ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণ কেড়ে নেয়া বাসচালক জেলে, উত্তমের বাড়িতে কান্নার রোল

প্রকাশিত: ০৬:২০, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

প্রাণ কেড়ে নেয়া বাসচালক জেলে, উত্তমের বাড়িতে কান্নার রোল

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রাস্তায় যানবাহনকে সুশৃঙ্খলভাবে চলার মূল কাজটিই করে থাকে পুলিশ। আর সেই পুলিশেরই এক কর্মকর্তাকে চাপা দিয়ে হত্যা করল একটি উচ্ছৃঙ্খল বাস। বাসচাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সারাদেশ উত্তাল হওয়ার পর পুলিশ হত্যার ঘটনা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সড়কে চালকদের নৈরাজ্যের বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। এদিকে পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনায় বাসটির চালককে গ্রেফতারের পর কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। অন্যদিকে নিহত পুলিশ কর্মকর্তার বাড়িতে চলছে মাতম। নিহতের তিন মাসের একমাত্র কন্যাসন্তানকে বুকে নিয়ে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তা উত্তম কুমারের স্ত্রী ও বাবা মা। উত্তম কুমারের পরিবারকে নগদ প্রায় আড়াই লাখ টাকা দেয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের তরফ থেকে। আরও টাকা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। রবিবার বিকেল সোয়া চারটার দিকে মিরপুর-১ নম্বর সনি সিনেমা হলের সামনে রাইনখোলায় ঈগল পরিবহনের একটি বেপরোয়া বাসচাপায় পুলিশের এসআই উত্তম কুমারের মৃত্যু হয়। বুধবার বাস একটি প্রাইভেটকারকে চাপা দেয়। পরে বাসটিকে শনাক্ত করে সেটি জব্দ করে পুলিশ। জব্দ বাসটিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ঢাকার রূপনগর থানায়। থানার এসআই উত্তম কুমার মোটরসাইকেলযোগে বাসটির সামনে সামনে যাচ্ছিলেন। চালক বেলাল বেপরোয়া গতিতে বাসটি চালিয়ে এসআইকে চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নিহতের ভাই দীপঙ্কর বাদী হয়ে শাহআলী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। নিহত এসআইর বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে। সোমবার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহ্ আলী থানার এসআই খোকন চন্দ্র দেবনাথ বাসচালক বেলালকে ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করেন। আদালতে মামলাটির তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসামিকে কারাগারে রাখার আবেদন করেন মামলাটি তদন্ত কর্মকর্তা। ঢাকা মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাস শুনানি শেষে চালককে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এ ব্যাপারে রূপনগর থানার ওসি এসএম শাহ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, চালকের কাগজপত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত চালকের কাগজপত্র সঠিক না ভুয়া তা জানা যায়নি। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তা জানা যাবে। একই বাস দুটি অপরাধে জড়িত থাকার বিষয়ে চালকের সাজা দ্বিগুণ হবে কিনা সে বিষয়টি এখনই বলা যাচ্ছে না। সেটি আইনী বিষয়। তবে প্রাইভেটকারে চাপা দেয়ায় বাসচালক বেলাল ছিল কিনা সে বিষয়টি এখনও নিশ্চিত নয়। সেটি জানার চেষ্টা চলছে। নিহত পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রাথমিকভাবে ডিএমপির তরফ থেকে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। তিনি আরও অর্থ সহায়তা পাবেন। উত্তম কুমারের মরদেহ দাহ হয়নি। মঙ্গলবার দাহ হওয়ার কথা। নিহতের মাত্র ৩ মাসের একটি মেয়ে রয়েছে। নিহতের পরিবারকে সান্ত¡না দেয়ার কোন ভাষা নেই। চলতি বছরের ৩ এপ্রিল দুপুর দেড়টার দিকে কাওরানবাজার সার্ক ফোয়ারার কাছে বিআরটিসির দোতলা বাস ও স্বজন পরিবহনের একটি বাসের মধ্যে রেষারেষি করে যাওয়ার সময় দোতলা বাসের যাত্রী মহাখালী তিতুমীর সরকারী কলেজের ছাত্র রাজীবের ডান হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দীর্ঘদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে শেষ পর্যন্ত রাজীব মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ঘটনাটি মানুষের বিবেককে রীতিমতো নাড়িয়ে যায়। সারাদেশে ঘটনাটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর কয়েকদিন পরেই যাত্রাবাড়ীর শনিরআখড়ায় স্পিডব্রেকারে নামার সময় চালক জোরে লেগুনা টান দিলে ছিটকে পড়ে নুসরাত জাহান ঝুমা নামের ইডেন কলেজের প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণীর এক ছাত্রীর মৃত্যু হয়। গত ১৬ এপ্রিল সকালে খোদ রাজধানীর পলাশীতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি বাস ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেনকে চাপা দেয়। এতে পুলিশ কর্মকর্তার বাম পা বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে পুরোপুরি থেঁতলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তার হার্ট এ্যাটাক হয়। গত ১৭ এপ্রিল গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বেদগ্রামে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ট্রাকের ঘষায় কাঁধ থেকে ডান হাত পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় টগবগে যুবক খালিদ হাসান হৃদয়ের। গত ২০ এপ্রিল রাত নয়টার দিকে মহাখালী থেকে পাল্লাপাল্লি করে যাওয়ার চেষ্টাকালে বনানীতে রাস্তা পারাপারের সময় দোতলা বিআরটিসি বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে রাজিয়া খাতুন ওরফে রোজিনার (১৯) তার ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার নয় দিন পর তার মৃত্যু হয়। ঘটনাগুলো সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে এমইএস বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীবাহী জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী দিয়া খানম মীম ও বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আব্দুল করিম রাজিব নিহত হয়। আহত হয় অন্তত ১৫ শিক্ষার্থী। এই ঘটনার পর সারাদেশে শত শত স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আসে। তারা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করতে থাকে। টানা ৮ দিন তারা পুরো দেশের যানবাহন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেন। শেষ পর্যন্ত সরকারের আশ্বাসে পুলিশের হাতে নিরাপদ সড়ক গড়ে তোলার দায়িত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীরা ঘরে ফেরে। পুলিশ বলছে, পুলিশকেই বেপরোয়া গতির বাস চাপা দিয়ে হত্যা করার ঘটনাটি রীতিমতো রহস্যজনক। ঘটনাটি আবার নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এমন ঘটনায় তারাও রীতিমতো হতবাক। এটি কোন সাধারণ ঘটনা নাকি, পরিকল্পিতভাবে দেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করার জন্য এমন ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, সে বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। রবিবার পুলিশ কর্মকর্তাকে চাপা দিয়ে হত্যার ঘটনায় নতুন করে রাস্তায় যানবাহনের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং বেপরোয়া বাসচালকদের রাশ টেনে ধরার বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা চলছে। সরকার অবৈধ চালকদের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে।
×