অই টাকায়... ওদের সম্মান করে কথা বলেন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন, ওরাই মালিক...। ‘ওদের’ যে সম্মান করে, ইজ্জত করে কথা বলতে হয় তা আমাদের মাথায় আসে না। আর দেশের ‘মালিক’ বলে আমরা তো তাদের গণ্যই করি না। দেশে লুটপাটকারীদের তালিকাও কম দীর্ঘ নয়। ব্যাংক লুট, জমি লুট, ভূমি লুটসহ এই লুটেরাদের তালিকা নিয়ে বিস্তর লেখা যেতে পারে, কিন্তু লুটপাট বাহিনীর কোন আত্মমর্যাদাবোধ নেই। পরিবার পরিজনসহ লুটপাট করছেন, মানুষের ঘৃণা আর থানা পুলিশ কোর্ট-কাচারিতেই তাদের জীবন বৃত্তাবদ্ধ। কিন্তু ফকিরহাটের হতদরিদ্ররা নিজেদের অবস্থার সামান্য উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের আত্মসম্মানবোধ ও মর্যাদার শক্ত বার্তাটি দিয়েছেন। আগে অসহায় অবস্থায় হয়তো তাদের এই সাহায্যটি নিতে হয়েছে, কিন্তু দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে তারা মুখ ঘুরিয়ে বলছে ‘না, খয়রাতি সাহায্যের প্রয়োজন নেই আমাদের, আমরা ভাল আছি।’ আর প্রচলিত ধারণায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের মাঠের কর্মীদের যেভাবে মনে করা হয় দুর্নীতি তাদের জীবন-জীবিকারই অংশ, ফকিরহাটের জনপ্রতিনিধি আর মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা সেই ধারণাতেও আঘাত হেনেছে। এই ছোট্ট উদাহরণটি একটি সত্যই প্রতিষ্ঠিত করে, রাষ্ট্রের নেতৃত্ব যদি সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ থাকেন, তারা যদি রাষ্ট্রের মর্যাদাকেই সবার আগে বিবেচনা করেন এবং এই বার্তাটি যদি যথাযথভাবে পৌঁছানো যায় তাহলে রাষ্ট্রের সকল পর্যায়েই গুণগত পরিবর্তন আসতে বাধ্য। উদাহরণ হিসেবে পদ্মা সেতুর কথা বলি। পদ্মা সেতুর সাহায্য বন্ধের জন্য যে দুর্নীতির অভিযোগটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল তা ছিল জাতির জন্য অবমাননাকর। বড় দাতারা ধরেই নিয়েছিল বাংলাদেশ একটি গরিব দেশ, তাই যে কোন অভিযোগ তুলেই পার পাওয়া যাবে। দুটোই সত্যিÑ বাংলাদেশ ধনী দেশ নয়, বাংলাদেশে কোন দুর্নীতি হয় না এমন কথাও জোর দিয়ে বলা যাবে না। কিন্তু যে প্রকল্পে কোন টাকার ছাড়ই হয়নি, শুধু সাদা কাগজে একটি নোট দেখেই সেই প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে, একটি দেশকে অবমাননাকর জায়গায় ঠেলে দেয়ার উদ্দেশ্য যে ছিল কুমতলব তাতো এখন প্রমাণিত। এ রকম একটি কুমতলবী চক্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুকঠিন দৃঢ় অবস্থান দুটি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে; প্রথমত, নিজের সততার জায়গাটিতে তিনি পরিচ্ছন্ন, দ্বিতীয়ত, দেশের মর্যাদার প্রশ্নে তিনি আপসহীন। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে অবস্থান করেও একটি জাতি তো এ রকম নেতৃত্বই প্রত্যাশা করে, এ রকম নেতৃত্ব নিয়ে অহঙ্কার করে। একটি পরিবারের অভিভাবকের দায়িত্ব যেমন পরিবারের সদস্যদের রুটিরুজি আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তেমনি পরিবারের সদস্যদের সম্ভ্রম ও মর্যাদা রক্ষার দায়িত্বও তার। তেমনি একটি রাষ্ট্রের নেতার দায়িত্ব শুধু দেশবাসীর রুটিরুজি, নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই নয়, দেশের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্বটিও তার। তাই এই দেশটির প্রতিষ্ঠাতার কন্যা শেখ হাসিনা যখন পদ্মা সেতু নিয়ে দেশের মাথায় দুর্নীতির কলঙ্ক টিপ পরিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, তখন দৃশ্যতই তিনি রাষ্ট্রের একজন সফল অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। এবং দেশের প্রকৃত দেশপ্রেমিকরা তার পাশে দাঁড়ান। ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ এই পদ্মা সেতু যখন ইতিহাস হবে তখন এটি শুধু দেশের সবচাইতে বড় অবকাঠামোগত উন্নয়নের দৃষ্টান্ত হিসেবেই দাঁড়িয়ে থাকবে না, বাংলাদেশের মর্যাদা রক্ষার আপোসহীন প্রতীক হিসেবেও দাঁড়িয়ে থাকবে। সেই সাহসিকতার পথ ধরেই দেশকে ধারাবাহিকভাবে অবমাননাকর শর্তযুক্ত বৈদেশিক সাহায্যের শৃঙ্খলমুক্ত করার যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, তারই একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ দেশের হতদরিদ্রদের ‘খয়রাতি সাহায্যে’র অবমাননাকর কর্মসূচী থেকে বের করে আনা। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই বার্তাটি দৃঢ়ভাবে দিতে পারে, কিন্তু এই আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হতে হবে মানুষের একেবারে ভেতর থেকেই। ফকিরহাট উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের ১১ হাজার হতদরিদ্র মানুষ ও সে এলাকার জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যে এই বোধটি জাগ্রত তা দৃশ্যমান হয়েছে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে। ‘দেশের মালিক’ হিসেবে ফকিরহাটের হতদরিদ্র মানুষকে সম্মান জানাই। হতদরিদ্র এই মানুষ অর্থ-বিত্তে নিঃস্ব হলেও নিজেদের মর্যাদার বিষয়ে তারা কতটা সচেতন, কতটা উঁচুতে তাদের অবস্থান এ ঘটনা তারই প্রমাণ। নানা প্রকারে অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে নিজেদের আত্মসম্মানবোধ হারিয়ে যে জীবনযাপন, তাকে আর যাই হোক ‘মনুষ্য জীবন’ বলা যায় না। মনুষ্য জীবন মানেই মর্যাদার। যে জীবনে মর্যাদা নেই, সম্মান নেই অর্থ-বিত্তে তা যত বিশালই হোক না কেন ধিক সেই জীবনকে! বাংলাদেশকে মর্যাদাপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য জাতির জনকের কন্যার যে প্রাণান্ত চেষ্টা, সেই চেষ্টার একটি ক্ষুদ্র সাফল্য হিসেবে ফকিরহাটের উদাহরণ আমাদের পথ দেখাক। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর জন্য একটা বড় উপহার হোক, বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের মানুষ আর ‘খয়রাতি সাহায্য’ নেয় নাÑ এমন একটি দেশ। এমন একটি মর্যাদাপূর্ণ বাংলাদেশের স্বপ্নই তো তিনি দেখেছিলেন। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক [email protected]
×