ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আলম শাইন

অভিমত ॥ বাঘ সংরক্ষণের উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

অভিমত ॥ বাঘ সংরক্ষণের উদ্যোগ

সমীক্ষায় জানা যায়, স্বভাবে সুন্দরবনের বাঘ শুধু হিংস্রই নয়; উগ্রহিংস্র। ওদের এ হিংস্রতাই শাপেবর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্যটা আজ অবধি টিকে রয়েছে শুধুমাত্র রয়েল বেঙ্গলের হিং¯্রতার কারণে। তাই সাধুবাদ জানাতে হয় এ অতন্দ্র প্রহরীকে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যে অতন্দ্র প্রহরী নিজ দায়িত্বে সুন্দরবন রক্ষা করছে সে প্রাণীটি নিজকে এবং তার শাবককে রক্ষা করতে পারছে না চোরাকারবারীদের কবল থেকে। চোরাকারবারীরা বিভিন্ন কৌশলে পরাস্ত করে প্রাণ কেড়ে নিয়ে ওদের চামড়া ছিলে হাড়গোড় সংগ্রহ করে পাচারের উদ্দেশ্যে লোকালয়ে নিয়ে আসে। অতঃপর রাজধানী হয়ে চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া ও মঙ্গোলিয়ার বিভিন্ন ওষুধ শিল্পে চলে যায় বাত, ব্যথা, শক্তিবর্ধক ওষুধের কাঁচামাল হিসেবে। যার কারণেই একটি বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ (চামড়া ব্যতীত) ৫ থেকে ১০ লাখ টাকায় স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এ মূল্য নাকি ২০ থেকে ৩০ হাজার ডলারে গিয়ে ঠেকে। বিরাট অঙ্কের লোভের বশবর্তী হয়ে চোরাকারাবারীরা বাঘের পেছনে লেগেই থাকে। লগ্নিও করে প্রচুর অর্থকড়ি। এমন ঘটনা বার বার সুন্দরবনাঞ্চলে ঘটেছে, যার প্রমাণ রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৫ সালে ১৩ জানুয়ারি ঘটিয়েছে চোরাকারবারীরা। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলায় র‌্যাব-৮ এর লোকজন চোরকারবারীদের ধরতে সক্ষমও হয়েছেন। তৎসঙ্গে উদ্ধার করেছেন ৯ ফুট ৭ ইঞ্চি লম্বা ১টি বাঘের চামড়া, ২৪ খ- হাড়, ২৯টি দাঁত এবং ১টি মাথা। দুঃসংবাদটি জানতে পেরে আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়েছি তখন। যে মুহূর্তে বাঘ শুমারির কাজ চলছিলও ঠিক তখনই বাঘ হারানোর সংবাদ সত্যি আমাদের ভীষণ বিচলিত করেছে। উল্লেখ্য, তারও কয়েক মাস আগে র‌্যাব-৮ তিনটি বাঘের চামড়া উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা এমনিতেই অপ্রতুল্য। ২০০৪ সালের শুমারি অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা মাত্র ছিল ৪৪০টি। তার মধ্যে ২১টি ছিল বাচ্চা বাঘ। অপরদিকে পুরুষ বাঘের সংখ্যা ছিল ১২১টি এবং স্ত্রী বাঘের সংখ্যা ছিল ২৯৮টি। বছর দশেকের মাথায় সেই সংখ্যা নেমে হয়েছে ১০৬টি। অর্থাৎ ২০১৫ সালে শুমারিতে মাত্র ১০৬টি বাঘের সন্ধান পাওয়া গেছে। আর চলতি শুমারিতে ১৩০টি বাঘের সন্ধান পাওয়া যায়। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, শুধু সুন্দরবনেই নয়, সমগ্র বিশ্বেই বাঘের সংখ্যা অপ্রতুল। মাত্র হাজার দু’য়েক ডোরাকাটা বাঘের বাস রয়েছে সমগ্র বিশ্বে। যার কারণেই আইইউসিএন ২০১০ সালে রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী হিসেবে ঘোষণা করেছে। সুন্দরবনের (বাংলাদেশ অংশের) আয়তন ৬ হাজার ০১৭ বর্গকিলোমিটার। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত অংশের আয়তন ৩ হাজার ৯৮৩ বর্গকিলোমিটার। তার মধ্যে বাংলাদেশের অংশে মাত্র ১৩০টি বাঘের বাস রয়েছে, যা বড়ই বেমানান। এ সংখ্যাটি সুন্দরবনের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে মোটেও সুখকর সংবাদ নয়, বরং বড়সড় একটা দুঃসংবাদ। তার ওপর যদি আমরা এভাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগার হারাতে থাকি, তাহলে ওদের সংখ্যা শূন্যের কোটায় পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। বিবিধ কারণে বাঘের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। যার মধ্যে অন্যতম কারণটি হচ্ছে বাঘের বাচ্চার জন্মহার বরে অপ্রতুলতা। তা ছাড়া বাঘের বাচ্চাকে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে বড় হতে হয়। তার মধ্যে প্রধান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় বাবা বাঘের নজর এড়িয়ে থেকে। ক্ষুধার্ত বাবা বাঘ মা বাঘের কোল থেকে নিজ শাবককে ছিনিয়ে নিয়ে খেয়ে ফেলে। ফলে জন্ম নেয়া অনেক শাবক মাসখানেকের মধ্যে হারিয়ে যায়। এর সঙ্গে যদি চোরাকারবারীদের দৌরাত্ম্য যোগ হয়, তাহলে বিষয়টা কোন্ পর্যায়ে যেতে পারে তা অনুমেয়। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাঘেদের দুঃসময় চলছে এখন। অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে ওরা। অস্তিত্ব সঙ্কটের লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে সুন্দরবনে কোনমতে বেঁচে-বর্তে আছে স্বল্পসংখ্যক বাঘ। সেই নিদারুণ সময়ে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্তের সংবাদ জানতে পেরেছি আমরা। সিদ্ধান্তটি হচ্ছে, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর নিরাপদ বিচরণ ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ এলাকাকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে। ইতোপূর্বে এ ধরনের অভয়ারণ্য ছিল মাত্র ২৩ শতাংশ এলাকা নিয়ে। বলা যায়, এটি বাঘ রক্ষার জন্য একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। উদ্যোগটি নেয়ার ফলে শুধু বাঘই নয়, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যও রক্ষা পাবে। আগের মতো বাঘের সংখ্যা রাতারাতি বৃদ্ধি না পেলেও বেশ খানিকটা সহায়ক হবে সংখ্যা বৃদ্ধিতে। এ ক্ষেত্রে প্রথমত নজর রাখতে হবে প্রতিপক্ষ বাবা বাঘের প্রতি। বাবা বাঘ যাতে করে শাবককে খেয়ে ফেলতে না পারে সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে পারলে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বড় ধরনের বাধা থাকবে না। আরেকটি বিষয়েও নজর দিতে হবে, সেটি হচ্ছে অভয়ারণ্য রক্ষকদের প্রতি। যাতে করে দুষ্কৃতকারীর যোগসাজশে তারা বাঘের সর্বনাশ ঘটাতে না পারে। এ দুটি বিষয়ে সজাগ থাকতে পারলে হয়ত আমরা আবার সুন্দবনের যত্রতত্র বাঘের বিচরণ দেখতে পাব। লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রকৃতি বিশারদ [email protected]
×