ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মনের অজান্তেই আমার শিল্পকর্মে প্রবলভাবে আসে দেশভাগের প্রভাব

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মনের অজান্তেই আমার শিল্পকর্মে প্রবলভাবে আসে দেশভাগের প্রভাব

মনোয়ার হোসেন ॥ জমিদারপুত্র থেকে প্রখ্যাত চিত্রকর। এদেশেই জন্মেছিলেন ভারতের শক্তিমান চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী। এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রখ্যাত এই শিল্পীর অবস্থান এখন রাজধানী ঢাকায়। শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালা মিলনায়তনে রবিবার অংশ নেন একটি সেমিনারে। শিল্প-বিষয়ক সেই বক্তৃতা শেষে মুখোমুখি হন জনকণ্ঠের প্রতিনিধির সঙ্গে। সাক্ষাতকারে উঠে আসে শিল্পীর জীবনের নানা বিষয়, দেশভাগের প্রভাব, প্রথম ছবি আঁকার অভিজ্ঞতা, রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া ইত্যাদি। এশিয়ান আর্ট বিয়েনালের গুরুত্ব তুলে ধরে যোগেন চৌধুরী বলেন, গতবারের চেয়ে এবার অনেক জমজমাট মনে হচ্ছে। প্রদর্শনী উপভোগ করতে প্রচুর দর্শক সমাগম ঘটছে। আগের চেয়ে আয়োজনের সাংগঠনিক শক্তিটাও বেড়েছে। এছাড়া একটা আয়োজন যখন ৩৭ বছর ধরে ধারাবাহিক হচ্ছে তখন সেটার সামাজিক একটা আলাদা ভূমিকা আছে। শিল্পকলা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহ ও ধারণা বাড়ছে। সেই হিসেবে প্রগতিশীলতারও একটা প্রতিচ্ছবি এই বিয়েনাল। নিজের আঁকাআঁকির সূচনালগ্নের কথা উল্লেখ করে যোগেন চৌধুরী বলেন, আমার জীবনের প্রথম ছবিটা এঁকেছিলাম দেয়ালে। সেটা সম্ভবত ’৪৮ সালে। তখন আমরা বাংলাদেশ থেকে পাড়ি জমিয়েছি ভারতে। লাল-নীল রং আর পেন্সিলে একটা ময়ূর এঁকেছিলাম। এর আগে বাংলাদেশে থাকাকালীন ছোটবেলায় বাড়িতে মাটির প্রতিমা গড়া দেখে ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা জন্মায়। তখন প্রতিমা গড়ার বেঁঁচে যাওয়া রংগুলো জমিয়ে রাখলেও আঁকাআঁকি ভাবনাটা মনে আসেনি। মাটি দিয়ে কিছু একটা বানানোর চেষ্টা করতাম। পরবর্তীতে ওই সংগ্রহ করা রং দিয়েই এঁকেছিলাম জীবনের প্রথম ছবি। অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুরে আড়াই হাজার বিঘার জমিদার ছিল যোগেন চৌধুরীর বাবা প্রমথনাথ চৌধুরী। পিতৃস্মৃতিচারণ করে শিল্পী বলেন, আমার বাবা জমিদার হলেও শিল্পকলা বিষয়ে তাঁর একটা আলাদা ট্যালেন্ট ছিল। জমিদারির ফাঁকে ফাঁকে জমির দলিলাদিতে মনের আনন্দে তিনি ছবি আঁকতেন। এভাবে অনেক ছবি এঁকেছিলেন। পরবর্তীতে দেশভাগের কারণে ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ায় সেগুলো আর সংগ্রহে রাখতে পারিনি। দেশভাগের দুঃসহ বেদনা এখনও আঁচড় কাটে শিল্পীর মনে। বলেন, শৈশবে দেশান্তরী হতে হয়েছিল। ওই বয়সে জমিজমার বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল না। কিন্তু আমাদের জীবনে বিরাট একটা বিবর্তন ঘটে যায়। বাংলাদেশে বসবাসকালীন আমাদের একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। সেখানে থিয়েটার হতো, পূজাম-পে পূজা হতো। দেশভাগের কারণে আমাদের সেই সংগঠিত সমাজটা ভেঙ্গে যায়। জীবনের সবকিছু নড়বড়ে হয়ে যায়। তখন একটাই ভাবনা, জীবনটাকে কিভাবে দাঁড় করাব। পরবর্তীতে যখন পরিণত হলাম দেশভাগের বেদনাটা তখন গভীরভাবে উপলব্ধি করলাম। এখন যেমন রোহিঙ্গারা শরণার্থী জীবনযাপন করছে। মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়াতেও এটা ঘটছে। দূর থেকে দর্শক হয়ে সেটা উপলব্ধি করা যায় না। নিজে আক্রান্ত হলে বোঝা যায় সেটা কতটা অমানবিক। আক্রান্ত প্রতিটি মানুষের ওপরই এই দেশহারা হওয়ার ছাপ পড়ে। আমার শিল্পকর্মের মধ্যেও সেটার প্রবল প্রভাব আছে। প্রচুর কালো রং থাকে আমার কাজে। সেটা আমি ইচ্ছে করে করিনি। কারণ, আমি যখন আর্ট কলেজে পড়তাম তখন বাড়িতে বিদ্যুত ছিল না। হারিকেনের আলোয় স্কেচ করতাম। মনের ভেতরে একটা ডিপ্রেশনের কাজ করত। এখনও আমার কাজে সেই বিষণœতা মনের অজান্তেই এসে যায়। আধুনিক প্রযুক্তি মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা গড়ে দিচ্ছেÑএ বিষয়েও আলোকপাত করেন শিল্পী। বলেন, মানুষ এখন ফোনে নিবিষ্ট থাকে, যাকে কখনও দেখেনি কিংবা চেনে না এমন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হচ্ছে। এভাবে একটা অলৌকিক যোগাযোগের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ছে মানুষ। সেখানে আত্মিকতা গড়ে উঠছে না। বিশ বছর পর এটা আরও কত বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, আমরা নিজেরাও জানি না। এগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যদিকে সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে খুন কিংবা ধর্ষণের খবর প্রচার করা হয়। এটা শিশুদের মনে খুব প্রভাব ফেলে। মনের ভেতরে লালিত স্বপ্ন সম্পর্কে যোগেন চৌধুরী বলেন, ইউরোপে গ্রাম ও শহরের সব মানুষের মধ্যে শিল্পটা ছড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ বা ভারতে সেটা হয়নি। কারণ, শিক্ষাটা ছড়ায়নি। ইউরোপের সুন্দর ঘরবাড়ি দেখে তাকিয়ে থাকি। শিল্পকলার নানা এরিয়া আছে। সামগ্রিকভাবে সঠিক প্ল্যানিং ও আর্কিটেকচারের যথাযথ প্রয়োগে সুন্দর হতে পারে একটা শহর। শুধু ছবি আঁকা নয় চলতে ফিরতে যেন শিল্পকে উপভোগ করা যায়। গ্রীকরা প্রাচীন যুগে, ইতালীয়রা রেনেসাঁর সময় কিন্তু এভাবেই নিজেদের শহর গড়ে তুলেছেন। নিজের রাজনীতিবিদের পরিচয় প্রসঙ্গে বলেন, আমাকে পাবলিক ভোটে যেতে হয়নি। আমি হতেও চাইনি। মুখ্যমন্ত্রীকে পছন্দ করি বলে তার অনুরোধে রাজনীতিতে যোগ দেই। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যসভার সদস্য হই। রাজনীতিটা আসলে ইন্টারেস্টিং। সংস্কৃতিসেবী ও রাজনীতিবিদের মধ্যে পার্থক্য আছে। একটা গ্রুপ সমাজ ও সংস্কৃতিকে ভালবাসে। অন্যদিকে রাজনীতিকরা অন্য জাতের। তারাও সমাজকে ভালবাসেন। তবে কিভাবে নির্বাচনে জিতে আসবে, সেটাই আগে ভাবে। তাদের মেকানিজমটা আলাদা। তাই রাজনীতিবিদ ও সংস্কৃতিসেবীর পার্থক্য আছে। তবে সব রাজনীতিক একরকম নয়। নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের পরামর্শ দিয়ে যোগেন চৌধুরী বলেন, অনেকেই বই না পড়ে শুধু কম্পিউটার থেকে তথ্য নিচ্ছে। এভাবে শিল্পচর্চা হয় না। জীবনের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। সেটা আসতে হবে শিল্পকর্মে। যাপিত জীবন থেকেই সৃষ্টি হয় শিল্পকর্ম। নানা অনুষঙ্গকে গ্রহণ করতে হবে। শিল্পী হওয়ার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে যোগেন চৌধুরী বলেন, আন্তরিক ও সৎ হতে হবে। জন্মগতভাবেই শিল্পী হওয়ার এলিমেন্ট থাকতে হবে। জিনের মধ্যেই এসব এলিমেন্ট থাকে। সামাজিক পরিবেশ সেই শিল্পীসত্তাকে পরিস্ফুটিত হতে সাহায্য করে। এজন্য ইনস্টিটিউটেরও প্রয়োজন আছে। ১৯৩৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের কোটালীপাড়ার ডহরপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন যোগেন চৌধুরী। তিনি কলকাতা সরকারী আর্ট এ্যান্ড ক্র্যাফট কলেজ থেকে ’৬০ সালে ব্যাচেলর অব ফাইন আর্টস ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ফরাসী সরকারের বৃত্তিতে ’৬৫ সালে প্যারিসে যান এবং চিত্রকলা বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। সেখান থেকে ফিরে ’৭২ সালে দিল্লীতে রাষ্ট্রপতি ভবনে কিউরেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। ’৮৭ সাল থেকে বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন কলাভবনের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি সেখানকার ইমেরিটাস অধ্যাপক। ২০১৪ সালের ৩ এপ্রিল থেকে তিনি পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন।
×